Home ফিকহ ও মাসায়েল ঈদকে সেক্যুলারাইজ করার অপচেষ্টা!

ঈদকে সেক্যুলারাইজ করার অপচেষ্টা!

।। ত্বরিকুল ইসলাম ।।

গতবারের মতো এবারের রোজার ঈদেও বেশ লক্ষণীয় একটি ব্যাপার হলো, ঈদ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংস্কৃতিক আয়োজনসমূহে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ আগের মতো লক্ষণীয়ভাবে বাজেনি। এ বিষয়টি নিশ্চয়ই আমার মতো অনেকেরই নজরে পড়ার কথা। অথচ ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে এই গান গেয়ে ঈদ-আনন্দে মেতে ওঠাই হলো বাঙালি মুসলমান সমাজের আবহমানকালের রীতি ও ঐতিহ্য।

এমনকি ঈদের আমেজ চলে গেলেও অনেক দিন ধরে রয়ে যেত এ গানের ভাবরেশ। কিন্তু গতবারের মতো এবারও ব্যতিক্রম দেখা গেলো বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলের ঈদ আয়োজন ও অনুষ্ঠানসমূহে। মনে হলো, অনেকটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই গানটিকে ব্ল্যাকআউট করার চেষ্টা করা হয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বলতে হবে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। নজরুলের এই গান বাদ দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের ঈদ উদযাপন অকল্পনীয়! ঈদের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সবটার মর্মার্থ বহন করে বলেই এই গানটি বাঙালি মুসলমানের কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়েছে।

আরো লক্ষণীয় যে, মিডিয়া ও প্রচারযন্ত্রকেন্দ্রিক একটি সক্রিয় সেক্যুলার গোষ্ঠী প্রতি বছরই মুসলমানদের ঈদ-উৎসবকে সেক্যুলারিজমের মোড়কে আবৃত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকে। ঈদকে শুধু নিরর্থক আনন্দের মাপকাঠিতে বিবেচনাপূর্বক তারা এর ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আবেদনকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ ভোগবাদী সেক্যুলারিজমের ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস নেয়। গত বছরের ঈদ উপলক্ষে আরটিভি চ্যানেলে প্রচারিত ‘রেইনবো’ নাটকটি সমকামিতাকে প্রমোট করেছিল, যা ঈদ এবং ইসলামী মূল্যবোধের ঘোরতর পরিপন্থী।

এ দেশের বাঙালি মুসলমানের প্রধান ধর্মীয় ঈদ-উৎসবকে সেক্যুলারাইজড্ করার এক হাস্যকর তৎপরতা দেখা গিয়েছিল বিগত ২০১১ সালে শহীদ মিনারে। সুপরিচিত সেক্যুলার ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীশ্রেণী শহীদ মিনারে ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনের নামে ‘ঈদ’ উদযাপন করেছিল। সেখানে একজন উদ্যোক্তা নিজেই ইমাম হয়ে ‘খুতবা’ (বক্তৃতা) পড়েন, কিন্তু নামাজ পড়াননি। শরিয়তের আহকাম ও নিয়মবিরোধী ওই তথাকথিত নামাজবিহীন ‘ঈদ’ যে আসলেই ছিল নিদারুণ তামাশা ও প্রহসনের নাটক, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য সে দিন শহীদ মিনারে তাদের ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন তথা ঈদ উদযাপনের নামে তামাশা ও প্রহসনের নাটক দেখার জন্য দেশের কৌতূহলোদ্দীপক অনেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিল।

আমার পরিচিত একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ শাহ আলম ভাই এ প্রসঙ্গে তখন একটি মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন, যা প্রণিধানযোগ্য-

‘‘যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর (বানোয়াট) এখন পালিত হয় ধর্মীয় তাৎপর্যহীন (সেক্যুলার) উৎসব হিসেবে তামাম পশ্চিমা দুনিয়ায়। বাংলাদেশের সেক্যুলার ‘বুদ্ধিজীবীদের’ একটি অংশ অনেক আগে থেকে ‘বাঙালি’দের জন্য অনুরূপ ধর্মীয় তাৎপর্যহীন নিতান্ত সেক্যুলার একটি জাতীয় উৎসব আবিষ্কারের তথা প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করে। বেছে নেয় ১ বৈশাখকে। এতে ১ বৈশাখ উদযাপনের দিক থেকে জাঁকজমক ও জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও দেশের বৃহত্তর মুসলমান সমাজে ঈদ তার ধর্মীয় আমেজ ও তাৎপর্য নিয়েই বহাল থাকে। ফলে এ সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী সমাজ ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্য মুছে দিয়ে এটাকে খাঁটি বাঙালি উৎসবে রূপান্তরের বুদ্ধিজীবীসুলভ যে উদ্যোগ নেয়, তারই প্রাথমিক কর্মসূচি শহীদ মিনারে নামাজবিহীন এই ‘খুতবা’র ঈদ। নামাজ থাকার কারণে তাদের কাছে ঈদ একটি ‘সাম্প্রদায়িক’ উৎসব হিসেবে বিবেচ্য।’’

তাই হাইব্রিড সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীকুল পরিকল্পিতভাবে দেশের উঁচুতলার বেদি শহীদ মিনারে তথাকথিত নামাজবিহীন ‘খুতবা’র ঈদ উদযাপন করে এ দেশের মানুষকে ধর্মীয় রীতিনীতি ও মূল্যবোধহীন নতুনধারার খাঁটি বাঙালি তথা সেক্যুলার ‘ঈদ’ উপহার দিতে চেয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, তারা সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সৃষ্টি করার জন্য খোদ ধর্মেরই অপব্যবহার করছেন! অথচ তারাই কিনা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় আলেম-ওলামাকে ‘ধর্মব্যবসায়ী’ বলে গালি দেন। কী ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি! ফুড পয়োজনিং হলে পাকস্থলীর যেমন বিকার ঘটে, তেমনি সেক্যুলার পয়োজনিং মস্তিষ্কের বিকারও ঘটায় বৈকি!

অন্যদিকে, সচেতন পাঠক মাত্রই আঁচ করতে পারবেন যে, হাল আমলে এক শ্রেণীর সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে কালচারাল ফ্যাসিজমের মাধ্যমে ঈদকে তামাশা আর প্রহসনের বিষয়ে পরিণত করতে যারপর নাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। মুসলমানদের আবহমানকালের ধর্মীয় ও সামাজিক ঈদ উৎসবকে ইসলামের মর্ম থেকে যতটুকু সম্ভব বের করে এনে এর সেক্যুলারাইজেশন করার প্রয়াস চলছে। না বললেই নয়, তথাকথিত সেক্যুলার মিডিয়াসমূহে ঈদের মূল ধর্মীয় ভাবচেতনাকে অঘোষিতভাবে করা হয়েছে অবাঞ্ছিত।

বিশিষ্ট নাট্যকার, টিভিব্যক্তিত্ব ও স্বনামধন্য কলামিস্ট আরিফুল হক লিখেছেন, ‘সেক্যুলার ঈদ হলো সেই বাউল গানটার মতো ‘আমি রাঁধিব, বাড়িব, ব্যঞ্জন বাড়িব, তবু হাঁড়ি ছোঁব না।’ বিটিভির ঈদের অনুষ্ঠান অনেকটা সেই রকম। ঈদের অনুষ্ঠান হবে, কিন্তু ইসলামকে ছোঁয়া যাবে না। ইসলামি জীবনদর্শন, অস্তিত্ব-চেতনা-ভাবনা থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে হবে; অর্থাৎ ঈদ সংস্কৃতির দিকটা কিংবা ঈদের মূল স্পিরিটটা কোনো মতে বেরিয়ে আসতে দেয়া যাবে না। কারণ, পাছে বাবু কিছু বলে। ধর্মনিরপেক্ষতা মার খায় সদা এই ভয়। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে পূজার দিনে প্রতিমা দেখানোতে ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয় না, বুদ্ধঠাকুর দেখানো দোষণীয় হয় না, ক্রিস্টমাস-ট্রি বা সান্তাক্লজ দেখানোতেও ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয় না, কিন্তু মুসলমান সংখ্যাগুরুর দেশে, যে দেশের সংবিধানে ইসলাম এখনো রাষ্ট্রধর্ম— সেই দেশের জাতীয় টেলিভিশনে বছরে দু-একবার ইসলামি রিচুয়াল পালিত হবে বা ইসলামিক স্পিরিট অনুযায়ী ঈদের অনুষ্ঠান সাজানো হবে, এটা যেন টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সহ্যই করতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে এরা বরাবরই ঈদের অনুষ্ঠানকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে’ (পৃষ্ঠা: ১৭, সংস্কৃতির মানচিত্র, আরিফুল হক)।

আরো পরিতাপের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক কালে বেশির ভাগ বেসরকারি টিভি চ্যানেলেও ঈদকে ঘিরে সীমাহীন প্রহসন শুরু হয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে চ্যানেলগুলোর প্রোগ্রাম ও যাবতীয় সাংস্কৃতিক আয়োজন এমনভাবে সাজানো হয়, যেখানে সত্যি কথা বলতে ঈদের মূল স্পিরিটের কোনো ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

আরিফুল হক তার বইটিতে আরো লিখেছেন, ‘‘ওদের অনুষ্ঠানগুলো দেখলে বা শুনলে ঈদের ঐতিহ্যটাকেই নড়বড়ে মনে হয়, গুরুত্বহীন মনে হয়। ওরা জানে না ঈদ আর পাঁচটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো শুধু মূল্যবোধহীন আনন্দের উৎসব নয়। সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ঘটায় এমন কোনো কাজ বা উৎসবে মুসলমানরা বিশ্বাস করে না। ঈদ সমস্ত মানুষকে এক উদার বিস্তৃত প্রাঙ্গণে আহ্বান জানায় ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে অন্ধ নেশা ও বেসাতিপনার পথ পরিত্যাগ করে সুন্দর উন্নত জীবনের পথে ফিরে আসতে বলে।’’

সুতরাং ঈদ কোনো অর্থহীন বা মূল্যবোধহীন নিছক আনন্দের উৎসব নয়, এর রয়েছে অর্থপূর্ণ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় রূপ। একজন প্রখ্যাত নাট্যকার ও টিভিব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রদ্ধেয় আরিফুল হকের উপলব্ধি ও তার বক্তব্যের যথার্থতা ছাড়াও আমাদের নিজ চোখের দেখাও তো তথৈবচ। এ ছাড়া হাতে গোনা দু-একটি সংবাদপত্র ছাড়া বেশির ভাগ সংবাদপত্রের বার্ষিক ‘ঈদসংখ্যা’গুলোতে ঈদের প্রকৃত চেতনা বা মেজাজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঈদ উপলক্ষে সেখানের সব আয়োজনই থাকে সৃজনশীল, কিন্তু ঈদের মূল চেতনা সেখানেও কার্যতঃ অধরা।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা এবং আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান এ জনপদের মাটি ও মানুষের আবহমানকালের আজন্ম লালিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ দেশের ইসলামবিদ্বেষী উগ্র সেক্যুলারপন্থীদের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ইসলামের বিশ্বজনীন আদর্শ ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এ ধর্মপ্রাণ সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষকরণের বিজাতীয় এজেন্ডা ও নীতি বাস্তবায়ন কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান হতে দেবে না।

ঈদ মানে আনন্দ। তবে শুধু আনন্দ দিয়েই ঈদকে মূল্যায়ন করা সমীচীন হবে না। কারণ, ঈদের যেমন পার্থিব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব আছে, তেমনি এর আছে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তাৎপর্যও। ধর্মীয় আধ্যাত্মিক তাৎপর্যকে উপেক্ষা বা অবহেলা করে স্রেফ আনন্দের নামে লাগামহীন বস্তুবাদী কার্যকলাপ ও যথেচ্ছাচার সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, ঈদের আনন্দ বল্গাহীন নয়, বরং এর পার্থিব উল্লাস ও উদযাপন ততটুকুই সমর্থনযোগ্য, যতটুকু ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে না যাবে। আল্লাহ তায়ালা সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না। আর যেখানে পবিত্র মাহে রমজান আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষা দিয়ে যায়, সেখানে শহুরে ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর খপ্পরে পড়ে ঈদ উদযাপন যেন ভোগবাদী উৎসবে পরিণত হয়! মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উল্লাস ও হৈ-হুল্লোড়ের ভিড়ে হারিয়ে যায় কত না-পাওয়ার বেদনায় জর্জরিত প্রান্তিক গরিব-দুখীর ঈদ।

– ত্বরিকুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকার কলামিস্ট।