।। রোকসানা মনি ।।
হাঁটু ব্যথার রোগী প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দেখতে পাওয়া যায়। এর বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণ অস্টিও আর্থ্রাইটিস বা অস্থিসন্ধির ক্ষয়জনিত কারণ। আমাদের দেহের প্রতিটি সন্ধি বা জয়েন্টের মতোই হাঁটুর জয়েন্টের হাড়ও নরম এবং মসৃণ আবরণ বা কার্টিলেজ দ্বারা আবৃত। এই কার্টিলেজ যখন ক্ষয় হয়ে অমসৃণ আকার ধারণ করে তখন জয়েন্ট নাড়াচাড়ায় ব্যথা অনুভূত হয়, জয়েন্ট ফুলে যায়। এটি অস্টিও আর্থ্রাইটিস বা হাঁটুর এক প্রকার বাত।
যে যে কারণে হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিস হয়:
বয়সজনিত ক্ষয়: বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সে এই রোগ বেশি হয়।
লিঙ্গ: সাধারণত পুরুষের তুলনায় মহিলাদের আর্থ্রাইটিস বেশি হয় এবং তা মনোপোজ বা মাসিক বন্ধের পর। কিংবা যাদের হিস্টেরেক্টমি সার্জারি হয়েছে।
অধিক দৈহিক ওজন: হাঁটু হচ্ছে মানবদেহের অন্যতম ওজন বহনকারী সন্ধি। তাই অতিরিক্ত দৈহিক ওজন হাঁটুতে অধিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে হাঁটুর ক্ষয় বেশি হয়।
মাংসপেশির দুর্বলতা: দুর্বল মাংসপেশি হাঁটুর সন্ধিকে তার স্বাভাবিক স্থানে ধরে রাখতে পারে না। ফলে ঘর্ষণ বেশি হয়, ক্ষয়ও বেশি হয়।
আঘাতজনিত কারণ বা জয়েন্ট ইঞ্জুরি
অস্থিসন্ধির তরল পদার্থ বা সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িড কমে গেলে: দেহের বড় বড় জয়েন্টের ভেতর এক প্রকার তরল পদার্থ থাকে যা জয়েন্ট নাড়াচাড়া করতে সাহায্য করে। এই তরল পদার্থ কমে গেলে জয়েন্টে ঘর্ষণ বেশি হয়। ফলে ক্ষয়ও বেশি হয়।
পেশাজনিত কারণ: যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করেন, অতিরিক্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন এবং যারা অতিরিক্ত ভার বহন করতে হয় এমন কাজ করেন তাদের হাঁটুর ব্যথা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তা ছাড়া জেনেটিক বা বংশগত কারণ, জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক বা ম্যালফরমড জয়েন্ট ইত্যাদি কারণেও হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিস হতে পারে।
উপসর্গ:
১. হাঁটুতে ব্যথা।
২. হাঁটু ফুলে যাওয়া।
৩. হাঁটু গরম অনুভূত হওয়া।
৪. হাঁটু ভাঁজ করতে না পারা বা জয়েন্ট জমে আছে এমন বোধ হওয়া।
৫. জয়েন্টের আকৃতি পরিবর্তন।
৬. কখন কখন হাঁটুর নাড়াচাড়ায় শব্দ অনুভূত হয়।
রোগ নির্ণয়: এ ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর বয়স, উপসর্গ, রোগের ইতিহাস, কিছু ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশনের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু রেডিওলজিক্যাল এবং প্যাথলজিক্যাল টেস্টও করা হয়। যেমন: x-ray, MRI, Bone mineral density test, Rh factor, serum calcium level ইত্যাদি।
হাঁটু ব্যথায় চিকিৎসা
মেডিসিন: সাধারণত ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ দেয়া হয়। তা ছাড়া ক্ষয় পূরণের জন্য ডায়টারি সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়।
ফিজিওথেরাপি: ব্যথা নিরাময় এবং জয়েন্টের স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনার জন্য ফিজিওথেরাপি একটি আধুনিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি। হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিসের জন্য ব্যবহৃত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাগুলো হলো- আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি, টেনস থেরাপি, ইন্টার ফেরেনসিয়াল থেরাপি, লেজার থেরাপি, হাঁটুর শক্তি বাড়ানোর জন্য বিশেষ ব্যায়াম।
ইন্ট্রা আর্টিকুলার ইঞ্জেকশন: জয়েন্ট ফ্লুয়িড কমে গেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ইন্ট্রা আর্টিকুলার ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন।
সার্জারি: কখনো কখনো হাড়ের ক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করার প্রয়োজন হয়।
হাঁটুর আর্থ্রাইটিসে করণীয়:
১. ব্যথা অবস্থায় হাঁটুকে বিশ্রাম দিতে হবে।
২. দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা যাবে না।
৩. সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা কম করতে হবে।
৪. ব্যথা অবস্থায় হাইকমোড ব্যবহার করতে হবে।
৫. ব্যথা অবস্থায় বসে নামাজ পড়তে হবে।
৬. বসা থেকে ওঠার সময় সাপোর্ট নিয়ে উঠতে হবে।
৭. হাঁটার সময় হাঁটুর সাপোর্ট হিসাবে- নি ক্যাপ, নি ব্রেস, ওয়াকিং এইড ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর্থ্রাইটিস থেকে বাঁচার উপায়: যদিও হাড়ের ক্ষয় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া তবুও প্রথম থেকেই কিছু নিয়ম মেনে চললে ক্ষয়কে দূরবর্তী করা যেতে পারে। যেমন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও এলকোহলমুক্ত জীবনযাপন।
লেখক: ফিজিওথেরাপিস্ট, কিউর মেডিক্যাল অ্যান্ড জেনারেল হসপিটাল, গুলশান।
ফোন- ০১৭১২-০৯২৯০৫