Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম সৃষ্টি মানবজাতি: হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ

সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম সৃষ্টি মানবজাতি: হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ

এই পৃথিবীর অসংখ্য-অগুনতি সৃষ্টির মাঝে মানবজাতি শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দরতর। অন্যান্য সকল সৃষ্টিকে মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত করেছেন আল্লাহ তাআলা। এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কেবল মানবজাতি থেকেই নবী ও রাসূল নির্বাচিত করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হিসেবেই মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পার্থিব জগদ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সেই অপার্থিব অজানা ঊর্ধ্বলোকে, তাঁর আরশের সংস্পর্শে নিয়ে গেছেন একান্ত ঘনিষ্ঠ মেহমান ও সর্বোচ্চ বন্ধুরূপে। সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এমন অনেক কিছু, যা কোন মাটির মানুষ তো দূরের কথা, নূরের তৈরি ফেরেশতারাও দেখার সুযোগ পায়নি। এই মহানেয়ামত লাভের কারণে, এই অভাবনীয় মর্যাদা প্রাপ্তির বদৌলতে অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে পৌঁছেছেন মানবতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব

উল্লেখ্য, মানবীয় মেধা-মননশীলতা, শিক্ষা-দীক্ষা, বিবেক-বিবেচনা, তাহজীব-তামাদ্দুন, খোদাভীতি তথা মানবীয় অনন্য গুনাবলির অধিকারী হওয়ার কারণেই (যা সবই আল্লাহর দান) মানুষ শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবীয় বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যই মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেছে।

এসব প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

* ‘আমি বনী আদমকে অধিক মর্যাদা দান করেছি। স্থলে এবং সমুদ্রে (নৌপথে) তাদের চলাচলের বাহন প্রদান করেছি। তাদেরকে উন্নত ও পবিত্র রিযিক দান করেছি, আর আমি এই মানবজাতিকে অন্যান্য সৃষ্টির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ [সূরা বনী ইসরাঈল- আয়াত-৭১]

* ‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের সেবার জন্য সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আকাশ বিনির্মাণের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। অতঃপর তাকে সপ্ত স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি সব বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞানী।’ [সূরা বাকারা- আয়াত ২৯]

* ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। (এই বংশ ও গোত্র বড় বিষয় নয় বরং) তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ও সম্মানিত, যে অধিক খোদাভীরু (তাকওয়ার অধিকারী)।’ [সূরা হুজুরাত- আয়াত ১৩]

* রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ, যার চরিত্র অধিক উত্তম। [তিরমিজী, আবু দাউদ]

উল্লিখিত কুরআনে কারীমের আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রতিভাত হলো, স্রষ্টার আনুগত্য, তাকওয়া-পরহেজগারী, মানবীয় উত্তম চরিত্র এবং অন্যান্য মানবীয় গুণ অর্জনের দ্বারাই মানবজাতি শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করতে পারে। পক্ষান্তরে এসব বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলি যদি মানুষ হারিয়ে ফেলে তখন তারা মনুষ্যত্বের গন্ডির বাইরে চলে যায়। এমনকি চতুষ্পদ জীব-জানোয়ারের চেয়েও নিম্নস্তরে পতিত হয়।

উল্লেখ্য, মানবজাতির যে সদস্যবৃন্দ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে তারাই হয় জান্নাতী তথা সর্বোচ্চ সফল। আর যারা শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, তারা হয় নিষ্ফল এবং জাহান্নামী। এই দুই প্রসঙ্গে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-

* ‘যারা (ঈমান আমলের মাধ্যমে) আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করেছে, তারাই সফলকাম। আর যারা (বদ চরিত্রের দ্বারা) নিজেদের কলুষিত করেছে, তারা হয়েছে নিষ্ফল ও ব্যর্থ।’ [সূরা শামস- আয়াত ৯-১০]

* ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে রয়েছে প্রবাহমান প্রস্রবণ। আর এ-ই হলো সর্বোচ্চ সফলতা (তাদের জন্য)।’ [সূরা বুরুজ- আয়াত ১১]

* তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত (জাতি), তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণে, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করার জন্য। এই দায়িত্ব পালন কারীরাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত- ১০৪  )

*এমন বহুসংখ্যক জ্বিন এবং ইনসানকে আমি জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, যাদের অন্তর আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, যাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা দেখে না, যাদের কান আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না। এরা (এই অনুভূতিহীন-রা-) চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো! বরং তাদের চেয়েও অধিক নির্বোধ। [সূরা আরাফ- আয়াত ১৭৯]

*‘আর সেদিনকার কথা স্মরণ করো, যেদিন তুমি দেখবে যে, জান্নাতের দিকে গমনকারী মুমিন নর ও নারীদের সামনে এবং পশ্চাতে বিশেষ নূর চমকাচ্ছে! আর তাদেরকে বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য বিশেষ সুসংবাদ। আর তাহলো, সুখের উদ্যান সমূহ! যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। যেথায় তোমরা থাকবে চিরকাল। আর এ হলো তোমাদের মহাসফলতা।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য (মুনাফিক) দের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

* জান্নাতের গমনপথে পিছে পড়ে থাকা মুনাফিক পুরুষ ও নারীরা মুমিনদের দূর থেকে ডেকে বলবে, তোমরা আমাদের জন্য একটু দাঁড়াও, যাতে আমরা তোমাদের থেকে একটু (নূর) আলো নিতে পারি! তখন তাদের বলা হবে, পিছনে যাও! সেখানে আলোর সন্ধান করো! এরপরও মুনাফিক নারী-পুরুষরা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকবে, আমরা কি দুনিয়াতে তোমাদের প্রতিবেশী ছিলাম না? মুমিনগণ জবাবে বলবে, হ্যাঁ, ছিলে বটে! কিন্তু তোমরা (কপটতার কারণে) নিজেরাই নিজেদের বিপদে ফেলেছ, তোমরা (আমাদের অনিষ্টের) অপেক্ষায় ছিলে, তোমরা সন্দেহ করতে (বিশ্বাস করতে না)।’ [সূরা আল-হাদিদ- ১২-১৪]

উল্লিখিত আয়াতসমূহ আমাদের সামনে ধ্রুবতারার মতো স্পষ্ট করে দেয় যে, ঈমান, নেক আমল সচ্চরিত্র ও অন্যান্য মানবীয় বৈশিষ্ট্যসমূহে বিশিষ্ট হতে পারলেই মানবজাতি শ্রেষ্ঠ মাখলুক হতে পারে অন্যথায় নয়। কেননা, ঈমান ও নেক চরিত্র হারিয়ে ফেললে এই শ্রেষ্ঠ মানব জাতি পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে জাহান্নামের লাকড়িতে পরিণত হয়।

সুন্দরতর অবয়বের অধিকারী মানুষ

মানবজাতির জন্য এ বিষয়টি সুখের, আনন্দের এবং গর্বের যে, আল্লাহ তাআলা এ জাতিকে মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্ব দানের সঙ্গে সঙ্গে দৈহিক সৌন্দর্যের দিক থেকেও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সত্যিই, সর্বোচ্চ সৌন্দর্যের অধিকারী কেবল মানুষ, অন্য কোনো মাখলুক নয়।

সূরায়ে তীনে বিষয়টি মহান রাব্বুল আলামীন শপথের মাধ্যমে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘শপথ ডুমুর ফল ও যয়তুনের। শপথ সিনীন পর্বতের এবং এই নিরাপদ শহরের। নিশ্চয়ই মানুষকে আমি সৃষ্টি করেছি সর্বসুন্দর গঠনে, অবয়বে, আকৃতিতে! অতঃপর এক সময় (বার্ধক্যে) আমি তাদের হীন (সৌন্দর্যহীন দুর্বল) করে দেই। তবে যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে তারা ব্যতিক্রম। (পরিণতির দিক থেকে তারা হেয় হয় না) তাদের জন্য রয়েছে অশেষ প্রতিদান। [সূরা তীন : আয়াত ১-৬]

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের দেহের মাঝে (দৈহিক অঙ্গ সৌষ্ঠবের মাঝে) রয়েছে আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন, তোমরা (মানুষেরা) কি তা দেখতে পাও না!’ [সূরা যারিয়াত]

একটু খেয়াল করলেই আমরা কুরআনে কারীমের উল্লিখিত বর্ণনার বাস্তবতা বুঝতে পারবো। বুঝতে পারবো মানুষ ও অমানুষের পার্থক্য।

মূলতই, আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের চেহারা এবং দৈহিক গঠন, আকৃতি-প্রকৃতি অনন্য সুন্দর! এমন সৌন্দর্য অন্য কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ তাআলা দান করেননি। মানুষের চোখ, কান, নাক, ঠোঁট, হাত, পা, আঙ্গুল, চুল, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়া এই সবকিছু এমন নিপুণতা ও শৈল্পিক অনন্যতায় গঠিত এবং এমন নিখুঁত ও সামঞ্জস্যে উপস্থাপিত যে, অন্য কোনো সৃষ্টির মাঝে এর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই নিপুণতা, এই নিখুঁত কারিগরি বিচক্ষণতা কেবল আল্লাহরই ছিফাত! আর কারো নয়। বুখারী এবং মুসলিম শরীফে বর্ণিত এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা আদম আ.-কে তাঁর নিজের সূরতে (নিজের সৃষ্ট নিপুণতার সৌন্দর্য দিয়ে) সৃষ্টি করেছেন। [বুখারী ও মুসলিম]

‘মানুষ চন্দ্রের চেয়েও বেশি সুন্দর’ -একটি ঐতিহাসিক ফতওয়া

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. এবং আরো দু-একজন সাহাবী রাসূল সা. কে চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রেমিকার সৌন্দর্যে আত্মহারা, অতিমুগ্ধ কোনো কোনো প্রেমিকও তার প্রিয়তমাকে চাঁদের চেয়েও সুন্দর বলে আত্মসুখ লাভ করে থাকেন! এদের কথা কি অতিরঞ্জিত? অথবা ক্ষণিকের মোহের বহিঃপ্রকাশ মাত্র? এমনটা বলা কি ঠিক? শরীয়ত কী বলে? এমন বললে তা কি মিথ্যা হবে? চলুন দেখা যাক, বিজ্ঞ ইমাম বা ফকিহগণ কী বলেন? কুরআনে কারীমে এর ফায়সালা আছে কি না!

বিদগ্ধ মুহাদ্দিস ও মুফাচ্ছির ইমাম কুরতবী (রাহ.) এ বিষয়ে ফায়সালা হয়ে যায় এমন একটি বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করে লিখেছেন, খলীফা আবু জাফরের একজন বিশেষ সভাসদ ছিলেন ঈসা ইবনে মুসা হাশেমী। ঈসা হাশেমী তার স্ত্রীকে খুব বেশি ভালবাসতেন। এই অত্যধিক ভালবাসার ফলেই এক জোছনাময় রাতে চাঁদের আলোর মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর সময় হঠাৎ বলে ফেললেন, যদি তুমি চাঁদের চেয়েও অধিক সুন্দরী না হও তাহলে তুমি তিন তালাক। ‘তিন তালাক’ শব্দ শুনেই মুসা হাশেমীর স্ত্রী অন্দরে চলে গেলেন এবং বললেন, আপনিতো আমাকে তালাক দিয়ে দিয়েছেন! হাশেমী পত্নীর এ কথা জানা ছিলো যে, হাসি তামাশার ছলে তালাক দিলেও তা কার্যকর হয়ে যায়। ঈসা হাশেমী চরম অস্থিরতার মাঝে রাত পার করে সকাল বেলা খলীফা জাফর মনসূরের কাছে ঘটনা খুলে বললেন। খলীফা শহরের অভিজ্ঞ এবং প্রসিদ্ধ মুফতিগণকে ডেকে ঘটে যাওয়া বিষয়ে ফতওয়া চাইলেন। একজন ছাড়া সকল মুফতি ফতওয়া দিলেন, ঈসা হাশেমীর স্ত্রী তিন তালাকপ্রাপ্তা হয়েছে। কেননা তাদের মতে মানুষ চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর হতে পারে না।

হ্যাঁ, সত্যিই তো, ঈসা হাশেমী বলেছে, তার স্ত্রী যদি চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দরী না হয়, তাহলে তার প্রতি তিন তালাক। এখন হাশেমীর স্ত্রী যেহেতু চাঁদের চেয়ে বেশি সুন্দর না, বরং চাঁদই বেশি সুন্দর, সুতরাং হাশেমীর শর্ত পাওয়া যাওয়ায় স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হয়ে গেছে।

এই ফতওয়া যখন হাশেমীকে বিমর্ষ করে দিচ্ছিলো, তখন ইমামে আজম ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর এক শিষ্য যিনি ঐ মজলিসে এককোণে চুপচাপ বসেছিলেন, তাঁকে খলীফা আবু জা’ফর বললেন, মুফতী সাহেব আপনি চুপচাপ কেন? আপনি আপনার রায় পেশ করুন! এবার হানাফী (ইমাম) মুফতি সাহেব, বিসমিল্লাহ সহ সূরা তীন তেলাওয়াত করলেন, অতঃপর খলিফাকে সম্বোধন করে বললেন, আমিরুল মুমিনীন! সূরা তীনে আল্লাহ তাআলা কয়েকটি বিষয়ে কছম খেয়ে বলেছেন, মানুষকে তিনি (আহসান) সবচেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ছাড়া অন্য আর কিছু মানুষের চেয়ে অধিক সুন্দর নয়। প্রত্যেক মানুষই অন্যসব সৃষ্টি থেকে অধিক সুন্দর। আল্লাহর এই চিরন্তন বাণী হিসেবে হাশেমী পতœীও চাঁদের চেয়ে অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী। উল্লিখিত আয়াতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট!

হানাফী মুফতি সাহেবের এতটুকু কথার পর খলীফা রায় ঘোষণা করে বললেন, ‘সূরা তীনের বর্ণনা অনুযায়ী হাশেমীর স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হয়নি। উপস্থিত অন্য মুফতিগণ এই বিশ্লেষণী ফতওয়ায় অবাক হয়ে গেলেন।’ সুতরাং তারা কেউ এই রায়ের বিরোধিতা করলেন না।

প্রমাণিত হলো, মানুষ শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দরতর সৃষ্টি। এই মানবজাতি যদি তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মানবীয় গুণাবলি, স্রষ্টার আনুগত্যমূলক জীবনাচার নিজেদের মাঝে ধরে রাখে আর এর বিপরীতমুখী জীবন, বিশ্বাস ও কর্মকা- (পশুত্ব) বর্জন করে চলতে পারে, তাহলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য বিকশিত হতে থাকবে। যার শ্রেষ্ঠ প্রতিদান হিসেবে তারা লাভ করবে চিরস্থায়ী সুখোদ্যান জান্নাতুন নাঈম। [মাআরিফুল কুরআন, ৮ম খ.]

ইসলামী বিপ্লবের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উল্লিখিত বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তার অমর কবিতা ওমর ফারূক-এ।

ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা তাঁর খেলাফত যূগে এক দীর্ঘ সফরকালে পথ চলতে গিয়ে একসময় তাঁর সেবককে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিজে নিচে থেকে রশি টেনে টেনে হেঁটে যে মহা মানবতার দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন তাকে চাঁদের সাথে তুলনা করে কবি লিখেছেন-

রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, ‘ওমর! ওরে
করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।’
কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসূলে ভাই,
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই
আরাম সুখের, মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা,
ইসলাম বলে সকলে সমান কে বড় ক্ষুদ্র কে-বা।
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে ওমর ধরিলো রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী!
(ওমর ফারুক -কাজী নজরুল ইসলাম)

উপসংহার: এতক্ষণ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতর মানব জাতির যে পরিচিতি, যে বিবরণ আমরা পেশ করলাম বর্তমান বিশ্ব, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের মানুষের সাথে যদি তা মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কী দেখতে পাবো? ইয়াহুদী-খৃষ্টান, হিন্দু-বৌদ্ধ জাতিতো তাদের স্বেচ্ছাচারী চিন্তা-দর্শন ও কুরআন-হাদীস বিরোধী লাইফস্টাইলের কারণে পশুত্বকেই উন্নত জীবন মনে করে। যাদেরকে সূরা ফাতিহায় আল্লাহ তাআলা ‘গজবপ্রাপ্ত’ এবং ‘পথভ্রষ্ট’ বলেছেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলার এককত্বে, মুহাম্মাদ (সা.)এর রিছালাতে এবং মৃত্যুর পরের জীবন আখেরাতে যারা বিশ্বাসী, সেই তারা (আমরা) শ্রেষ্ঠ মানবজাতির পরিচায়ক আমল-আখলাকের উপরে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত? মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো থেকে শুরু করে অনুন্নত মুসলিম দেশগুলোতে মানবতা তথা মনুষ্যত্বের অবস্থা কেমন?

আমানতের খেয়ানত, ধোঁকা, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, কপটতা, মিথ্যাবাদীতা, মাদকাসক্তি, পরকিয়া, যেনা-ব্যভিচার, অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, গুম-খুন, চুরি-ডাকাতি, শিশু ও নারী নির্যাতন, স্বার্থান্ধতা, নোংরামি, ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রাস, মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, খামখেয়ালীপনা, জবরদস্তি ক্ষমতা ধরে রাখা, সুদ-ঘুষকে আইনে পরিণত করা, দেশ ও জাতির শত্রু বা আগ্রাসী তৎপরতায় জড়িতদের সাথে গোলামী চুক্তি করা, ইসলামের নামে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, গরীব-মিছকিনের হক আত্মসাত করা, রাজতন্ত্র অথবা সেনাতন্ত্র চিরস্থায়ী করার স্বার্থে নিরপরাধ দল বা ব্যক্তিকে টার্গেট করা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে পাইকারি হারে হত্যা করা অথবা হত্যার জন্য মোটা অংকের অর্থ ঢালা, যা কেবল অবৈধ ক্ষমতাটাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য অথবা ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র বিলাসী স্বার্থ রক্ষা করার জন্য, অথবা নিজেদের পশুত্ব ও দালালী ঢেকে রাখার জন্য, এসব কি শ্রেষ্ঠ মানবজাতির পরিচয় হতে পারে? পারে না!

আজকাল দৈনিক পত্রিকায়, টিভিতে, ফেইসবুকে অন্যান্য আধুনিক মিডিয়ায় দৃষ্টি দিলে মানব নামী পশুদের যে ভয়াবহ বর্বরতা অহরহ দৃষ্টিগোচর হয় তা অবশ্যই সুন্দর মানুষের পরিচয় নয়। এরাতো মানুষই নয়। এরা চতুস্পদ জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট। এই মানবতাহীন কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আমরা কখনই মানবজাতি বলে আখ্যায়িত হতে পারবো না। কেবল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের মাঝেই রয়েছে শ্রেষ্ঠ ও সুন্দর মানবজাতি হিসেবে গড়ে ওঠার পথনির্দেশ। প্রমাণিত সত্য ও সুন্দরই কেবল মানবতার রক্ষাকবচ হতে পারে।

সুতরাং, আসুন, আমরা সবধরণের স্বার্থপরতা, ভুল-চুক, গুনাহ খাতা, অন্যায়-অপরাধ, অত্যাচার, মিথ্যা, প্রতারণা, পাশবিকতা বর্জন করে কুরআনে বর্ণিত শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতর জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলি। আমরা প্রত্যেকে মন-মননে, রুচিবোধ ও আচরণে সুন্দর হতে পারলে নিমিষেই সমাজ ও রাষ্ট্র সুন্দর হয়ে যাবে!

এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় ইসলামে বিশ্বাসী ও সদাচারী, কেবল তারাই বিশ্ববাসীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত। (সূরা বাইয়্যিনাহ)।

লেখকঃ বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, গ্রন্থকার, সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, সম্পাদক- কাফেলা সাহিত্য মজলিশ, উপদেষ্টা সম্পাদক- মাসিক আল-জান্নাত।