Home ফিকহ ও মাসায়েল কুরবানীর দর্শন ও প্রায়োগিক গুরুত্ব

কুরবানীর দর্শন ও প্রায়োগিক গুরুত্ব

।। মু. জাকির হোসেন খান ।।

কুরবানী শব্দের উৎপত্তি ‘কারীবুন’ শব্দ থেকে। যার অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, সান্নিধ্য বা উৎসর্গ। অর্থাৎ কুরবানী একইসাথে উৎসর্গ- এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ’র সান্নিধ্য অর্জনকে বুঝায়। বাস্তবে একজন বিশ্বাসী বা মুমিনের জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত ও কর্ম কুরবানীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

তাই তো মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “হে নবী! আপনি বলুন- আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের মালিক আল্লাহ তায়ালার জন্য নিবেদিত”। (সূরা আনআম : ১৬২)।

তাই, কুরবানীর উদ্দেশ্য শুধু পশু যবাই নয়, বরং তার মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য অর্জন। কোরবানীর নামে ধর্ম প্রদর্শনেচ্ছা পুঁজিবাদী অর্থনীতির নগ্ন ভোগবাদ এবং তার মার্কেটিং- শুধুই আত্মার বিকৃতি, ধর্মের অপব্যবহার; কোরবানী নয়। অসৎ ব্যক্তির অসৎ উপার্জনের মাধ্যমে কুরবানী বা ধর্ম চর্চার চেষ্টা ধর্মের শুধু বিকৃত রূপই তুলে ধরবে। কেননা ভোগবাদ এবং নৈতিকতা সবসময় পরস্পর বিরোধী বিষয়। আর উপার্জন ও কর্মে সৎ হতে না পারলে ব্যক্তি যেমন ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে, তেমনি ধর্মের মূল নির্যাস বা আধমাতিকতা চর্চার পরিবর্তে ধর্মের সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে নিজের অন্ধকার জগত ঢাকার চেষ্টা করে থাকে, তা অনর্থক বৈকি।

কুরবানীকে নিরীহ প্রাণী হত্যার মতো নিষ্ঠুরতা হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ নেই, পশু যবাই কুরবানীর উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য অর্জনের মাধ্যম। আর কোরবানীর পশু যবাইয়ের বিষয়েও সতর্কতার কথা বলা হয়েছে যেন কুরবানীর উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়। যেমন বলা হয়েছে, তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা যবেহ করা হবে তাকে যেন কম কষ্ট দেয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৯৫)।

এমনকি কুরবানীর সময় মানবিকতা প্রদর্শনে নবী (সা.) ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলছেন, যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে। (মুসনাদে আহমদ, ২/১০৮; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৩১৭২)।

পশুর চোখের সামনেই ছুরি ধার দেওয়া অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার প্রতিকূল। কুরবানীকে অমানবিকতা হিসাবে তুলে ধরার পেছনে ইসলাম বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্য হলো, প্রতি বছর ১০ই যিলহজ্জ আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য বিশ্বের সকল মুমিন সর্বোচ্চ ত্যাগের যে শিক্ষা গ্রহণ করে, সেটাকে ওরা ভয় পায়। যদি নিতান্ত পশু হত্যা হিসাবে এরা দেখতো, তাহলে এটাকে সমালোচনা করতো না।

সারা পৃথিবীতে অন্যান্য ধর্মীয় আচার হিসাবে বা প্রতিদিন খাবার হিসাবে অসংখ্য প্রাণী হত্যা করা হলেও সেটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। এমনকি ভেজেটারিয়ানরা যে সবজি খান, এই সবজিরও তো প্রাণ আছে। আর পনির বা দই এর উৎসও তো পশুর দুধ, যা বাচ্চা গরুর জন্যই মূলতঃ বরাদ্দ। তারপরও কুরবানী যেন মনের পশুকে হত্যা করতে সহায়ক হয়, তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে কুরবানী করেছেন, যা আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম।

অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল পরিবার বা ব্যক্তির স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যে মূলধন দরকার তার একটা বড় উৎস কিন্তু কুরবানির পশু পালন। ২০১৬ সালে এক হিসাবে দেখা যায়, কুরবানীর বাজারে ৪০ লাখ ৬১ হাজার গরু, ২১ লাখ ৯০ হাজার ছাগল ও ১ লাখ ৫৮ হাজার অন্যান্য পশু বিক্রি হয়েছিল। এর বাজার মূল্য ছিল ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। তাছাড়া খামার পর্যায়ে প্রতিপালিত গরু ও ছাগলও কুরবানী করা হয়েছে অনেক, যা বাজারে নেয়া হয়নি। ২০১৮ সালে মানুষের আয় ও দেশের জনসংখ্যা দুইই বেড়েছে। তাতে চলতি বছর অভ্যন্তরীণ বাজারে কুরবানির পশুর চাহিদা ছিল প্রায় ৪৫ লাখ গরু এবং ২৫ লাখ ছাগল-ভেড়া, যার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

আর কোরবানির জন্য স্থান, কাল বা পাত্র নির্দিষ্ট নয়। তাই একজন ব্যক্তি যে সমাজে অভাব বা অনাহারে আছে বা গরু, মহিষ, ভেড়া বা ছাগলের গোশতের উচ্চ মূল্যের কারণে জনগোষ্ঠী খাদ্য তালিকায় আমিষ রাখতে পারছে না সেখানেই কোরবানির গোশত পৌঁছানোই উৎসর্গের অগ্রাধিকার।

আর কুরবানীর মাধ্যমে ঈমানদার সামর্থবানদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে, যেন নিজে ভোগবাদের অনুসারী না হয়ে সমাজের বঞ্চিত অংশকে সম্মানের সাথে কুরবানীর অংশীদার করে নেন। তাই, কুরবানীর গোশত নিজে সর্বোচ্চ এক ভাগ রেখে বাকি দুই ভাগ আত্মীয় সবজন ও দরিদ্র মানুষকে বিতরণ করতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ ত্যাগেই আনন্দ, ভোগের আনন্দ সাময়িক।

কুরবানীর বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতও যৌক্তিক। প্রকৃতি প্রদত্ত খাদ্য শৃংখল অনুসারে মানুষ তার প্রয়োজনে প্রাণি শিকার করে বা ক্রয় করে সারা বছর আমিষ গ্রহণ করলেও কুরবানীর মাধ্যমে সামর্থহীন মানুষের আমিষের ঘাটতি পুরণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ২ কোটি আর্থিকভাবে অসমর্থ মানুষ গড়ে ১০ কেজি গোশত আহরণ করলে তার আমিষের পরিমান কত তা সহজে অনুমেয়। এর পাশাপাশি কুরবানীর চামড়া বিক্রিত অর্থ দরিদ্র মানুষের জন্য কার্যকর আর্থিক সহায়তা, যার গুরুত্ব সামান্য উপার্জনের মানুষের কাছে অনেক।

অন্যদিকে পশু যবাইকে শিশুর মনের ওপর প্রভাব পড়ার কথা যারা বলেন, তাদের কথার যুক্তি থাকতে পারে। শিশুদের যেহেতু বুঝার সামর্থ যথাযথ হয় না, তাই বাহ্যিকতাকেই মনে রাখে। আর বুঝার বয়স না হওয়ায় সন্তানদের দশ বছর বয়স পর্যন্ত নামায বাধ্যতামূলক না হওয়ার বিধান প্রযোজ্য। স্রষ্টাও যেখানে এ ভালনারেবেলিটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাই এটা বুঝতে হবে শিশু সন্তানের সামনে কোরবানী করা হলে তার মনে এক ধরণের বিকৃতি স্থান পেতে পারে। তাই কুরবানীর সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সামনে রাখার কোন যুক্তি নেই। কুরবানীর পশুসহ বছরের অন্য সকল সময়ের হালাল পশু যবাইয়ের সময়ও ‍শিশুদেরকে দুরে রাখা উচিত।

এক পশুর সামনে আরেকটা পশু কোরবানি না করা যথাযথ হলে একজন মানব শিশুর সামনে তা করা কতখানি যৌক্তিক। বরং শিশুদেরকে কোরবানীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা প্রদান করে তার জন্য প্রস্তুত করা জরুরি। কুরবানির প্রকৃত মর্মার্থ বুঝতে পারলেই কোরবানী সার্থক হবে। নিশ্চয় “আল্লাহর কাছে কখনো কুরবানীর গোশত বা রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়”। (সূরা হাজ্ব- ৩৭)।

নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর নিশ্চয় মিলবে, সত্যিই এ কুরবানী আমার স্রষ্টাভীতি বাড়াচ্ছে বা এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে আত্মিক সান্নিধ্য অর্জনে সহায়তা করছে কি? [২২ জুলাই ২০১৮]।

– মু. জাকির হোসেন খান, অর্থ-রাজনীতি গবেষক ও লেখক।