Home ইতিহাস ও জীবনী রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুমহান মর্যাদা

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুমহান মর্যাদা

।। মুফতী মুনির হোসাইন কাসেমী ।।

ইসলাম একটি ধর্ম, মুসলমান একটি জাতি। আল্লাহ তাআলা এ ধর্ম ও জাতির সৃষ্টিকর্তা আর কুরআনুল কারীম হল সে জাতির সংবিধান বা আইন গ্রন্থ। এর বাইরে কোন ধর্ম, কোন জাতি, কোন বিধান ও কোন প্রভু স্বীকৃত নয়। আর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী বা শেষ নবী। তাঁরপর কোন নবী বা রাসূল এ পৃথিবীতে আসবেন না, এটাই আল্লাহ তাআলার ঘোষণা “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে আজ পরিপূর্ণ করে দিলার”-এর মর্মকথা।

যখন আল্লাহ তাআলার কুদরতী অস্তিত্ব ব্যতীত সৃষ্টিজগতের কোন নাম-গন্ধও ছিল না, তখনই তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবকে সৃষ্টি করে প্রথম সৃষ্টির মর্যাদা দান করেন এবং সেই প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমেই নবুওয়্যাতের পরিসমাপ্তি ঘটান। অর্থাৎ তাঁর পূর্বে যেমন কোন নবী সৃষ্টি হননি তেমনি তাঁর পরেও আর কোন নবী বা রাসূল হবেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবের শানেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এতে পরিস্কার হয়ে যায়, আল্লাহ তাআলার পরেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা তথা স্থান। এতদ্ভিন্ন আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবের মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে পবিত্র কুরআনের কোথাও ‘ইয়া মুহাম্মদ’ বলে একটিবারও সম্বোধন করেননি। অথচ কুরআনে বর্ণিত সকল নবী-রাসূলগণকেই আল্লাহ তাআলা তাঁদের নাম ধরে ডেকেছেন। এতে করেও রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমহান মর্যাদা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়।

তাছাড়া মানব জাতির মুক্তির দূত, সরদারে দো’জাহাঁ, তাজদারে মদীনা, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পূর্ব মুহূর্তে এবং পরবর্তী সময়ে দুনিয়ায় যে পরিবর্তনগুলো সংঘটিত হয়েছে, তা যেমন ছিল অলৌকিক তেমনি ছিল বিস্ময়কর। যেমন, পারস্য রাজের হাজার বছরের অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হওয়া, রাজপ্রাসাদের গম্বুজ ভূপাতিত হওয়া এবং আবরাহার হস্তিবাহিনী আবাবিল পাখীর দ্বারা ধ্বংস হওয়া ইত্যাদি অসংখ্য ঘটনা ইতিহাস হয়ে আজও দুনিয়ার বুকে সাক্ষ্য বহন করছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পূর্ণ জীবনটাই যে আল্লাহ তাআলা অলৌকিক ঘটনার চাদরে আবৃত করেছেন, তার আরো প্রমাণ হল, আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন জীবন। সম্পূর্ণ উম্মী থেকেও তিনি ছিলেন সারা বিশ্বের শিক্ষক। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবের সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে দুনিয়ার কোন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেননি, নিজে পাঠশালা খোলেন হেরার গুহায়। সেখানেই তিনি কুদরতীভাবে শিক্ষা দান করতে থাকেন প্রিয় হাবীবকে। এসবই হয়েছিল তাঁর একক সুমহান মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার প্রেক্ষিতে।

আল্লাহ তাআলা মি’রাজ শরীফ দিদার নসীব করে অপরাপর পয়গাম্বরগণ হতে স্বতন্ত্র ও উচ্চ মর্যাদাশীল মর্তবা প্রদান করেছেন প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। এই মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল স্বশরীরে। যা অন্য কোন নবী-রাসূলের ভাগ্যে জোটেনি। এর কারণ, যেহেতু আখেরী নবীর পরে আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না এবং নবুওয়্যাতের দরজাও রোজ ক্বিয়ামত পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হবে, সেহেতু পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পরকালে ঘটিতব্য বিষয়গুলো বাস্তব নিরিখে দেখে এসে যাতে দুনিয়ার মানুষের কাছে বর্ণনা করে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করাতে পারেন এবং নিজেও বাস্তব অভিজ্ঞতায় আশ্বস্ত হয়ে উম্মতকে বোঝাতে পারেন, যাতে বান্দার কৈফিয়তের কোন পথ খোলা না থাকে।

মূলতঃ এই জন্যই মি’রাজের আয়োজন। তৎকালে স্বশরীরে এই মি’রাজ এক রাতে সংঘটিত হবার ব্যাপারে দ্বিমত বা অসম্ভাব্যতার প্রশ্ন দেখা দিলেও বর্তমান বিজ্ঞানের চরম উন্নতির নিরিখে তা মোটেও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় না। কারণ, আল্লাহ প্রদত্ত মেধা দ্বারা বিজ্ঞানের আবিস্কার টেলিভিশনই তার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আধুনিক বিজ্ঞানের ফসল টেলিভিশন বাংলাদেশে সেট করে ডিস এ্যান্টিনা লাগিয়ে লন্ডন বা আমেরিকার স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানের শব্দ, ছবি যদি এক সেকেণ্ডে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রদর্শিত হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শে মুআল্লায় তুলে নিয়ে সপ্ত আসমান, বেহেশ্ত, দোযখ ও আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি রহস্য দর্শন করিয়ে একই রাতে দুনিয়াতে পৌঁছানো মহাবিজ্ঞানী সেই আল্লাহর কাছে মোটেও অসম্ভব নয়।

যাহোক, মি’রাজ রজনীতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম র্আশে মুআল্লায় পদার্পণ করে যখন পায়ের জুতা মুবারক খোলার উপক্রম করেন, তখন আওয়ায ভেসে এল, হে আমার প্রিয় হাবীব! জুতা খুলবেন না, জুতা পরেই আমার সান্নিধ্যে এগিয়ে আসুন। অথচ আল্লাহর নবী মূসা (আ.) যখন আল্লাহর আহ্বানে ‘তূর’ পর্বতে আরোহণ করতে যান, তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, জুতা খুলে আরোহণ করুন। পাঠক, চিন্তা করুন! কোথায় ‘তূর’ পর্বত আর কোথায় র্আশে মুআল্লা!!

মি’রাজে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়ে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে হাদিয়া পেশ করে বলেন- “আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু ওয়াত্ তায়্যিবাত”। জবাবে আল্লাহ তাআলা এই বলে হাদিয়া কবুল করেছিলেন, “আস্সালামু আলাইকা আয়্যুহান্ নাবিয়্যু ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ”। এই বাক্য দু’টিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই নামাযের প্রতি বৈঠকে বান্দার উপর অবশ্য পঠিতব্য করা হয়েছে। এখানেও আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবের নাম উচ্চারণ করে বলেননি “ইয়া মুহাম্মদ”। বলেছেন, “আয়্যুহান্ নাবিয়্যু”। এ রাতে উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। এই নামাযও ছিল রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেওয়া তাঁর উম্মতের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে হাদিয়া বা উপঢৌকন স্বরূপ।

চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করণের ঘটনা রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমহান মর্যাদার আর একটি প্রামাণ্য অলৌকিক দলীল। যমীনে বসে আকাশের চাঁদকে হাতের ইশারায় দুই খণ্ড করে দেখানো কোন সাধারণ অলৌকিক ঘটনার মধ্যে পড়ে না। এটাও তাঁর শানে আল্লাহ তাআলারই কুদরতের নিদর্শন। এখানেই শেষ নয়, হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে আগমন করেছেন এবং তাঁদের উপর যত আসমানী কিতাব বা সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল, সবগুলোতেই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে, যা অন্য কোন নবী-রাসূলের বেলায় হয়নি। এতেও তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদা ও তিনি যে স্রষ্টার প্রথম সৃষ্টি, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়।

আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হল, পৃথিবীতে ইসলাম ছাড়া যত ধর্মমত ও ধর্মগ্রন্থ আছে সেখানেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উচ্চ প্রশংসার সাথে তাঁর আগমন বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের আনুমানিক দুই আড়াই হাজার বছর আগে রচিত হিন্দু ধর্মের বেদগ্রন্থে তাঁর জন্ম থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী এমন নিখুঁত ও ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা পাঠ করলে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না।

কিন্তু এত কিছু সম্যক প্রমাণ থাকার পরও সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবকে তাঁরই কিছু পথভ্রষ্ট উম্মত ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মেতে উঠেছে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, হাজার হাজার বছর আগের সমস্ত মতবাদ বর্তমান যামানার কিছু উইপোকার কাছে ভ্রান্ত বলে ধরা পড়ে গেছে। আর সেই কথিত ভুল আবিষ্কার (!) করার আনন্দে তারা বলে বেড়াচ্ছে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন সন্ত্রাসী (নাঊযুবিল্লাহ), ইসলাম কোন ধর্মমত নয় ইত্যাদি।

আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, তাওহীদবাদী ৯৫% মুসলমানের দেশে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মহামানব এবং ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক, মুসলমানদের আত্মার আত্মীয়, যিনি বান্দার জন্য প্রেরিত আল্লাহর পক্ষ থেকে রহ্মত স্বরূপ, সেই মহাপবিত্র আল্লাহর হাবীবের বিরুদ্ধে কতিপয় ধর্মদ্রোহী দুরাচার তাদের অপবিত্র যবানে যে ধরনের কটুক্তি করে চলেছে বিরামহীনভাবে, তা শুধু অমার্জনীয়ই নয়, অসহনীয়ও বটে। অথচ বার কোটি মুসলমান এদেশে জীবিত থাকতে সেসব বিকৃত রুচির ধর্মদ্রোহী-মুরতাদ কুলাঙ্গার সম্প্রদায় তাদের অক্ষত যবান নিয়ে আজও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কিছু করছে না, কিছু বলছে না, সবাই নিশ্চুপ, যেন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা যাঁর আদব রক্ষা করতে একটি বারের জন্যও নাম ধরে ডাকলেন না, সেই মহামানবের কুৎসা রটায় মুসলমান নামেরই কিছু নর্দমার কীট, আর নবীপ্রেমিক মুসলমানরা ঈমানের দাবী নিয়ে ঘরে বসে আছে। প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা তো নেই-ই, প্রতিবাদের কণ্ঠও সংকোচিত হয়ে পড়েছে, এই হল মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা। যে জাতি তার নিজের মর্যাদা নিজে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয় না, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। সম্ভবতঃ মুসলমানরা আজ সেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শরীফে মুসলমানদের মাথা উঁচু করে পৃথিবীর বুকে চলার যে দিক নির্দেশনা দান করেছেন, অন্য কোন জাতির ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মবেত্তাগণ তাদের কওমকে সেরূপ কোন দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম হয়নি। তার কারণ, তারা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন পরগাছা, আর পরগাছা সব সময়ই পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে। অথচ সেই পরনির্ভরশীল পরগাছাই আজ একতাবদ্ধ হয়ে মূলের উপর আঘাত হেনে চলেছে। আর যারা মূল রূপে চিহ্নিত, তারা ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই অবস্থান নিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকেই বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার হুঁশিয়ারী, “তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে মজবুত করে ধর এবং একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। (সূরা ইমরান)। “হে মানব জাতি, তোমরা যখন কোন দলের মোকাবেলা করতে যাও, তখন তোমরা অটল থেকো”। (সূরা আন্ফাল)।

এ হুঁশিয়ারীর অর্থ শয়তান অপেক্ষা মানুষ অতি দুর্বল। তাই মানুষ যদি জোটবদ্ধ হয়ে শয়তানের মোকাবেলা না করে, তাহলে তারা শয়তানের জাল ছিন্ন করে লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে না। সর্বজ্ঞানের আধার আল্লাহ তাআলার এই নির্দেশ পালনের মাধ্যমেই বান্দার সার্বিক মঙ্গল নিহিত। অথচ মুসলমানরা আজ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনছে। যে মহামানবের শানে আল্লাহ তাআলা নিজে দরূদ পাঠান এবং বান্দাকে দরূদ পাঠাতে তাগাদা দেন, তাঁর পায়ের ধূলির সমতুল্য মর্যাদা কি কোন মাখলুকের হতে পারে? না, পারে না। অথচ সেই মানবশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হবার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যবান হয়েও মুসলমানরা তাঁকে এবং তাঁর সুন্নাতকে অবজ্ঞা, অবহেলা, অবমূল্যায়ন করে প্রকারান্তরে নিজেদের মর্যাদার প্রতিই ঘৃণা পোষণ করে চলেছে।

যে দয়ার নবী শুধু মানব জাতির জন্যই ব্যথিত ছিলেন না, জীব-জন্তুর প্রতিও ছিলেন সমান দয়ার্দ্র, তিনি ইরশাদ করেনঃ “হে মানুষ সকল! তোমরা মাছ খেয়ে তার কাটা ও হাড় পানিতে নিক্ষেপ করো না। যদি তা কর, তাহলে ঐ হাড় ও কাটা যাদের খাদ্য, সেই কুকুর ও বিড়াল তা খেয়ে তৃপ্তি পাবে না বা মজা পাবে না”। সুব্হানাল্লাহ! সামান্য কুকুর-বিড়ালের জন্য যাঁর এত মুহাব্বত, মানুষের জন্য তাঁর মুহাব্বত পরিমাপ করা যায় কি?

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বগুণের সমন্বয়ে গঠিত একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ মহামানব। তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, যুদ্ধনীতি এবং আরো যত নীতি আছে তার সবগুলোতেই ছিলেন পারদর্শী। এই সর্বমুখী পারদর্শিতাও তাঁর একক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা অন্য কোন নবী-রাসূলের মধ্যে এতগুলো গুণের সমন্বয় একত্রে ঘটাননি। এটাও তাঁর সুমহান মর্যাদারই এক অনন্য প্রমাণ। যার কারণে, বিশ্বের এমন একজন মহামনীষী নেই যিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানবশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে আখ্যায়িত করেননি।

ঐতিহাসিক, গবেষক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল এইচ, হার্ট একদল গবেষক নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণার পর বিশ্ব ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী একশত ব্যক্তিত্বকে বাছাই করে ইসলাম ধর্মের স্থপতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে নির্বাচিত করে, বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার “দি হান্ড্রেড” গ্রন্থে প্রথম স্থান দান করেন। মজার ব্যাপার হল, উক্ত গ্রন্থের লেখক ও প্রকাশক উভয়েই খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি তার গ্রন্থের শুরুতে উল্লেখ করেন, ‘দি হান্ড্রেড’ গ্রন্থে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় মুহাম্মদ (সা.)এর নাম প্রথমে রেখেছি বলে অনেক পাঠকই আশ্চর্য হতে পারেন।

কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে সর্বাধিক সফল ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম অতি সাধারণ পরিবারে, অথচ তিনি বিশ্বের প্রধান ধর্মের প্রবর্তক এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেন পৃথিবীর সর্বাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর তের শত শতাব্দীর পরে আজও তাঁর প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী ও ব্যাপক”।

মাইকেল এইচ হার্ট শুধু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেননি, ইসলাম ধর্মকেও প্রধান ধর্ম বলে স্বীকৃতি দান করেছেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সেসব ঐতিহাসিক বা অন্যান্য ধর্মের বিখ্যাত মনীষীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা বা মূল্যায়ন করেছেন বলেই তিনি শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেছেন। বরং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৌলিক গুণাবলী ও ব্যক্তিত্বই সেসব ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে সত্য প্রকাশে বাধ্য করেছে। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একক বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ তাআলা শুধু তাঁর প্রিয় হাবীবকেই দান করেছেন। আর এই দানের কারণ হচ্ছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদায় আসীন করা।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরো একটি উচ্চ মর্যাদা আল্লাহ তাআলা দান করেছেন। তা হল, তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে বিশ্বের সকল মানব জাতির ও জীব-বন্তুর রহ্মত স্বরূপ। এই রহ্মতের প্রমাণ স্বরূপ আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছেন, তাঁর হাবীবের উম্মতের উপর কোন বড় ধরনের গযব পাঠাবেন না। বিশ্ববাসী কি তার প্রমাণ আজও পায়নি? আজ মানুষ যেভাবে পাপে ডুবে থেকেও বহাল তবিয়তে বিচরণ করছে, তা কার উসীলায়? সামুদ জাতি কি পাপ করে আল্লাহর গযব থেকে নিস্তার পেয়েছিল? নিস্তার পেয়েছিল কি কওমে লূত? নূহ (আ.)এর কওমের পরিণতির কথা কি মুসলমানরা অবগত নয়? অতীতের যে সব জাতিকে আল্লাহ তাআলা গযব পাঠিয়ে ধ্বংস করেছিলেন, তাদের তুলনায় বর্তমানে দুনিয়াতে কি পাপ কম হচ্ছে, না বেশী? শুধু বেশী নয়, কয়েক শত গুণ বেশী বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু তবু কেন আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করছেন না, কার উসীলায়? এতটুকু বোধশক্তি কি মুসলমানদের নেই? যদি না থাকে, তাহলে তাদের জন্য আফ্সোস করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আঘাত বেদনা ছাড়া কািখত বস্তু লাভে আসে না আনন্দ। অর্থাৎ যে বস্তু সহজ লভ্য বা হাসিল করতে কষ্ট করতে হয় না, সে বস্তুর উপর মায়া-মুহাব্বত থাকে না। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করতে বর্তমান যুগের মুসলমানদের রক্ত ঝরাতে হয়নি। এরা জন্মসূত্রে মুসলমান, ইসলামের গুরুত্ব এবং মুসলমানদের মর্যাদা সম্বন্ধে তারা উদাসীন হবে বৈ কি। তাই বিশ্বের একমাত্র সত্য ও শ্রেষ্ঠ ধর্মের সদস্য এবং শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হয়েও তাদের মধ্যে রাসূলের মর্যাদাহানির কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। কাফির-মুশরিকদের হাতে মার খাওয়ার কথা শুনেও তাই তারা দাঁত বের করে হাসে। যাদের মধ্যে এখনো কিছু ইসলামী অনুপ্রেরণা কাজ করছে, তারাও ক্রমশঃ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ যে যাই বলে বলুক, যে যাই করে করুক, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কিন্তু এই নীতি গ্রহণ করে যে নিজেকে বাঁচানো যাবে না, বাপের নামও অক্ষুণ্ন থাকবে না, এ কথাটা তাদের বোঝাবে কে?

মুসলমানরা যদি ভুলে না যেত, অতীতের নবীগণ নবী না হয়ে যে নবীর উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে দরখাস্ত করেছিলেন, বিনাপ্রার্থনায় আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই নবীর উম্মত হবার সৌভাগ্য দান করেছেন। মুসলমানরা যদি একটু খেয়াল করে চিন্তা করত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এত মুহাব্বত করেন, যার প্রেক্ষিতে বনী ইসরাঈলের নবীদের যে মর্যাদা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের আলেমদেরও সেই মর্যাদা দান করেছেন। অথচ সেই দ্বীনের রাহ্বার আলেম সমাজ আজ বেদ্বীন মুরতাদদের হাতে কতই না নিগৃহিত, নির্যাতিত হয়ে চলেছেন। আজ যদি মুসলমানরা সচেতন হত, তাহলে হাত পা গুটিয়ে বসে মার না খেয়ে মার দিয়ে শহীদ হতে কার্পণ্য করত না।

ভাবতে অবাক হতে হয়, ইসলামের মত অমূল্য রত্ন পেয়েও আজ আমরা তার অবমূল্যায়ন করে চলেছি। এই অবমূল্যায়নের পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তা যদি আমাদের বোধগম্য হত, তাহলে যে যবানে সেই রত্নকারের অবমাননা হয়, সে যবান ছিঁড়ে ফেলার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। শুধু মুখে হা হুতাশ করে বুক চাপড়ালেই রাসূল প্রেমিক হওয়া যাবে না অথবা বছর শেষে ময়দানে মঞ্চ সাজিয়ে সীরাতুন্নবী পালন করে কিছু আলোচনা করলেই নবীর প্রতি মুহাব্বত দেখানো হবে না, যদি না তাঁর রঙে রঞ্জিত হয়ে তাঁর সুন্নাতের পায়রবী করে প্রিয়নবীর সুমহান মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই মর্যাদাকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা তখনই আশেকে রাসূল হতে পারব যখন আমাদের সীরাতে-সূরতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত শোভা বর্ধন করবে এবং আমাদের সীনায় নবীর মুহাব্বত উথলে উঠবে। এ ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সে বুঝ দান করুন। আমীন।।

লেখক: ফাযেলে- দারুল উলূম দওেবন্দ (দাওরা ও ইফতা), মুফতী ও মুহাদ্দসি- জাময়িা মাদানয়িা বারধিারা, ঢাকা এবং উপদষ্টো সম্পাদক- উম্মাহ ২৪ডটকম।

“আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা” – মুফতী মুনির হোসাইন কাসেমী