Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন আধুনিকতার দর্শন ও সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম

আধুনিকতার দর্শন ও সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম

।। আরিফুল ইসলাম শিকদার ।।

আধুনিকতা নিয়ে আলাপ তুললে কেউ কেউ রাগান্বিত হন, কেউ আনন্দিত হন। আধুনিকতার বিপক্ষের লোকদের কথা হল, ওটা উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা। আর পক্ষের লোকের কথা হল, ওটা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

অনেকে আধুনিকতার ইসলামী বয়ানও হাজির করে ফেলেন। বলেন, ইসলাম আধুনিক। আমি ছোট্ট করে বলি, ইসলাম যদি আধুনিকই হবে তবে আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে ম্যাচ করল কীভাবে? আর যদি তখন ম্যাচ করে আবার এখনো ম্যাচ করে তবে ইসলাম আধুনিক হয় কি করে? বরং ইসলাম তো শ্বাসত, চিরায়ত।

ইসলামের মৌলিক বিষয় তাওহীদই দেখুন। এটা কি আধুনিক? নাকি শাশ্বত , চিরায়ত?

আধুনিকতার দাবি মূলতঃ অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় বিষয়টি বর্ণনা হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ” আর কেউ যখন তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এমন বলতে পারি, এ তো পূর্ববর্তীদের ইতিকথা ছাড়া আর কিছুই নয়”। ( সূরা আনফাল- ৩১)।

পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে, (কাফিররা বলে) ” আতীতে আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বপূরুষদের এই ওয়াদাই দেয়া হয়েছে। এটা তো পূর্ববর্তীদের ইতিকথা ছাড়া আর কিছুই নয়”। ( সূরা মুমিনুন- ৮৩)।

আরো ইরশাদ হচ্ছে, ” যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমাদের পালনকর্তা কি নাযিল করেছেন ? তারা (কাফিররা) বলে, পূর্ববর্তীদের কিসসা- কাহিনী”। ( সূরা নাহল- ২৪)।

যাহোক, কুরআনের ব্যাখ্যাকাররা আশা করি আরো ভালো বলবেন। কিন্তু আয়াতগুলোতে সুস্পষ্ট যে, কাফিররাই সবসময় বিশ্বাসীদের পুরাতন যামানার সাথে সম্পৃক্ত করেছে এবং নিজেদের আধুনিক দাবি করেছে।

অতএব, আধুনিকতার দাবি একেবারে নতুন কিছু নয়। সব যামানায়ই কাফিররা নিজেদের শক্তি সমর্থের উপর ভরসা করে , নিজেদের প্রবৃত্তি অনুসারে জীবন-যাপন করতে চেয়েছে এবং যারা তাদের ধর্মের কথা শুনিয়েছে তাদেরকে তারা পুরাতন যামানার তথা আধুনিক নয় বলে উপহাস করেছে।

কিন্তু নবীগণ কখনোই এর বিপরীতে বলেননি যে, তারা পুরাতনের সাথে সম্পর্কিত নন। বরং ধর্মের বিধানকে চিরায়ত হিসাবে পেশ করেছেন।

এতগুলো কথা বলার কারণ এটা নয় যে, আমি ইসলাম বিশ্লেষণ করছি। বরং আমি বর্তমান সমাজ অবস্থা বিশ্লেষণে আগ্রহী। এবং তারই অনুষঙ্গ হিসাবে ধর্ম এসেছে। এবং এই জনপদের অধিকাংশের বাসিন্দাদের ধর্ম এবং আমার নিজস্ব ধর্ম থেকে আমি উদ্ধৃতি দিয়েছি।

পর্ব দুই : বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার গল্প

এই গল্পের সূচনা মূলতঃ ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ইউরোপে। চার্চের ব্যাপক অত্যাচারের ফলে অতিষ্ঠ জনগণ রাষ্ট্র এবং ধর্মকে পৃথক করে নেয়। উৎপত্তি হয় সেক্যুলার রাষ্ট্রের। ব্যাপকভাবে চর্চা হতে থাকে, ধর্ম এবং রাষ্ট্র পৃথক।

যাই হোক, ইউরোপ নিয়ে আলোচনা না করে আমরা ভারতবর্ষের দিকে আসি, তাহলে আমরা আমাদের আধুনিকতার সংঘাতের গল্পটা বুঝতে পারব। তবে আলাপ যথসম্ভব সংক্ষেপ করার চেষ্টা করব।

যেই সময় ইউরোপে ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করা হয়, তখন ভারতবর্ষে চলছে ইউরোপের একটি অংশ বৃটিশদের রাজত্ব। প্রথমতঃ বৃটিশরা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধংস করে দেয়, বিশেষতঃ মুসলমানদের। কিন্তু তখন পর্যন্ত মুসলমানদের বিচার কার্য ইসলামী ফিক্বাহ থেকেই চলত। কিন্তু ধীরে ধীরে কিছু আইন – কানুনে তারা হাত দেয় এবং একই সাথে এদেশীয় হিন্দু- মুসলিমরা বৃটিশের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে। বিলেত গমন করে অধিকাংশের ধ্যান- ধারণা বিলাতি হয়ে যায়। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইসব বিলেতী শিক্ষিতরাই হয়ে পড়েন দেশের হর্তা-কর্তা। তাই দেশ ইসলামের নামের উপর স্বাধীন হলেও মূলতঃ বৃটিশ ধ্যান ধারনার গোলাম থেকে যায়।

এমনকি যে জিন্নাহকে অনেকে দ্বি-জাতি তত্বের জনক মনে করেন, সেই জিন্নাহও ছিলেন পুরা দস্তুর সেক্যুলার। অর্থাৎ ধর্ম এবং রাষ্ট্র পৃথক হবার অন্যতম কারিগর। তৎকালীন কংগ্রেসের সাথে তার বনিবনা না হওয়ার কারণ ছিল, তিনি মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রে এবং রাজ্যে মুসলমানদের জন্য ত্রিশ শতাংশ আসন বরাদ্দ চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তার এই দাবি মেনে না নেওয়ায় তিনি মুসলিম লীগের সাথে সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষন করেন।

যাহোক, ইতিহাস চর্চা এই আলাপটার উদ্দেশ্য না। উদ্দেশ্য হল কীভাবে জিন্নাহ’সহ বিশাল এক বিলাতী শিক্ষার ধারক আমাদের জাতির নেতৃত্বের আসন দখল করেন , যারা মুসলমান হলেও তাদের মন মস্তিষ্কে ছিলো প্রচন্ড পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি ঝোক। আর এদের এবং রেখে যাওয়া বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমলাদের মাধ্যমে প্রবেশ করে আধুনিকতা। [চলবে]

লেখকঃ আহবায়ক মুভমেন্ট ফর ইনসাফ।