Home গল্প-উপন্যাস গল্প: ‘উপসংহার ’

গল্প: ‘উপসংহার ’

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

হাসি-খুশি ছেলেটার মন খারাপ। দেখতে একদম ভাল লাগছে না। কেমন এলোমেলো চেহারা। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করব করব করেও আর হল না।

এ আমার অতীত অভ্যাস। বন্ধু-বান্ধবের বাহ্যিক অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারলেও সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় না বা করতে পারি না। অবশ্য এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত একটি চিন্তাও আছে যে, কেউ কোন সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে মনে হলে, তাকে অযথা প্রশ্ন করে নতুন সমস্যায় ফেলা ঠিক নয়। বরং আপন অবস্থায় চলতে দেয়া উচিত। উপযুক্ত মনে করলে সে নিজেই সমস্যার কথা বলবে।

তিন চারদিন পরের কথা। সাদীর বাসায় ওর রুমে বসে অাছি। সে একটি গল্প লিখেছে, ওটা দেখছি। সাদী একজন তরুণ লেখক। সবেমাত্র লেখালেখিতে এসেছে। কখনও ওর বাসায় গেলে সদ্য লেখা দু’য়েকটি গল্প-কবিতা আমাকে দেখায়। শুদ্ধাশুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করতে বলে। আজকে যে গল্পটি দিয়েছে সেটা গতরাতের লেখা। রাত জেগে লিখেছে। গল্পের শিরোনাম ‘একজন ছেলে একজন ভাই’। তার কলমে এমন শিরোনাম দেখে বেশ অবাকই হলাম। স্বভাবত: শিশু-কিশোর লেখাগুলো তার কলমে উঠে আসে। ব্যতিক্রমী এই শিরোনাম আমাকে টেনে নিয়ে গেল গল্পের ভেতরে। একশ্বাসে পড়ে নিলাম পুরো লেখাটি। এতটা আকর্ষণ, এতটা উত্তেজনা আর এতটা জীবন-ঘনিষ্ঠতা তার আগের কোন লেখাতেই ছিল না।

সে লিখেছে, একজন মধ্যবিত্ত ডাক্তার বাবার গল্প। হাজারও কষ্ট লুকিয়ে ছেলেকেও ডাক্তার বানান তিনি। নিজের চেম্বারে রেখে তাকে ইন্টার্নি করান। একপর্যায়ে ছেলেও ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মাঝে মাঝে বাবার চেয়ারেও বসতে থাকে। মেধার দিক দিয়ে অতটা শক্তিশালী না হলেও প্রাজ্ঞ-প্রবীণ ডাক্তার বাবার নিবিড় পরিচর্যায় এক সময় সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়। ধীরে ধীরে নিজের ক্যারিয়ার আরও মজবুত করে। লোকমুখে তার নাম-ডাক শোনা যায়। বাবা এতে কী যে খুশি! তার আনন্দের অন্ত নেই। কিন্তু তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, ছেলের এই যশখ্যাতিই একদিন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। নিজের ছেলেই একদিন তার কয়েক যুগের সাধনাকে ধূলোয় মেশাতে চাইবে।

অকল্পনীয় সেই কাজটিই একদিন করে বসে ঔরজাত সন্তানটি। বাবার কাছে দাবী করে বসে চেম্বার। সে বাবার চেম্বারকে নিজের চেম্বার বানাতে চায়। ছেলের প্রতিটি কথায় বাবার বুকটা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। টপটপ করে ঝরতে থাকে অশ্রুফোঁটা। তবে দমে যান না তিনি। বুকের কষ্ট বুকে চেপে ছেলের কথার কড়া প্রতিবাদ করেন। তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, সে যা দেখছে এটা অবাস্তব চিন্তা। এটা বাস্তব হবার নূন্যতম সম্ভাবনাও নেই।

বাবার কথায় ছেলের মাথা গরম হয়ে যায়। এক দুই কথা থেকে সেটা ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায়। ছেলের সাথেও ঝগড়া হবে, কখনও কল্পনা করেননি বাবা। ক্ষোভে, দুঃখে আর অভিমানে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে চেম্বার থেকে বের করে দেন। তিনিও আলাদা হয়ে মেয়ের বাসায় চলে যান।

ঘটনা যদি এতটুকুতেই থেমে যেত তাহলে হয়তো সাদী এই গল্প লিখত না। কিন্তু এর পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ, আরও বেদনাদায়ক। বাবা নিজের তিলে তিলে গড়ে তোলা চেম্বার আগলে রাখেন। কয়েক যুগের এই প্রতিষ্ঠানকে তিনি অন্য ছেলেদের ভবিষ্যত হিসেবে রেখে যেতে চান। কিন্তু কে জানত, সেই তাদেরই একজন তা ধ্বংস করে দেয়ার পাঁয়তারা করবে! কে জানত ছেলেই পিতার প্রতিষ্ঠানে গুণ্ডা লেলিয়ে দেবে!

একদিন মেজ ছেলেকে চেম্বারের দায়িত্ব দিয়ে বিশেষ কাজে গ্রামের বাড়িতে যান বাবা। ফিরতে তার সপ্তাহ খানেক লাগবে। এই সুযোগে বড় ছেলে বিভিন্নভাবে চেম্বার দখলের চেষ্টা চালায়। দফায় দফায় চেম্বারে এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে যায় গুণ্ডারা। পলিটিক্যাল শক্তির ভয় দেখায়। ভাঙচুর করবে বলে হুমকি দেয়। দিশেহারা হয়ে পড়ে মেজ ছেলে…।

গল্পের এখানে এসে ত্রিবিন্দু দিয়ে গল্প শেষ করেছে সাদী । কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, বিশেষ কোন কারণে গল্পটি উপসংহারেই আটকে রাখা হয়েছে। মেজ ছেলের নামটিও আর বলা হয়নি। ভেবেছিলাম শেষটুকু কী হবে, তা জিজ্ঞেস করব। কিন্তু হঠাৎ বেজে উঠল সাদীর মোবাইলটা। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সে জানাল, এক্ষুণি তাকে একটু বাইরে যেতে হবে। আধঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবে। ততক্ষণে লেখাটি সম্পাদনা করতে বলে ও চলে গেল।

আমি গল্পটি আবার পড়লাম। চরিত্রগুলো খুব চিন্তা করলাম। বারবার শুধু অবাক হচ্ছি, ওর গল্প গঠনের ধারাগুলো দেখে। এত নিখুঁত চরিত্র! এত স্বচ্ছ কাহিনী!

গল্প নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রায় একঘন্টা চলে গেছে টেরই পাইনি। সাদীর পিচ্চি ভাগ্নের কথায় সম্ভিত ফেরে পেলাম। পিচ্চিটা অদ্ভূত এক কথা শোনাল এসে; ‘মামা মামা, নানুর দোকানে না অনেকগুলা মাস্তান এসেছে। ওরা আজকেই দোকান ছেড়ে দিতে বলছে। তা না হলে নাকি দোকান ভেঙে দেবে!’

একটু পরে সাদীর কল এল আমার ফোনে। রিসিভ করতেই কাঁপা কন্ঠে ও বলল- ‘ভাই, আমার আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আপনার সমস্যা হলে বাসায় চলে যান।’

লাইন কেটে দিল ও। আমি কী করব ভেবে পেলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। গল্পটির উপসংহার খুঁজতে খুঁজতে ফিরে এলাম বাসায়। #