Home ইতিহাস ও জীবনী ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বা তথাকথিত ‘আধুনিক রাষ্ট্র বনাম ভাসানীর গণশক্তি’ ও নতুন...

ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বা তথাকথিত ‘আধুনিক রাষ্ট্র বনাম ভাসানীর গণশক্তি’ ও নতুন সমাজ

।। ফরহাদ মজহার ।।

আজ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। আমি নিশ্চিত খুব কম পত্রিকাই তাঁকে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শ্রমিক ও কৃষক বিদায় নিয়েছে অনেক আগে। এখন যে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার তোড়জোড় চলে, সেখানে তারা শুধু অনুপস্থিত নয়, তাদের হাড় এবং করোটির ওপর নৃত্য চলছে ভূতের। কারণ, আমরা ইতিহাস ভুলে গিয়েছি।

ভোট দিয়ে রাষ্ট্রের ‘মালিক’ হওয়া এবং ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ কায়েমের ফালতু তত্ত্বগিরি মওলানা ভাসানী এবং শেখ মজিবর রহমান কেউই কখনও করেননি। ছয় দফা এবং ১১ দফা খুবই সুনির্দিষ্ট দাবি এবং সেই দাবি আদায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনা গড়ে উঠেছিল। জনগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছে এবং তা কায়েম করেছে। সুনির্দিষ্ট দাবির কারণেই আগরতলা মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী শাসকরা বিচার করতে পারেনি। আইনী লড়াইয়ের ওপর ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হোত। শেখ মুজিবরকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার ক্ষেত্রে মাওলানা ভাসানী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ও গণ অভ্যূত্থান মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বেই দানা বেঁধেছিল। ভাসানী আন্দোলনে নেতৃত্ব না দিলে শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফেঁসে যেতেন। ইতিহাস ভিন্ন হোত।

শুধু ‘ভোট’ দিলেই জনগণ রাষ্ট্রের ‘মালিক’ হয়ে যায় এই তত্ত্ব গণপ্রতারণার দিক থেকে অতি নিম্ন শ্রেণীর রাজনীতি। অন্যদিকে ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে, জাতীয় সম্পদের ওপর জনগণের কোন অধিকার নাই, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের সুবিধা এক তরফা ধনি শ্রেণি পাচ্ছে, ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, প্রশাসন বা উন্নয়ন পরিকল্পনার কোন স্তরেই জনগণ নাই। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উৎখাত করে ঢাকা কেন্দ্রিক একতরফা ক্ষমতার চর্চা এবং জনগণকে ঋণী করে ‘উন্নয়নের মহাসড়ক’-এর জিকির গাওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের অল্প কয়দিন বাকি, কিন্তু বিক্ষিপ্ত মন্তব্য ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট্রের ফাইনাল ইশতেহার এখনও আলোর মুখ দেখে নি। কিন্তু আমরা ভোট দিয়া রাষ্ট্রের মালিক বনে যাব!

ধনি শ্রেণির সবচেয়ে শক্তিশালী বলপ্রয়োগের হাতিয়ার হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে বিদ্যমান ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণকে অবশ্যই পালটা ‘গণশক্তি’ হিশাবে পরিগঠিত হতে হবে।

তাই আমাদের কথা পরিষ্কার। ভোট বা ব্যালটবাক্স কেন্দ্র করে নির্বাচনের দিন জনগণের ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতার রূপ যতোটা আমরা দেখব, ঠিক ততোটাই গণশক্তির মাত্রা বোঝা যাবে। বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ভোটের রাজনীতির এই সুযোগটুকু আমরা হাতছাড়া করার পক্ষে না। কিন্তু ভোট দিলেই জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হয়ে যায় বা ‘জনগণ রাষ্ট্রের মালিক’ — এই ধরণের চরম প্রতারণামূলক তত্ত্ব আমরা গ্রহণ করি না।

জয় হোক মওলানা ভাসানীর। তিনি আধুনিক কেন্দ্রীভুত রাষ্ট্র কায়েমের জন্য লড়েননি, বরং লড়েছিলেন নতুন ধরণের ‘সমাজ’ গড়বার জন্য, যে সমাজে রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় না, বরং তার বিলয় ত্বরান্বিত হয়।

আজ সমাজ ও গণক্ষমতা নিয়ে নতুন করে ভাবার হিম্মত অর্জন এবং বাংলাদেশে নতুন ধরণের রাজনীতির আবির্ভাব কামনা করছি। তার জন্য যথোপযুক্ত রাজনৈতিক চর্চার অঙ্গীকার করে আমরা আজ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করব।

-ফরহাদ মজহার, কবি ও বুদ্ধিজীবী।