Home গল্প-উপন্যাস প্রাক্তন প্রার্থনা: মাহদী হাসান মিরাজ

প্রাক্তন প্রার্থনা: মাহদী হাসান মিরাজ

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। বিছানায় বসে আছি। শীতের সকাল। অনুভূতি একটু ভিন্ন। ইউরিনের আদ্রতার খোঁজ না পেয়ে মনে মনে ভীষণ পুলকিত। বাহ্! বেঁচে গেলাম। মায়ের বকুনি শোনা হবে না আজ।
দু’হাতে চোখ কচলিয়ে বসে রইলাম আনমনে। চাকুম চাকুম শব্দ মুখের ভেতর।
রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা খোশবু আমায় মাতাল করে তোলল। মায়ের হাতে বানানো পিঠার মোহে ব্যকুল বদন লাফিয়ে খাট ছেড়ে বেসিনে হাজির।
বেসিনের আয়নায় নিজের মুখ দেখার মজাই আলাদা। কিন্তু আমায় তো দেখা যাবে না। মোড়ার উপর দু’পায়ের ভর দেয়া ব্যতীত।
আম্মু ডেকেই চলছে, কিরে খেতে আসবি না? ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে সব।
: এই তো আসছি।
এক দৌঁড়ে রান্না ঘরে। কাঠের পিড়িতে বসে পড়লাম।
– ওরে আমার লক্ষী ছেলে! এত্তো দেরী করলে চলবে, হু!
: আম্মু একটা কথা বলি?
– হু বল।
: বীর গর্জনে বলে উঠলাম, টেনে টেনে,,, আ,,,,জ তোমার ছে,,,লে বিছানায়,,,, ইউরিনের প্রভাব ফেলেনি। হা হা হা।
– বাব্বাহ! আমার খোকা আর কোনদিন এমন কাজ করবে না। করতেই পারে না। এবার খুশি তো?
: অনেকগুলো খুশি। হি হি হি।
আম্মু ঠোঁটের কোণে এক চিলতি হাসির রেখা টেনে আমার মুখে পুরে দিলেন ঝোল মাখা পিঠা।

সময়টা ছিল ২০০২ সাল। আমি মদীনাতুল উলূমে নূরাণী বিভাগের ২য় শ্রেণীতে পড়ি। ছড়ায় ছড়ায় মজার পড়ায় মেতে থাকতাম সারা বেলা।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গায়ের জোরে সুর তুলে খুব মজা করে পড়ছি।
“আমরা নবীজির উম্মাত,
পালন করবো সুন্নাত”।
আম্মু আমার ছোট ছোট পাঞ্জাবী ধুয়ে শুকাতে এসে আমার এমন অবস্থা দেখে..
– এ্যাই, ভেতরে এসো।
“এসে আমি বসে গেলাম তোমার কোলে,
বলো আমায় দেবে কিনা একটু দোলে”।
– হুমম, দেবো। তবে শর্ত আছে।
: কি শর্ত আম্মু?
– বলো তো, আজ কী বার?
: ওহ হো,,, তাই? উঁহুহ, বলবো না।
– এ্যাই,,, কেনো?
: আমারো শর্ত আছে।
– ওলে আমার খোকা বাবু,,! তোমার কি এমন শর্ত শোনি?
: বলছি, আজ জুমাবার। আর আমি চাই আজ সালাতুল জুমআ’ পড়তে মসজিদে যাব।
– আচ্ছা বাবা যেও। কিন্তু,,,,,,,,!
: উঁহুহ,, কোন কিন্তু চলবে না। পাশের ফ্ল্যাটের মুকিত আংকেলের সাথে যাবো।
আচ্ছা আম্মু,,, তুমি কি জানো জুমাবারে কয়টি সুন্নাত আছে?
– নাতো বাবা। তুমি বললে আমি ঠিক শেখে নেব।
: শোনো। তবে শোনাতে হবে কিন্তু,,, হি হি হি।
– হুম শোনাবো। বলো বলো।
: জুমাবারে এগারটি সুন্নাত-

১) ভালোভাবে গোসল করা।
২) সকাল সকাল মসজিদে যাওয়া।
৩) পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া।
৪) ইমামের নিকট বসা।
৫) মনযোগ দিয়ে খুতবা শোনা।
৬) অহেতুক কাজ এবং কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা।
৭) জুমার দিন ফজর নামাযের প্রথম রাকাতে “সূরায়ে সিজদাহ” এবং দ্বিতীয় রাকাতে “সূরায়ে দাহর” তিলাওয়াত করা।
৮) জুমআ’র নামাযে প্রথম রাকাতে “সূরায়ে আ’লা” এবং দ্বিতীয় রাকাতে “সূরায়ে গাশিয়াহ” তিলাওয়াত করা।
৯) সালাতুল জুমআ’র আগে বা পরে “সূরায়ে কাহাফ” তিলাওয়াত করা।
১০) জুমআ’র দিন বেশি বেশি দরূদ পড়া।
১১) জুমআ’র দিন জুমআ’র সালাত আদায় করে খানা খাওয়া।
: শোনলে তো?!
– মাশা-আল্লাহ,,,,,ওলে আমার খোকা বাবু,,, সুন্নাত শেখেছে।
: উহু,,,, বলো তুমি কয়টা মনে রেখেছো? হি হি হি।
ও আম্মু বলো না আমায় মসজিদে যেতে দিবা?
আম্মু মুখে কিছু না বলে,,, হু,, বলে উত্তর দেয়।
মুহূর্তেই আম্মুর হাসিমাখা মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। জানলার কাঁচের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ গাছে দৃষ্টি আবদ্ধ করে কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন জানি না।
– জানিস বাবা, আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে তোকে মসজিদে নিয়ে যেতেন। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, আমার ছেলেকে আমি কুরআনে হাফেজ বানাবো। দ্বীনের জন্য তাকে উৎসর্গ করবো।
আম্মু আঁচলে চোখজোড়া মুছে নিলেন।
: আম্মু তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না? বাবাকে ছেড়ে থাকতে?
– না ! তুই তো আছিস। তুই আমার সব। কোন কষ্ট নেই আমার। আংকেলের সাথে গিয়ে তোর বাবার বাড়ি দেখে আসিস। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুক। আমীন।
: আমীন।

ইমাম সাহেব খুৎবা শেষে নিয়ত বেঁধে মধুমাখা স্বরে তিলাওয়াত শুরু করলেন। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শ্রবণে মশগুল। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, আমিও এমন শ্রুতিমধুর তিলাওয়াত শেখবো, ইনশাআল্লাহ।
রুকু শেষে সবাই মাথা নুয়ে সিজদায় লুটে পড়লেন জমিনে নাক কপাল বিছিয়ে। আমি ছোট মানুষ সিজদায় গেলাম একটু পরে। সামনের কাতারে থাকা মর্ডাণ কাকুর প্যান্টের অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে দিলাম। হিহিহ,,,,। হো হো হো।
দেখা যাচ্ছে সব, পেছনের চোখ। হি হি।
ইমাম সাহেব সালাম ফেরালেন। আংকেল বললেন, বাবু হেসেছো কেনো?
মসজিদে হাসতে মানা। মসজিদে হাসাহাসি করলে ফেরেশতারা বদ দোয়া দিবেন।
তাছাড়া তোমার নামাযও হয়নি।
: কেনো হয়নি আংকেল?
– অট্টহাসি দিলে নামায ভেঙে যায়।
: তাহলেতো,,!
– কি তাহলে?
: এই কাকুটার নামাযও হয়নি।
আংকেল কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেনো? তিনি তো হাসেননি।
: হাসেনি তাতে কি? উস্তাদজী বলেছেন, নামাযে সতর খুলে যাওয়া নামায ভঙ্গের কারণ।
– ওহ্,,,তাই।
: জ্বি।

– এবার যাওয়া যাক

: চলুন

মসজিদ থেকে বের হবার সুন্নাত পালন করেছি আঙ্গুলে গুণে পাঁচটি। আচ্ছা আংকেল বাবার কবর বাড়ি যাবে না?

– হ্যাঁ, যাবো।
মসজিদের বাম পাশেই কাশেমপুর কবরস্থান।
লোহার শিকে বানানো দরজা। চারপাশ দেয়ালে ঘেরা। পুরো দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সুপারিগাছের সারি। গেইট থেকে উত্তর কর্ণারের শেষ পর্যন্ত কংক্রিটের ঢালাই করা রাস্তা। রাস্তার দু’দিকে দশটি করে বিশটি কবর। পুরো করবস্থানে পাঁচ/ ছ’শ কবর। সুনসান নিরবতা। অনেকে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে। কেউ বা দু’ হাত উঁচিয়ে দোয়ায় মগ্ন। কবর বাড়ির এ শীতল পরিবেশে শরীরে অনুভূত হলো ভিন্ন এক অনুভূতি। আমরা উত্তর কর্ণারের সোজা রাস্তায় এগোলাম কিছু দূর।
নীরবতা ভেঙে আংকেল বললেন, মিরাজ দেখো,,,,,,,! এই তোমার বাবার বাড়ি।
বাবাকে সালাম দাও।
আনমনে তাকিয়ে ছিলাম মাটি চাপা দেয়া মানুষটার দিকে। যেন কিছু বলতে চাইছে। আমায় দেখে পরমানন্দে হাসছে।
আমি প্রাণভরে শুধু দেখেই চলছি।
আংকেল ঘোর ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, কিছুতো পড়ো… দাঁড়িয়ে না থেকে।
ক্লাসে যে কয়টা সূরা মুখস্ত করেছি সবগুলো তিলাওয়াত করলাম।
: আংকেল একটা কথা বলি?
– হুম বলো।
: উস্তাদজী বলেছেন, “জুমআ’র দিন বাবা-মা কোন একজনের কবর যিয়ারত করলে তার গুনাহ মাফের ও নেককারের ঘোষণা করা হয়। আমার বাবাকে মাফ করবে তো?
– তুমি দু’ হাত তুলে দোয়া করো। আল্লাহ তোমার বাবাকে মাফ করে দেবেন, ইনশাআল্লাহ।
আমি কচি দু’হাতের তালু বুক বরাবর উঁচিয়ে মাঝখানে একটু ফাঁকা রেখে দরুদে ইব্রাহিম পড়ে নিলাম।
উস্তাদজী একদিন ক্লাসে বলেছেন, দোয়ায় আল্লাহর প্রশংসা, রাসুলের উপর দরূদ প্রেরণ করে নিজের মনের ব্যকুলতা, দূর্বলতা, চাওয়া পাওয়া সব প্রভুর দরবারে বলবে। তারপর দরূদ পড়ে শেষ করবে।

তাই প্রভুকে নেত্রজলে গাল ভিজিয়ে বললাম,
হে প্রভু! “তোমাতে সঁপেছি প্রাণাধিক প্রিয় জনক,
প্রাসারিত স্বর্গ দুয়ার নিভুক তব নরক।”

ইয়া রব!
“ভাঙা দিল্ যাচে- রাব্বির হামহুমা,
ব্যকুলা প্রাণ তব আশে  রাহনুমা।”

 

– মাহদী হাসান মিরাজ