Home সম্পাদকীয় সমাজ ও রাজনীতি থেকে লজ্জার মৃত্যু ঘটেছে

সমাজ ও রাজনীতি থেকে লজ্জার মৃত্যু ঘটেছে

।। জিয়া হাসান ।।

যেকোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য লজ্জা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো অন্যায় করে বা চুরি করে বা লুট করে বা মিথ্যা বলে ধরা পড়ে, তখন সেটা নিয়ে সমাজে সমালোচনা হয়। তার ফলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লজ্জা পায়। এ কারণে তারা সেই কাজ আবার না করার এবং নিজেকে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বলপ্রয়োগ এবং আইন বাদে লজ্জা তাই সমাজের টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ শক্তি।

বিবর্তনের কারণে শুধু মানুষ নয়, প্রাণিজগতে যে প্রাণীগুলো দল বেঁধে চলে, তাদের মধ্যে লজ্জার সংস্কৃতি খুঁজে পেয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। কিছু কিছু প্রাণী, যারা একলা চলে, তাদের মধ্যে লজ্জার প্রবণতা কম। দলবদ্ধ প্রাণী হিসেবে মানুষের মাঝে শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিকভাবেও লজ্জার শক্তিশালী বোধ গড়ে উঠেছে, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয়।

প্রাক্‌ মানুষ যখন তৃণভূমিতে বিচরণ করত বা জঙ্গলে বাস করত, তখন কেউ প্রাণী শিকার করলে তাকে সেই শিকারের মাংস দলের সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হতো। আবার অন্যরা কেউ শিকার করলে, সে-ও শিকারের ভাগ পেত। কিন্তু কেউ যদি তার নিজের শিকার লুকিয়ে রাখত, তবে সেটা পরে জানাজানি হলে তাকে গোত্রের বাকি সদস্যরা তিরস্কার করত। তাই তিরস্কারের ভয় বা লজ্জা দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল।

অন্যায়কে লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক প্রত্যাখ্যানের এই শক্তি না থাকলে মানুষ একজন আরেকজনের সঙ্গে ক্রমেই বিভিন্ন রকম স্বার্থপর দ্বন্দ্বে মত্ত হতো এবং শুধু যুদ্ধ বা লড়াইয়ের মাধ্যমেই বিরোধের নিষ্পত্তি হতো। ব্যক্তির অন্যায় সামাজিক প্রত্যাখ্যান এবং লজ্জাদান তাই মানবজাতির এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

এখনো আমরা যখন একত্রে চলাফেরা করি, তখন অন্যদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার বা অন্যের প্রতি অন্যায় করার শাস্তি হিসেবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ভয় থাকে।

লজ্জার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োগও রয়েছে। একজন সরকারি কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণের একটি ভিডিও, একজন পুলিশ অফিসারের হাতে একজন নাগরিকের নির্যাতনের ভিডিও, একজন রাজনৈতিক নেতার একটি অন্যায় কাজের ফোনালাপের প্রমাণ অথবা একজন কন্ট্রাক্টরের কাজে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের ছবি সামাজিকভাবে অন্যায়কারীকে লজ্জা দেয়। সেই লজ্জার কারণে বাকিরাও একই কাজ করতে কিছুটা বিরত হয়।

উইকিলিকস বা ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ মুভমেন্টের প্রধান অস্ত্র সামাজিকভাবে লজ্জা দেওয়া।

কিন্তু লজ্জা পেতে হলে একজন ব্যক্তির মধ্যে লাখ লাখ বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট লজ্জা পাওয়ার শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক পরিবর্তনগুলো ঘটতে হবে। মস্তিষ্কে সেই রসগুলোর নিঃসরণ ঘটতে হবে। কিন্তু লজ্জা পাওয়ার ঘটনায় একজন ব্যক্তি বা কিছু ব্যক্তি বা একটি দলের মধ্যে সেই পরিবর্তনগুলো যদি না ঘটায় এবং বিভিন্ন কারণে তাদের লজ্জা পাওয়া ক্ষমতা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে সেটা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।

কারণ, ব্যক্তির লজ্জার প্রতিক্রিয়া না থাকলে শুধু আইন ও বিচার কখনো রাষ্ট্রে ন্যায্যতা আনতে পারে না। আইন হয়ে পড়ে শুধু বলপ্রয়োগের হাতিয়ার। লজ্জা একটি সামাজিক অস্ত্র এবং আইন একটি রাষ্ট্রীয় অস্ত্র। লজ্জা ও আইনের পাশাপাশি চলার কথা। লজ্জার প্রতিক্রিয়াবহির্ভূত আইনি বলপ্রয়োগ সমাজে জাস্টিস বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

শেম রেসপন্স বা লজ্জার প্রতিক্রিয়া সমাজ ও ব্যক্তির অনিবার্য শক্তি নয়। এর দুটি দিক আছে। এক. কিছু মানুষের মধ্যে লজ্জার পরিমাণ কম। কেউ কেউ লজ্জার পরিবর্তে লজ্জা পাওয়ার ভয়ে নিজেকে সংবরণ করেন। দুই. লজ্জা একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়, যাকে রাজনৈতিক, আইডিওলজি, ধর্ম, আচার–সংস্কার ইত্যাদি দিয়ে প্রভাবিত করা যায়। তাই লজ্জার ধারণাটি ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বদলেছে।

আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রের দিকে যদি তাকাই, তবে আমরা দেখি, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, সিদ্ধান্তগ্রহীতা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য লজ্জার মাত্রা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমাদের দেশের বিগত ১০ বছরে অনৈতিকভাবে ঋণ দিয়ে যেভাবে ব্যাংক লুট হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার উদাহরণ বিরল। কিন্তু এই খেলাপি ঋণধারীরা এবং ঋণের সিদ্ধান্ত যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা এখনো সম্মানজনক জীবন যাপন করেছেন, টিভিতে, মিডিয়াতে, সেমিনারে আলোচক হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। তাঁদের কোনো বিচার হচ্ছে না এবং তাঁরা লজ্জাও পাচ্ছেন না। এই লুটের ফসল সবার সমানে উপভোগ করে আবার নৈতিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে চলেছেন তাঁরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুলকে হাতুড়িপেটার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। যে ছাত্রনেতারা এই নির্যাতন করেছেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের সাক্ষাৎকার টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। দেখা গেছে, এমন ব্যাপক সামাজিক তিরস্কারের পরেও তারা কেউ অনুতপ্ত নন। বিবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক শেম রেসপন্স বা লজ্জার প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়নি।

আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই গত দিন বলেন এক কথা, পরের দিন তার সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেন। বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।’ তার মানে তাঁদের মধ্যেও শেম রেসপন্স বা লজ্জার পাওয়ার ক্ষমতা নাই হয়ে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক বা আদর্শের কারণে লজ্জার প্রতিক্রিয়াকে ভোঁতা করার বিষয়টি কোনো কোনো আদর্শের তাত্ত্বিক গুরুরা যৌক্তিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে একজন দার্শনিক লিও স্ট্রস। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, অধিকাংশ মানুষ ন্যায়পরায়ণ নয়। তাই কোনো ন্যায়পরায়ণ উদ্দেশ্য হাসিল করতে ন্যায়পরায়ণভাবে নিজেকে চালালে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মিথ্যা বলা বা অন্যায় কাজ করা যাবে। ফলাফল ভালো হলে সব অন্যায় গ্রহণযোগ্য, এই যুক্তি দিয়ে লিও স্ট্রসের অনুসারীরা গণতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো ধারণার ওপরে মিথ্যাচার ও অন্যায় আক্রমণের যৌক্তিকতা তৈরি করেন। মার্কিন রক্ষণশীল আন্দোলন এভাবেই মিথ্যাচারের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে।

‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’—এই যুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা তাদের আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাপ্ত শেম রেসপন্স বা লজ্জার ক্ষমতা ভোঁতা করে দেন এবং তাঁর মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতি সমর্থনের যৌক্তিকতা তৈরি করেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতেও লিও স্ট্রসের তত্ত্বের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। আমাদের উভয় দলের রাজনীতিবিদেরা ক্রমাগত বলে যান, বিরোধীরা যেহেতু একই অন্যায় করেছে, তাই আমাদের করা অন্যায়টিও যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য। এই বলে তারা অন্যায়টি সাধন করতে, চরম মিথ্যাচার, লুট এবং ধ্বংস করতেও লজ্জা পাচ্ছেন না।

এটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি। কারণ, কোনো রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে যদি বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী অংশগুলোর লজ্জা পাওয়ার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়, তবে সেই রাষ্ট্রে মিথ্যাচারের এবং অন্যায়ের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়, তাকে কোনো আইন, কোনো বিচার, কোনো প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে আনতে পারে না।

কারণ, ব্যক্তির সম্পদ বা ক্ষমতার লোভ বা কামনা বা প্রতিশোধ মনোবৃত্তি লাখ লাখ বছরের বিবর্তনে তৈরি—অস্তিত্ব রক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু ব্যক্তির এই প্রবৃত্তিগুলোকে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে সবার আগে লজ্জার অস্ত্র দিয়ে। এই জন্যই একজন ব্যক্তি চাইলেই আরেকজনের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে না। চাইলেই আরেকজনের কাছ থেকে সম্পদ কেড়ে নিতে পারে না। তাকে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করতে হয়।

কিন্তু এই লজ্জার প্রতিক্রিয়া যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়, ব্যক্তি যখন দেখে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তগ্রহীতারা চরম মিথ্যা বলতে, অন্যায় করতে লজ্জা পায় না। তখনো সমাজেও লজ্জার প্রভাব ম্লান হতে থাকে। বিগত কয়েক দশকে আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রে এভাবে ধীরে ধীরে লজ্জার মৃত্যু ঘটেছে। পচন উঁচু থেকে ক্রমাগত নিচে নামছে। একসময় কোনো পরিবারে ঘুষখোর থাকলে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হতো। কিন্তু এখন ঘুষখোর পাত্র নিয়ে কোনো পক্ষের আপত্তি থাকে না। এটা একটা ভয়ংকর অবনতি।

যে সমাজে লজ্জার মৃত্যু হয়েছে, সেই সমাজে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে আন্তবিরোধে পশুদের মতো ক্রমে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা প্রাকৃতিক অনিবার্যতা। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি লজ্জাকে বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে একটা লজ্জাহীন লুটপাটের সমাজ গড়ব? নাকি লজ্জাকে পুনরায় একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে তৈরি করে ন্যায়ভিত্তিক সুষম বণ্টনের সমাজ গড়ে তুলব।

[বৈরুত ইউনিভার্সিটির আরকিওলজি এবং ইতিহাসের শিক্ষক প্রফেসর পিটার ডরমেনের ‘দ্য ডেথ অব শেম’–র বক্তৃতার আলোকে]

– জিয়া হাসান: প্রাবন্ধিক।

ভোট পর্যবেক্ষকদের মুখে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন