Home ফিকহ ও মাসায়েল স্বাধীনতা : ইসলামের দৃষ্টিতে

স্বাধীনতা : ইসলামের দৃষ্টিতে

।। হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ ।।

ইসলাম সর্বোচ্চ মানবতার ধর্ম। ব্যক্তিতে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও পররাষ্ট্র মানবতা বজায় রাখা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই মানবতা প্রতিষ্ঠায় যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় কোন প্রকার জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার অথবা পেশিশক্তির জোরে চাপিয়ে দেয়া কোন মতবাদ, তখন ইসলাম সে প্রতিকূলতার মূলোৎপাটনে তার অনুসারীদের নির্দেশ দেয়।কোন বিদেশী শক্তি অথবা দেশী স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি-গোষ্ঠী যদি কোনো জাতির মালিক হয়ে বসে তাদের গোলাম বানাতে চেষ্টা করে, তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করে তখন ইসলাম সে গোলামির জিঞ্জির ছিঁড়ে ফেলতে প্রাণপণে লড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘প্রকৃতিগতভাবে সকল মানুষ স্বাধীন’ এই নীতিরই জয়গান গায় ইসলাম। যুগ-যুগান্তরে ইসলাম এই নীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। না, ইসলাম কারো পদলেহন বা চাটুকারিকাতাকে প্রশ্রয় দেয় না। মূলত চাটুকাররা দেশ ও জাতির শত্রু।

স্বাধীনতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

‘স্বাধীনতা’ অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টির গোলামি না করা, কারো কাছে মাথা নত না করা যেহেতু মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তাই তা স্বভাবধর্মেরও অন্তর্ভুক্ত। আর বাস্তব অর্থে স্বভাব ধর্মের নামই হলো ইসলাম। এ প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর ফিতরতের (স্বভাবধর্মের) অনুসরণ করো। যার ওপরে তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।’ [সূরা রুম , আয়াত ৩০]

রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক নবজাতকই স্বভাব ধর্মের উপর জন্ম গ্রহণ করে’। তারা কারো গোলামি স্বীকার করে না। স্রষ্টা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না। গোলামী করতে হয় তো কেবল একক, সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গোলামি করে। কেবল তাকেই মালিক হিসাবে সিজদা করে। এভাবেই মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব বিকশিত করে ইসলাম। ব্যক্তির ভিতর থেকে স্বাধীনতার মানসিকতাকে উজ্জীবিত করে এই ফিতরতী দীন। সব পরাধীনতার জিঞ্জির, সব ব্যক্তি ও প্রাণী ও জড় পদার্থের নাগপাশ থেকে চিরমুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দেয় ইসলাম।

ইসলামের এই স্বাধীনতা দর্শন এত সুস্পষ্ট  এবং দ্ব্যর্থ যে, ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারেও জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের অনুমোদন দেয় না ইসলাম। কুরআন নাযিল হওয়ার পরেও, শেষ নবী এবং তার উত্তরাধীকারীদের পক্ষ থেকে দাওয়াত পাওয়ার পরেও যদি কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ না করে- তাকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার অনুমতি নেই কারো জন্য।

এ ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষকে বিবেকের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইসলাম গ্রহণে কোন জোর জবরদস্তি নেই’। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৬]

ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা অর্জন, রক্ষা এবং স্বদেশ প্রেমের গুরুত্ব

একটু আগে আমরা উল্লেখ করেছি, এক আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামির স্বীকৃতি দেয় না ইসলাম। স্রষ্টার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ হয়, এমন এমন কারো কোন নির্দেশ পালন করারও অধিকার দেয় না ইসলাম কাউকে। সকল অবস্থায় যে কোন জালিম, জবরদখলকারী, শোষকের নির্যাতন , জবরদখল, এবং শোষণ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত-স্বাধীন করতে ও নির্দেশ দেয় ইসলাম। যেমন রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বা শক্তির এমন আনুগত্যের অনুমতি নেই যদ্বারা স্রষ্টার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ হয়’। [বুখারী ও মুসলিম]

তিনি আরো ইরশাদ করেন, জালিম সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা (প্রতিবাদ করা) উত্তম জিহাদ। [তিরমিযি]

যদিও ইসলাম রক্তপাত, হানাহানি, মারামারি, হত্যা, অথবা ইসলাম গ্রহণে জবরদস্তির অনুমোদন দেয় না, কিন্তু অন্যায় হত্যা, অত্যাচার  অবিচার প্রতিরোধে প্রয়োজনের সময় যুদ্ধ করতেও নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আপন স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বাধীন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে যথাযথ গুরুত্ব দেয় ইসলাম। কেননা, কোনো জুলুমকেই  প্রশ্রয় দেয়না ইসলাম। জালিমদের খপ্পর থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে লড়াই করার তাকিদ দিয়ে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কী হলো! তোমরা কোন লড়াই করছোনা অসহায়, মজলুম, দুর্বল, নারী ও শিশুদের রক্ষা করতে আল্লাহর রাহে? অথচ, তারা আর্তনাদ করে বলছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! (আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত!) এই জালিম ও অত্যাচারী জনপদ থেকে আমাদের মুক্ত করে দাও! তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সহায় শক্তি প্রেরণ করো, (অভিভাবক পাঠাও) আর আমাদের জন্য সাহায্যকারী নিযুক্ত করো।’ [সূরা নিসা, আয়াত ৭৫]

জুলুম, শোষণ মুক্ত, খোদাদ্রোহী মানসিকতা মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার পাশাপাশি এই স্বাধীন কল্যাণ রাষ্ট্র অক্ষুণ্ন রাখারও নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কেননা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা অধিক কঠিন; তাইতো আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন, ‘তোমরা সর্বদাই তোমাদের শত্রুদের প্রতিহত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সাবধান থাকবে। এই প্রস্তুতি দ্বারা তোমরা তোমাদের এবং আল্লাহর দুশমনদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখবে।’ [সূরা আনফাল, আয়াত- ৬০]

রাসূল  সা. এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনে আমরা এই স্বাধীনতা রক্ষা ও ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রিম প্রস্তুতি গ্রহণের নিদর্শন দেখতে পাই। সূরা আহযাবে যা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

হিজরী ৫ম বৎসরে উপনিত হয়েছেন রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম। ইতিপূর্বে মদীনা সনদের মাধ্যমে মদীনা শহর একটি স্বাধীন-নিরাপদ কল্যাণ রাষ্ট্রের অবয়ব ধারণ করেছে। এখানে সুখে-শান্তিতে, সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে বসবাস করছে মুসলিম, (মুহাজির-আনসারী সাহাবী) ইয়াহুদি ও কিছু সংখ্যক মুশরিক সম্প্রদায়। কারো প্রতি কারো কোনো অভিযোগ নেই। সর্বোচ্চ বিধান দাতা ও প্রয়োগকারী খোদ মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

তিনি কোনো অন্যায়, হত্যা, জুলুম, শোষণ অথবা পক্ষপাতকে প্রশ্রয় দেন না। এমন অনাবিল পরিবেশেই বয়ে চলেছে মদীনাবাসী সকল সম্প্রদায়ের জীবন। হঠাৎ করেই মুসলমান বিদ্বেষী কিছু সংখ্যক ইয়াহুদীদের সংকীর্ণ হৃদয়ে হিংসার অনল জ্বলে উঠলো। তারা মক্কায় গিয়ে কট্টরপন্থি মুশরিকদের সাথে আত্মঘাতী চুক্তি করলো। সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে ইসলামের নাম নিশানা মিটিয়ে দেবে, নিরাপদ, শান্ত, স্বাধীন মদীনা রাষ্ট্রকে তাদের দখলে নিয়ে নিবে। মুসলিম জাতিকে নিশ্চিহ্ণ করে সেখানে ইয়াহুদী ও শিরকবাদী শোষণব্যবস্থা কায়েম করবে। সত্যিই, স্বাধীন রাষ্ট্র মদীনার স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হলো। জবরদখলে উন্মত্ত কূটিল সা¤্রাজ্যবাদী ইয়াহুদীরা তাদের মিত্র শক্তি মক্কার মুশরিকদের নিয়ে মদীনার উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়ে গেলো।

এমতাবস্থায় রাসূল সা. তার অনুগত ও আল্লাহর রাহে জান দিতে সর্বদা প্রস্তুত আনছার ও মুহাজির সাহাবিদের সাথে নিয়ে মদীনা রাষ্ট্র রক্ষায়, মদীনার স্বাধীনতা রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন করলেন। মদীনার রাষ্ট্র প্রধান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর সিপাহসালার শত্রু বাহিনীকে হটাতে সম্মুখ যুদ্ধে  অবতীর্ণ হলেন। যথাযথ সমর কৌশল অবলম্বন করলেন। বিশাল সংখ্যার শত্রু বাহিনী যাতে মদীনার ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য দীর্ঘ পরিখা খননের সিদ্ধান্ত নিলেন বিচক্ষণ ও কৌশলী হযরত সালমান ফারসী রা.-এর সুপারিশে। রাহমাতুললিল আলামীন সহ হাজার হাজার সেনা সাহাবী পরিখা খনন করে চলেছেন। একদিকে আগ্রাসী ইয়াহুদী ও মুশরিক শত্রুবাহিনীর হাত থেকে মদীনার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি হেফজতের পবিত্র দায়িত্ব, অন্যদিকে ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ ওয়াক্তিয়া নামায। কোনটিকে প্রাধান্য দেয়া হবে? এক মুহূর্তের জন্য পরিখা খনন বন্ধ করার সুযোগ নেই। যখন তখন শত্রু বাহিনী মদীনার ভিতরে ঢুকে পড়বে, ঢুকে পড়লে তাদের পরাস্ত করা অল্পসংখ্যক মুসলমানের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। আবার নামাযও তো ফরযে আইন, এই উভয় অপরিহার্যতা যখন সর্বোচ্চ মানবতাবাদী এবং আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ গোলাম ও প্রেমিকের সামনে, তখন তিনি আপাতত: মদীনা রাষ্টের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষাকে নামাযের অগ্রে স্থান দিলেন। পরিখা খনন কাজ চলতেই থাকলো অবিরাম গতিতে। উদ্যত শত্রু বাহিনীকে রুখে দিতে ব্যস্ত থাকতে হলো এই মহান কাফেলাকে। যে কারণে চার ওয়াক্ত ফরজ নামাজ কাযা হয়ে গেল। অন্য সব যুদ্ধে যেখানে যুদ্ধ চলাকালেও পালাওয়ারী যোদ্ধাদেরকে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতে আদেশ করা হয়েছে, সেখানে ঈমান ও স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে একাধিক নামাজ কাযা হয়ে যাওয়াকে বরদাশত করেছেন আল্লাহ তায়ালা। এভাবেই তিনি স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, খণ্ড-৭]

উল্লেখ্য, রাসূল সা. ও তার যোগ্য অনুসারী, ত্যাগী সাহাবায়ে কেরাম জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তার মূলে ছিল তাঁদের খাঁটি ঈমানী জযবা এবং অকৃত্রিম স্বদেশ প্রেম। এ যুগের আমাদের মতো তাদের দেশপ্রেমে কোনো ভেজাল ছিল না। তাইতো রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান’ স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ। এর উজ্জ্বল বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই রাসূলের প্রাত্যহিক জীবনে। বুখারী শরীফের এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, দূর-দূরান্তের থেকে ফিরে আসার সময় তৎকালীন স্বাধীন রাষ্ট্র মদীনার সীমা ওহুদ পাহাড়ের ওপর যখন রাসূল সা.-এর দৃষ্টি পড়তো, তখন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠতেন, এ ওহুদ আমাকে ভালোবাসে, আর আমিও তাকে ভালবাসি।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সময় এবং জীবন উৎসর্গ করা ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন অপরিহার্য তেমন মর্যাদারও। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লার রাহে (স্বদেশ হেফাজতের কাজে) একদিনের প্রহরার দায়িত্ব পালন করা মাসভর রোজা ও নামাজ আদায়ের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর। অন্য হাদীসে তিনি ঘোষণা করেছেন, নিজের (অথবা দেশের) সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে জীবন দেয়  সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজের ঈমান ঐতিহ্যের সম্মান রক্ষায় জীবন বিলায় সেও শহীদ। [মুসলিম, তিরমিযী]

লেখকঃ আলেমে-দ্বীন, গ্রন্থকার, সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, সম্পাদক- কাফেলা সাহিত্য মজলিশ, উপদেষ্টা সম্পাদক- মাসিক আল-জান্নাত।

সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম সৃষ্টি মানবজাতি: হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ