Home সম্পাদকীয় নিরাশ হবেন না কেউ: সম্মুখে ভবিষ্যৎ

নিরাশ হবেন না কেউ: সম্মুখে ভবিষ্যৎ

।। মুহাম্মাদ গোলাম রব্বানী ইসলামাবাদী ।।

দেশের সুসংগঠিত একমাত্র সামাজিক শক্তি কওমী-জগতের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এখন সর্বত্র আলোচিত একটি বিষয়। তবে এ অস্থিরতা স্থায়ী নয়, সাময়িক। ইতিহাস-তথ্যে এর চেয়েও বড়ো অস্থিরতার খোঁজ মিলে। কিন্তু স্থায়ী হয়নি কস্মিনকালেও। সাময়িক কিছু ঝড়োবাতাসের পর আবারও পূর্ণস্থিতে ফিরে আসে কওমী-জগৎ।

এখন যে অস্থিরতা চলছে, তার প্রচণ্ডতা যেন কাবু করে ফেলেছে কওমী ছাত্র-সমাজকে। আমাদের কওমী ছাত্র-সমাজ অবস্থাদৃষ্টে যতোটুকু হতাশ হয়েছেন, আসলে আশঙ্কার গভীরতা ততোটা নয়। একটি উদাহরণ নেয়া যাক। আমাদের এই দেশ ঝড়-তুফানের দেশ। তাই এ দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এখানে দু’ধরনের ঝড়-তুফান হতে দেখা গেছে। প্রথমত, ঝড়-তুফানের তীব্রতা বেশি। কিন্তু ঝড় থামলে দেখা যায় গৃহ ও জন-মানুষের ক্ষতি ততোটা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ঝড়-তুফানের মাত্রাতে আশঙ্কার কারণ ছিলো না। কিন্তু জনপদের ক্ষতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ, ভিত যেখানে মজবুত, সেখানে ঝড়ের তীব্রতায় মৌলিক কাঠামো প্রভাবিত হয়নি। আর যেখানে দুর্বল-ভিতের ঘর-বাড়ি সেখানে অল্প বাতাসেই অবকাঠামো কাৎ-চিৎ হয়ে পড়ে। নিঃসন্দেহে, আমাদের কওমী-জগৎ প্রথমোল্লিখিত উদাহরণের মতো।

একটি প্রবাদ আছে, যে গাছে ফল ধরে বেশি, সে গাছে ঢিল ছুঁড়ে বেশি।

আমাদের কওমী-ছাত্রদের মনে রাখা উচিৎ, কওমী-জগৎ এতো দুর্বল নয় যে, এ সামান্য বাতাসেই দুলে উঠবে বা ভিতে ফাটল ধরবে। চলমান সঙ্কটকে একদিক থেকে বলা হচ্ছে নেতৃত্বের সঙ্কট। অন্যদিক থেকে বলা হচ্ছে, মধ্যস্বত্ত্বভোগী একটি চিহ্নিত চক্রের জন্যই এ সঙ্কট। যাই হোক না কেন, এ মুহূর্তে কওমী-জগতকে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার দায়িত্বই প্রধান এবং মৌলিক-কাজ।

মনে রাখতে হবে, শুদ্ধ, সুস্থ, মার্জিত ও শালীন-ভাষায় নিজস্ব মতামত প্রকাশের অধিকার সবার রয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ এটাকে কেবল অনুমোদনই করে না, উৎসাহিতও করে।

একটি বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক। পাকিস্তানের বিখ্যাত আলিমে দ্বীন শাইখুল হাদীস মাওলানা সালিমুল্লাহ খান (রাহ.)এর (১৯২৬-২০১৭) কথা অনেকেই শুনেছেন। তাঁর একটি বিশেষ পরিচিতি হলো, তিনি আল্লামা রাফী উসমানী ও আল্লামা তাকী উসমানীর বিশিষ্ট উস্তায। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত যে, আল্লামা তাকী উসমানী সুদবিহীন ইসলামী ব্যাংকিং-র পথিকৃৎ। বিশেষত: পাকিস্তানে এ বিষয়ে তিনি নতুন-যুগের সূচনা করেছেন। তাঁর তত্ত্বকে অবলম্বন করে উউরোপেও ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার গোড়াপত্তন হয়েছে ব্যাপক পরিসরে। কিন্তু তাঁর সম্মানিত উস্তায মাওলানা সালিমুল্লাহ খান (রাহ.) বর্তমান ব্যবস্থায় সুদবিহীন ব্যাংকিং-র বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেননি। এ বিষয়ে ২০১৬ সালে (খুব সম্ভবত) মাওলানা খান সাহেব (রাহ.)এর তত্ত্বাবধানে مروجہ اسلامی بینک کاری নামে একটি ফাতওয়া-গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়, যেখানে পাকিস্তানের বিশিষ্ট মুফতীবৃন্দ প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকিং শরীয়াহ-সম্মত হবার প্রতিকূলে মতামত প্রদান করেন। যেহেতু আল্লামা তাকী উসমানী ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার শক্তিশালী প্রবক্তা, তাই তাঁর সম্পর্কেও গ্রন্থ প্রকাশের প্রাক-আলোচনায় কথা ওঠে। বিষয়টি নিয়ে মাওলানা খান সাহেব (রাহ.) স্বীয় ছাত্র মাওলানা তাকী উসমানীকে যে বিনয়মিশ্রিত ভাষায় চিঠি লিখেন, তা ইতিহাস-বিবেচনায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। ২০১৬ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর লেখা সেই চিঠির শুরুতে মাওলানা সালিমুল্লাহ খান সাহেব (রাহ.) মাওলানা উসমানীকে লিখেন-

 الحمد للہ و کفیٰ و سلام علیٰ عبادہ الذین الصطفیٰ و بعد

احقر کو علم و فضل کے اعتبار سے جناب سے کوئی نسبت نہیں ہے، علم و فضل سے ہے ہی نہیں تو نسبت کیا ہوگی؟ البتہ اللہ نے ایمان نصیب کیا ہے، دعا کرتا رہتا ہوں کہ اللہ یہ زندگی ایمان والی زندگی اور کلمہ والی موت پر ختم فرمائے۔

۱۔ اسلامی بینکاری کے حوالے سے تشویش و اضطراب عام ہے، علماء ، عوام، بینکنگ سے متعلق افراد، تاجر و غیرہ سب موجودہ اسلامی بینکاری کو اسلامی تعلیمات کے خلاف سمجھتے ہیں۔

(অর্থ: হামদ ও সানার পর,  ইলম ও মর্যাদার দিক দিয়ে আপনার সাথে অধীনের তুলনা হবার নয়। ইলম আর মর্যাদায় না হলে, তুলনাই বা কিসের? তবে, আল্লাহ (আমাকে) ঈমান নসীব করেছেন। দোয়া করে চলেছি, আল্লাহ এই জীবনকে আল্লাহওয়ালা জীবন বানিয়ে দিন এবং জীবনের শেষে ঈমানী মৃত্যু নসীব করুন। (প্রচলিত) ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে উৎকণ্ঠা আর বিশৃঙ্খলা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। আলিম-উলামা, সাধারণ মানুষ, ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রমুখ বর্তমান ইসলামী ব্যাংকিংকে ইসলামের পরিপন্থি মনে করছে)। مروجہ اسلامی بینکاری গ্রন্থটি প্রকাশের পর আল্লামা তাকী উসমানী তাঁর নিজের অবস্থান তুলে ধরে অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় غیر سودی بینکاری নামে একটি প্রত্যুত্তরমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যাতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বপক্ষে বিভিন্ন কুরআন, সুন্নাহ ও ফিক্বহী দলীল উপস্থাপন করা হয়। গ্রন্থটির ভূমিকার শেষে এসে মাওলানা তাকী উসমানী (মু.আ.) যে অভিব্যক্তি সংযোজন করেন তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। তাতে তিনি লিখেন-

یہ تو اللہ تبارک تعالی کے فیصلے ہیں کہ اگرکوی ایسا قول اٹھتا ہے جو اللہ تعالی کی رضا کے خلاف ہو تو اگر کچھ عرصے اپنا زور جما بھی لے – تو آخر کار امت اسلامیہ کا اجتماعی ضمیر ا سے رد کر دیتا ہے- اور وہ تاریخ کی کتابوں میں دفن ہو جاتا ہے- لہٰذا اپنی بات کو نہ میں حرفِ آخر قرار دے سکتا ہوں-نہ کوئے اور ہی فیصلہ اللہ تعالی کے سوا کویُ نہیں کر سکتا کہ کونسا قول اس کے رضا کے مطابق ہے جو بالآخر امت میں قبولِ عام حاصل کرے گا، اور کونسا قول اس کی رضا کے خلاف ہے جو بالآخر مٹ جاےگا- میں اللہ تعالی سے دعا کرتا ہوں کہ جو کچھ میں سمجھ اور لکھ رہا ہوں، اگر وہ ان کی رضا کے خلاف ہو تو اللہ تعالی اس کو ملیا میٹ کر کے امت کو اس کے شر سے بچالیں، اور مجھے اس سے رجوع کی توفیق عطا فرمایں، اور اگر وہ ان کی رضا کے مطابق ہو اسے قبولِ عام عطا فرما کر اس مقصد کو پورا فرما دی جس کی تڑپ میں وہ لکھا گیا ہے، اور اسے امت کو سود کی لعنت سے بچانے کا ذریعہ بنا دی-آمین ثم آمین-

[অর্থ- এটি তো আল্লাহ তাবারক তায়ালার নিয়ম যে, যদি তাঁর সন্তুষ্টি পরিপন্থী কোন কথা উপস্থাপিত হয়, সেটি কিছু সময় পর্যন্ত টিকে থাকলেও শেষ অবধি উম্মা’র সর্বসম্মত রায় সেটিকে প্রত্যাখ্যান করে। সেসব ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যায়। সুতরাং, আমার কোন কথাকে  আমি শেষকথা বলে বলতে পারি না; বলতে পারি- আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কেউ এ ফয়সালা দিতে পারেন না যে, কোন্ বক্তব্য তাঁর সন্তুষ্টির অনুকূল হবে এবং শেষ পর্যন্ত উম্মা’র কাছে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে অথবা কোন্ বক্তব্য তাঁর সন্তুষ্টির পরিপন্থি হবে এবং শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়ে যাবে। আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি, যা কিছু উপলব্ধি করছি এবং লিখছি, সেসব যদি তাঁর সন্তুষ্টির অনুকূল না হয়, তবে আল্লাহ তায়ালা যেন সেসবকে বরবাদ করে উম্মাহকে সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। এবং আমাকে সংশোধিত হবার তাওফিক দিন। আর যদি আমার উপলব্ধি ও লৈখিক বক্তব্য তাঁর সন্তষ্টির অনুকূল হয়, তবে সর্বজনে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে এই লক্ষ্য পূরণ করে দিন। যে জন্য গ্রন্থটি ( غیر سودی بینکار) লিখা হয়েছে এবং উম্মাহকে সুদের অভিশাপ হতে রক্ষার মাধ্যম হিসাবে গৃহিত হোক, এ দোয়াই করছি। আ-মীন]।

বলছিলাম, নিজস্ব মতামত প্রকাশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এখানে একজন উস্তায়, অন্যজন ছাত্র। অথচ উভয়ের নিজস্ব অবস্থান-প্রকাশে ছিলো স্বাধীনতা, স্পষ্টতা কিন্তু মার্জিত ও বিনয়মিশ্রিত। এখান থেকে আমাদের তরুণ আলিম-ছাত্রের অনেক কিছু শিখার আছে মনে করি। সুতরাং যে বিষয়কে আপনি হক মানছেন অথবা মানছেন না, সেটিকে আপনি প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে নয়; সুস্থ ও মার্জিতভাবে। আপনার প্রচণ্ড বৈরীপক্ষের নামও যদি নিতে হয়, তবে তার সম্মানের সাথে নিন, যেন আপনার মতামত প্রকাশ আক্রমণমুখী না হয়ে দা’ওয়াতমুখী হয়।

সংবর্ধনার বিষয়ে প্রত্যেকের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা থাকতে পারে। আপনি যথার্থ সূত্র ও যুক্তি দিয়ে আপনার মতামত প্রকাশ করবেন, তাতে কোন বাধা নেই। কিন্তু কওমী-জগতে আনুগত্যের যে ঐতিহ্য শতশত বছর ধরে চলে এসেছে, সেখানটায় যেনো কোন ক্ষত না হয়। সেই আমানতদারীকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। অন্যথায়, একবার আনুগত্যের দেয়াল ভেঙ্গে গেলে তা আর মেরামত করা যাবে না। তখন সেই চিরচেনা কওমী-জগৎ হারিয়ে যাবে চিরতরে। মনে রাখতে হবে কুরআনে কারীম বলছে- اتبعوا من لا يسألكم أجراً وهم مهتدون (অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত)।

আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবছেন: কওমী-জগতের এ সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদী। আসলে  এটি দীর্ঘমেয়াদী কোন সঙ্কট হবে না- যদি আমরা সচেতভাবে ও সম্মিলিতভাবে কওমী-জগতকে মৌলনীতির উপর রাখতে প্রত্যয়ী হই। প্রয়োজনে আমরা স্বীকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করবো, হাইয়াতুল উলিয়া থেকে বেরিয়ে আসবো, তবুও কওমী-জগতকে হযরত কাসেম নানুতুভী (রাহ.)এর মূলনীতির উপর অক্ষত রাখবো; এ প্রত্যয় আর ইখলাস যদি বুকে ধারণ করে রাখতে পারি, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়- সম্মুখে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে, আপনারাই আগামী দিনের কওমীর অভিভাবক। অতএব, ভয়ের কোন কারণ নেই। ভয়ের একমাত্র কারণ দারোয়ান ঘুমিয়ে গেলে। পরিশেষে আল্লামা ইকবালের ভাষায় বলবো-

کبھی اے نوجواں مسلم! تدبر بھی کیا تو نے؟

وہ کیا گردوں تھا، تو جس کا ہے اک ٹوٹا ہوا تارا؟

تجھےاس قوم نے پالا ہے أغوش محبتِ میں

کچل ڈالا تھا جس نے پاوُں میںتاج وسردارا