Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন সনদের জন্য আর্তি!

সনদের জন্য আর্তি!

।। ফরহাদ মজহার ।।

পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে কওমি মাদ্রাসার ছেলেরা স্যেকুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে দ্বীনি শিক্ষার স্বীকৃতি চায়, এর জন্য তো আমরা শফি হুজুরকে দোষারোপ করতে পারি না।

আধুনিকতার দোষে দুষ্ট কওমি তরুণদের একাংশের কারণে দেওবন্দী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কওমি মাদ্রাসা কোন দ্বীপ নয়, ফলে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় তার রূপান্তর ঘটতেই পারে।

কিন্তু দ্বীনি শিক্ষা ইসলামের দৃষ্টিতে একমাত্র আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি ছাড়া আর কারো স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশের মতো ইসলাম প্রধান দেশগুলোতে ঔপনিবেশিক শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এর চেয়ে শক্তিশালী কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা জনগণের নাই- এই সত্য শুধু আদর্শিক নয়, ব্যবহারিক রাজনীতি বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের দিক থেকেও বুঝতে হবে। এখানেই ফাটল ধরেছে; সেটা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক বিপদের কথা।

দ্বীনি শিক্ষাকে স্বাধীন ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্রের বাইরে সুরক্ষিত করবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন অতিশয়, আশু ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য। নির্বাচনী রাজনীতি ও ক্ষমতার জন্য লোলুপ আলেম ওলেমাদের চিনে রাখা দরকার, যারা হেফাজতের আন্দোলনকে ফ্যাসিস্টদের পায়ে নিবেদন করতে অতি উৎসাহী। দ্বীনি শিক্ষা এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেওবন্দী মাদ্রাসার ভূমিকা সম্পর্কে আলেম ওলেমাদের মধ্যে গঠনমূলক তর্ক আশা করি। এ দেশের জনগণকে তারা আশাহত করবেন না, এটাই প্রত্যাশা। ইসলামকে ফ্যাসিস্ট শক্তির গোলামে পরিণত করবেন না।

আপাতত পুঁজি কিম্বা পুঁজির তরফে আধুনিক রাষ্ট্র কীভাবে ধর্মের স্থান অধিকার করে- সেটা কওমি ছাত্রদের বোঝানোই আমাদের কাজ। যে আধুনিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা সনদ গ্রহণ করবে, সেই রাষ্ট্র আল্লাহকে নয়, নিজেকেই সার্বভৌম গণ্য করে। এটা এক নম্বর সমস্যা। এটা একজন আল্লাহ ভক্ত মাদ্রাসার ছাত্র কীভাবে মেনে নিতে পারে? এই পরিস্থিতিতে ধর্মতত্ত্ব ও রাষ্টবিজ্ঞান উভয় দিক থেকে ‘সার্বভৌমত্ব’ সংক্রান্ত তর্কে আমাদের প্রবেশ করা দরকার এবং ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন উভয় দিক থেকে তার মীমাংসা প্রয়োজন। কাউকে দোষারোপ করে লাভ নাই।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, যে সার্বভৌম শক্তির সনদ নিয়ে কওমি মাদ্রাসার তরুণরা ‘স্বীকৃত’ হবে, সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান নয়, বরং আল্লার বিকল্প আধুনিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। এই ‘স্বীকৃতি’র আকাংখা ধর্মশিক্ষা সম্পর্কে সমাজের হীনমন্যতারই প্রতিফলন। মাদ্রাসার ছেলেরা যদি এতে ‘সন্তুষ্ট’ হয় তাহলে এটাই বুঝতে হবে- সমাজে, আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিম্বা রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতি না পেলে তারা তাদের দ্বীনি শিক্ষাকে সম্পূর্ণ জ্ঞান করছে না। কিম্বা দ্বীনি শিক্ষাকে তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য তারা সুবিধাজনক জ্ঞান করে না। আফসোস!

তাহলে প্রশ্ন, মাদ্রাসায় পড়বারই দরকার কী? মাদ্রাসা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য গোলাম তৈয়ারির কারখানা নয়। এখন দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোকে কি আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সিলেবাস অনুযায়ী আধুনিক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হবে? বাংলাদেশের স্যেকুলাররা তো এটাই চায়। তাদের দাবি- মাদ্রাসা শিক্ষাকে ‘যুগোপযোগী’ করতে হবে। দ্বীনি শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক মারতে সবাই উৎসাহী।

সনদের জন্য আর্তি সেই কফিনের হাহাকার হয়েই দিগ্বিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে।