Home বুক রিভউ বুক রিভিউ: “নতুন নেপাল”

বুক রিভিউ: “নতুন নেপাল”

।। পিনাকী ভট্টাচার্য ।।

‘নতুন নেপাল’

লেখক- গৌতম দাস

প্রকাশক-  একাদেমিয়া প্রকাশনী

পরিবেশক- সূচীপত্র, ৩৮/২-ক বাংলাবাজার, ঢাকা।

অনলাইন পরিবেশক- www.boibajar.com  মোবাইল- ০১৭১৭-৭১৫৬৭১

আমাদের ঘরের কাছেই নেপালে এক দারুণ রাজনৈতিক সংগ্রামের বিজয় হয়েছে এবং রাজতন্ত্র থেকে নতুন রিপাবলিক গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কনস্টিটিউশন গৃহিত হবার ঘোষণা অর্থাৎ রাষ্ট্রগঠন সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই পুরো লড়াই আর পুনর্গঠনের কাজটা হয়েছে মূলত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে। আর এই কমিউনিস্ট পার্টিও খুব নবীন। ১৯৯৪ সালে গঠিত হয় পুষ্প কমল দাহালের নেতৃত্বে এই দল। এই সমগ্র ঘটনা অভাবনীয় এবং তার তাৎপর্য অপরিসীম। আমাদের মতো দেশে যেখানে বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়, রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরে পুনর্গঠনের কাজটা কখনো করতে পারি না সেখানে নেপালের রাজনৈতিক ঘটনাবলী একটা দারুণ শিক্ষা হয়ে থাকতে পারে।

নেপালের রাজনীতি সম্পর্কে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তা হচ্ছে ভারতের সাথে সম্পর্ক। ভারত নেপালের ল্যান্ড লকড ভৌগলিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে একটা উপনিবেশিক ধরনের অধীনতা মূলক সম্পর্ক রেখে চলেছে। একদিকে রাজতন্ত্র আরেকদিকে ভারতের খবরদারী দুটোই অস্বীকার ও পরাজিত করার মধ্যে দিয়ে মূলত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে একটা আধুনিক রিপাবলিক গড়ার যে লড়াই তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। আবার এই কমিউনিস্টরা আমাদের দেশের মতো সুশীল নয়, তাঁরা রীতিমতো সশস্ত্র লড়াই করেছে। শুধু সশস্ত্র লড়াই নয় নানা সময়ে সে শান্তিপূর্ণ লড়াই ও করেছে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট জামানার সমাপ্তি হয়েছে যেই সময়ে, তখন আবার সশস্ত্র কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক বিজয় কীভাবে হলো- তা পর্যালোচনা করে শিক্ষা নেবার প্রয়োজন আছে।

আমরাও তিনবার বিজয়ী হয়েছি, একবার পাকিস্তান হাসিলের লড়াই করে। তাতে কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসক শুধু বদলেছে, রাষ্ট্র গঠন করা হয়নি। ব্রিটিশ শাসনের যে কাঠামো তার উপরেই পাকিস্তানি শাসন চেপে বসেছে। আক্ষরিক অর্থে শাসকের পরিবর্তন হয়েছে আর কিছুই বদলায়নি। একই কাজ হয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে। আমরা সংবিধান সভা করে সংবিধান প্রণয়ন করতে পারিনি। ফলে সংবিধানে ঢুকে আছে এমন বিষয় যা আধুনিক রাষ্ট্রের বা রিপাবলিকের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার আঁধার হওয়ার বদলে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের উন্মেষ হওয়াই নিশ্চিত করেছে। ১৯৯০ এর গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিজয়ী হবার পরে যে নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ছিল সেটাও উপেক্ষিত হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক পরিপক্কতার অভাবের কারণে।

তাই বলা চলে আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন – এই কাজ এই অঞ্চলে হয়নি। সবখানে পুরাণ লিগাসি জামা টেনে ধরে রেখেছে। তাই সব দেশেই রাষ্ট্রগঠন হয়েছে অসম্পূর্ণতা রেখে বা ফাঁকি দিয়ে। বেশির ভাগই দেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হয়েছে না কোন সশস্ত্র বিপ্লব, অথবা না কোনো গণঅভ্যুত্থানের ঘটিয়ে। বরং, ভারত বা পাকিস্তানের বেলায় ১৯৪৭ সালে এটা হয়েছে কলোনি শাসকের হাত ধরে এক টেবিলে বসে আপোষে ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে। এই আপোষ ধারার সবচেয়ে অসুবিধার দিক হলো, এতে নতুন রাষ্ট্রকে পুরানো রাষ্ট্রের বহু দায় আর নানান আবর্জনা বয়ে বেড়াতে হয়। যা নতুন রাষ্ট্রের ভেতর ঢুকে যায়। এই আবর্জনাগুলোকে রেডিক্যালি ঝেটিয়ে বিদায় করা যায় না। নেপাল শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামেই বিজয়ী হয়নি, তারা একটা আধুনিক রিপাবলিক গঠনের কাজটাও খুব দক্ষতার সাথে শুরু করেছে। আর এর সাথেই তারা ফয়সালা করছে ভারতের সাথে তাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমস্যার মোকাবেলা আর সশস্ত্র রাজনীতি করেও পশ্চিমের আস্থা অর্জনের কাজটা।

গৌতম দাস বইটিতে সেই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের জট খুলে খুলে নেপালের এই রাজনৈতিক সংগ্রামের একটা স্কলারলি পর্যালোচনা করেছেন যা এই অঞ্চলের রাজনীতিতে যারা আগ্রহী তাদের ক্ষুধা তো মেটাবেই পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীদের রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটা প্র্যাক্টিক্যাল গাইড হতে পারে।