Home ইসলাম সংক্ষেপে হজ্ব ও উমরার নিয়মাবলী

সংক্ষেপে হজ্ব ও উমরার নিয়মাবলী

।। মুফতি হাবীবুর রহমান কাসেমী ।।

তামাত্তু হজ্ব: তামাত্তু হজ্ব আদায়কারী হজ্বের সফরে হজ্ব কার্য সম্পাদনের পূর্বে শুধু উমরার নিয়তে ইহরাম বাঁধবেন এবং মক্কা মুকাররমায় পৌঁছে উমরার কাজ সম্পন্ন করে চুল চেঁছে বা কেটে ইহরাম মুক্ত হয়ে যাবেন। অতঃপর এই সফরেই সময়মত (৮ যিলহজ্ব) হজ্বের ইহরাম বেঁধে হজ্বের নির্ধারিত কাজগুলো সম্পন্ন করে কুরবানী দিবেন।

প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ হাজীগণ তামাত্তু হজ্ব করে থাকেন। এতে একই সফরে উমরা ও হজ্ব উভয়টি সম্পাদন করা যায় এবং তুলনামূলক এটি অধিকতর সহজ।

উমরার ফরয দু’টি: ১। উমরার ইহরাম বাঁধা। ২। বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করা।

ইহরাম বাঁধা: ইহরামের মূল বিষয় হচ্ছে, উমরার নিয়্যাতে তালবিয়া পাঠ করা। পুরুষরা দু’টি নতুন বা ধৌত করা সাদা কাপড় নিবেন। একটা কাপড় লুঙ্গির মত করে পরবেন, অন্যটা চাদর হিসাবে ব্যবহার করবেন। আর মহিলারা স্বাভাবিক কাপড় তথা ঢিলেঢালা ফুল হাতার কামিজ, সেলোয়ার ও ওড়না পরবেন। মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম বাঁধার আগে দু’রাকাত নফল নামায পড়বেন। এরপর ওমরার নিয়্যাত করে তালবিয়া পাঠ করবেন।

উমরার নিয়্যাত : আল্লাহুম্মা ইন্নী উরীদুল উমরাতা ফাইয়াসসিরহা-লী ওয়াতাকাব্বালহা মিন্নী।

অর্থ- হে আল্লাহ! আমি উমরার ইচ্ছা করছি, তুমি তা সহজ করো এবং তা কবূল করো। এই নিয়্যাত আরবীতেও করা যায় এবং নিজ ভাষায়ও করা যায়।

তালবিয়া : (১) লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। (২) লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। (৩) ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। (৪) লা-শারীকা লাকা।

বাইতুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করা: অর্থাৎ- পবিত্র অবস্থায় অযূর সাথে তাওয়াফের নিয়্যাত করে বাইতুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকে সাত বার চক্কর দেওয়া।

উমরার ওয়াজিব দু’টি : ১। সাফা-মারওয়ার মাঝে সা’য়ী করা। ২। মাথার চুল মু-ানো বা ছাঁটা।

হজ্বের ফরজ তিনটি : ১। ইহরাম বাঁধা। হজ্বের নিয়্যাতে তালবিয়া পাঠ করা।

২। আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৯ যিলহজ্ব দ্বিপ্রহর হতে পরবর্তী সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত যে কেনো সময় এক মুহূর্তের জন্য হলেও আরাফার ময়দানে অবস্থান করা।

৩। তাওয়াফে যিয়ারত করা। ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদেক থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্বে যে কেনো সময় পবিত্র অবস্থায় অযূর সাথে তাওয়াফের নিয়্যাত করে বাইতুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকে সাত বার চক্কর দেওয়া।

হজ্বের নিয়্যাত:  হে আল্লাহ! আমি হজ্বের ইচ্ছা করছি, তুমি তা সহজ করো এবং কবূল করো।

তালবিয়া: (১) লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। (২) লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। (৩) ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক। (৪) লা-শারীকা লাকা।

অর্থ- আমি হাজির! তোমার দুয়ারে হে আল্লাহ! আমি হাজির! আমি হাজির! তোমার কেনো শরীক নাই। আমি হাজির! নিঃসন্দেহে সকল প্রসংশা ও নিয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও তোমারই জন্য। তোমার কোনো শরীক নেই।

তামাত্তু হজ্বের ওয়াজিব ৬টি : ১। মুজদালিফায় অবস্থান করা। ২। শয়তানকে কংকর মারা। ৩। কুরবানী করা। ৪। মাথার চুল মু-ানো বা ছাঁটা। ৫। সাফা-মারওয়ার মাঝে সা’য়ী করা। ৬। বিদায়ী তাওয়াফ করা।

হজ্বের সুন্নাতসমূহ : ১। ইহরামের সময় গোসল করা অথবা অযূ করা। ২। ইহরামের নিয়্যাত করে দুই রাকাত নামায পড়া। ৩। তাওয়াফের সময় রমল করা তথা প্রথম তিন চক্করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দ্রুতপদে হাঁটা। ৪। ৮, ১০, ১১ ও ১২ তারিখে মিনায় অবস্থান করা। ৫। সূর্য উঠার পর ৯ তারিখে মিনা থেকে আরাফায় রওয়ানা হওয়া। ৬। আরাফায় গোসল করা। ৭। আরাফা থেকে মুযদালিফায় সূর্য ডুবার পর রওয়ানা হওয়া। ৮। মুযদালিফায় অবস্থান করা (রাতে)। ৯। ১২ বা ১৩ যিলহজ্ব কংকর নিক্ষেপের পর ‘মুহাসসাব’ (মুআবাদা) নামক স্থানে অবস্থান করা। ১০। মক্কা শরীফে অবস্থানকালে বেশি বেশি তাওয়াফ করা ও বেশি বেশি তালবিয়া পড়া।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ

১। আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা। অনুরূপভাবে সুগন্ধিযুক্ত তেল, যায়তুন, তিলের তেল, সুগন্ধি সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম ইত্যাদি ব্যবহার করা। ২। স্ত্রী সহবাস করা বা তার সাথে যৌনকর্ম করা, যথা- চুমু দেওয়া ও কামভাব নিয়ে স্পর্শ করা কিংবা তার সামনে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা। ৩। শরীরের কোনো অঙ্গ থেকে কোনো চুল, পশম কাটা বা উপড়ানো এবং উকুন মারা। ৪। নখ কাটা। ৫। ‘ইযখির’ নামক গাছ ব্যতীত নিজ থেকে জন্মায় এমন গাছ কাটা।

৬। বন্যপশু শিকার করা বা শিকারীকে সহযোগিতা করা। ৭। পুরুষের জন্য সেলাই করা কাপড় পরা। ৮। মহিলাদের জন্য চেহারা ঢাকা। তবে গায়রে মাহরামদের সামনে কাপড় পরে এমনভাবে চেহারা ঢেকে নিবে, যাতে কাপড় চেহারার সাথে লেপ্টে না থাকে। (বর্তমানে মেয়েদের জন্য এক জাতীয় ক্যাপ বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, যা পরে বোরকার নেকাব ছেড়ে দিলে নেকাব চেহারা থেকে পৃথক থাকে)।

৯। পুরুষের জন্য এমন জুতা বা মোজা ব্যবহার করা, যা পায়ের পিঠের উঁ”ু হাড্ডি  ঢেকে রাখে। ১০। যে কোনো গোনাহের কাজ করা। বিশেষভাবে ঝগড়া-বিবাদ করা। ১১। ইচ্ছাকৃতভাবে ফল-ফুলের ঘ্রাণ নেওয়া মাকরূহ।

তামাত্তু হজ্বের পদ্ধতি

মক্কা শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার সময় নিজ গৃহে অথবা বিমান বন্দরে কিংবা জেদ্দা পৌঁছার প্রায় এক ঘন্টা পূর্বে বিমানে শুধু উমরার ইহরাম বাঁধা (ফরয)। মক্কা শরীফে পৌঁছে সুবিধামত সময়ে নিয়মানুযায়ী কাবা শরীফের তাওয়াফ করা (ফরয)। অতঃপর সফা মারওয়া সায়ী করা (ওয়াজিব)। এরপর মথার চুল মু-ানো বা ছোট করে হালাল হয়ে যাওয়া। এরপর ইহরামের কাপড় খুলে হালাল অবস্থায় মক্কা অবস্থান করা। অতঃপর ‘হজ্ব আদায়ের পদ্ধতি’ শিরোনামে আঁকা ছক অনুযায়ী র্নিধারিত সময়ে হজ্বের র্কায সম্পাদন করলেই তামাত্তু হজ্ব আদায় হয়ে যাবে।

এক নজরে হজ্ব আদায়ের পদ্ধতি

হজ্বের প্রথম দিন ৮ যিলহজ্ব ৪ কাজ :

১। পূর্বে ইহরাম অবস্থায় না থাকলে হজ্বের ইহরাম বাঁধবেন (ফরয)। ২। মক্কা থেকে মিনায় রওয়ানা হবেন ৮ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর (সুন্নাত)। সূর্যোদয়ের আগে রওয়ানা হওয়া সুন্নাতের খেলাফ। ৩। আজ মিনায় যোহর, আছর, মাগরিব, ইশা ও ফজর মিলে মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবেন (সুন্নাত)। ৪। মিনায় রাত যাপন করবেন (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা)।

হজ্বের দ্বিতীয় দিন ৯ যিলহজ্ব ৬ কাজ :

১। ফজরের নামায মিনায় পরে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। আরাফায় অবস্থান হজ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরয। ৯ যিলহজ্ব সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে পরের দিন সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের কোনো এক মুহূর্তও যদি আরাফায় অবস্থান না হয়, তাহলে হজ্ব হবে না। সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান ওয়াজিব। দোয়া-দুরূদ ও ইস্তেগফারে ব্যস্ত থাকবেন। এক মুহূর্ত সময়ও যেনো বেহুদা না যায়। ২। হানাফী মাযহাব অনুসারে কেবল মসজিদে নামিরার জামাতে শরিক হতে পারলেই যোহর আছর এক সাথে যোহরের সময় পড়বেন। নিজ তাবুতে পড়লে যোহর যোহরের সময় আর আছর আছরের সময় পড়তে হবে।

৩। সূর্যাস্তের পর আরাফায় মাগরিব না পড়ে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ৪। মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও ইশার নামায এক আযানে ও দুই ইক্বামতে ইশা’র ওয়াক্তে আদায় করবেন (ওয়াজিব)। ৫। মুযদালিফায় রাত যাপন করবেন (সুন্নতে মুয়াক্কাদা)। মুযদালিফায় অবস্থান করবেন সুবহে সাদেক থেকে শুরু করে আকাশ পুরোপুরি ফর্সা হওয়া পর্যন্ত (ওয়াজিব)। ৬। আজ ফজরের নামাযের পর থেকে ১৩ যিলহজ্ব আছর নামায পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্তের ফরয নামাযের পর একবার তাকবিরে তাশরীক পড়বেন (ওয়াজিব)।

হজ্বের তৃতীয় দিন ১০ যিলহজ্ব ৭ কাজ :

১। মুযদালিফায় অবস্থান শেষে আকাশ পুরোপুরি ফর্সা হয়ে যাওয়ার পর সূর্যোদয়ের আগে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ২। মিনায় পৌঁছে প্রথমে একমাত্র বড় শয়তানকে ৭টি পাথর মারবেন (ওয়াজিব)। ৩। বড় শয়তানকে পাথর মারার সময় ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদেক থেকে ১১ যিলহজ্ব সুবহে সাদেক পর্যন্ত। তবে সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়েয সময় এবং রাতে পাথর মারা মাকরূহ। তবে দুর্বল ও মহিলাদের জন্য মাকরূহ নয়। ৪। তারপর কুরবানী করবেন। তামাত্তু ও কিরান হজ্ব আদায়কারীদের জন্য ওয়াজিব এবং ইফরাদ হজ্ব আদায়কারীদের জন্য মুস্তাহাব। ৫। অতঃপর মাথার চুল মুন্ডাবেন বা ছাঁটবেন (ওয়াজিব)। পাথর মারা, কুরবানী করা ও মাথা মু-ানো এ কাজগুলোর মাঝে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব। ৬। সম্ভব হলে আজই মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে যিয়ারত (ফরয তাওয়াফ) করবেন। পূর্বে হজ্বের সা’য়ী না করে থাকলে সা’য়ী করবেন (ওয়াজিব)। ৭। তাওয়াফ ও সা’য়ী শেষে মিনায় এসে রাত্রি যাপন করবেন। (সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

হজ্বের চতুর্থ দিন ১২ যিলহজ্ব ৩ কাজ :

১। তাওয়াফে যিয়ারত, কুরবানী ও চুল মু-ানো বা ছাঁটা এসব ১০ তারিখে না করে থাকলে আজ করবেন। ২। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সুবহে সাদেক পর্যন্ত সময়ে মিনায় ছোট, মেঝো ও বড় শয়তানের স্তম্বে ৭টি করে মোট ২১টি পাথর মারবেন (ওয়াজিব)। সূর্য ঢলে যাওয়ার পূর্বে পাথর মারলে আদায় হবে না। সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত হলো পাথর মারার সুন্নাত সময়। সূর্যাস্তের পর মাকরূহ সময়। তবে দুর্বল ও মহিলাদের জন্য মাকরূহ নয়। ৩। মিনায় রাত যাপন করবেন (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা)।

হজ্বের পঞ্চম দিন ১২ যিলহজ্ব ৩ কাজ :

১। তাওয়াফে যিয়ারত ও কুরবানী না করে থাকলে আজ সূর্যাস্তের পূর্বে অবশ্যই করবেন। ২। সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সুবহে সাদেক পর্যন্ত সময়ে মিনায় ছোট, মেঝো ও বড় শয়তানের স্তম্ভে ৭টি করে মোট ২১টি পাথর মারবেন (ওয়াজিব)। সূর্য ঢলে যাওয়ার পূর্বে পাথর মারলে আদায় হবে না। সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া পর্যন্ত হলো পাথর মারার সুন্নাত সময়। সূর্যাস্তের পর মাকরূহ সময়। তবে দুর্বল ও মহিলাদের জন্য মাকরূহ নয়। ৩। আজ সূর্যাস্তের পূর্বে মক্কায় চলে আসা জায়েয। তবে মিনায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে সূর্যাস্তের পর চলে আসা মাকরূহ।

হজ্বের ষষ্ঠ দিন ১৩ যিলহজ্ব ২ কাজ :

১। যদি ১২ তারিখ দিবাগত রাতে সুবহে সাদেক পর্যন্ত কেউ মিনায় অবস্থান করেন, তাহলে তার জন্য ১৩ তারিখ পাথর মারা ওয়াজিব। না মেরে চলে আসলে দম ওয়াজিব হবে। সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের ভিতরে পাথর মারা সুন্নাত। তবে যোহরের আগেও মারা জায়েয আছে। ২। মীকাতের বাহির থেকে আগমনকারী হাজীগণ মক্কা শরীফ ত্যাগ করার পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন (ওয়াজিব)।

লেখক: ফারেগে দারুল উলূম দেওবন্দ, শিক্ষা সচিব ও মুহাদ্দিস- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া উত্তরা, ঢাকা এবং মুহতামিম- দারুস সাহাবা-ফরিদপুর।

মিরপুর ‘আল-ইহসান মাদরাসা ঢাকা’ কর্তৃক আল্লামা কাসেমী সংবর্ধিত!