Home অর্থনীতি কিছু টাকা আছে, কোথায় বিনিয়োগ করবেন?

কিছু টাকা আছে, কোথায় বিনিয়োগ করবেন?

।। সাইফুল হোসেন ।।

অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর, একটি ছেলে আমাকে থামালো, জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম কি সাইফুল হোসেন?’ আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে ছেলেটি জানতে চাইল সে আমার সাথে কথা বলতে পারে কিনা। ছেলেটিকে আমি চিনিনা। মনে হল সে একজন ছাত্র। তার ভদ্র আচরণ দেখে কথা বলতে চাইলাম। জেনে ভাল লাগলো যে ছেলেটি আমার ইউটিউব চ্যানেল ‘ফিনফ্যাক্টস’ নিয়মিত দেখে।

‘আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে’, ছেলেটি বলল। আমি কি সূচক প্রশ্ন করতেই সে বলল, ‘স্যার, আমার কাছে কিছু টাকা আছে আমি এটা কোথায় বিনিয়োগ করতে পারি?’ তখন আমি তাকে বললাম, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ তুমি এই বিষয় সচেতন হয়েছো এবং আমাকে পথের মধ্যে দাঁড় করিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছ।

আসলে এই প্রশ্ন শুধু ওই ছেলেটির নয়, এই প্রশ্ন অসংখ্য মানুষের। যারা কিছু টাকা জমিয়েছেন তারা সেই টাকাটা কোথায় বিনিয়োগ করবেন। যারা চাকরি থেকে বের হয়েছেন কিছু জমা টাকা আছে সেই টাকা কী করবেন? যারা রিটায়ার করে বেরিয়েছেন তাদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট হিসেবে অনেক টাকা পেয়েছেন, সেই টাকা নিয়ে তারা কী করবেন? সবাই খুব সহজেই যে কাজ করতে পারেন সেটা হচ্ছে টাকাটা ব্যাংকে জমা রাখতে পারেন, সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন, এই দুটো হচ্ছে মোটামুটি ঝুঁকিহীন। কিন্তু এটা সেই অর্থে কোন বিনিয়োগ নয় কারণ বিনিয়োগ এর সাথে দুটি দিক জড়িত থাকে। একটা হচ্ছে ঝুঁকি এবং আরেকটি হচ্ছে উচ্চ ও অনির্ধারিত বেনিফিট বা লাভ।

বিনিয়োগে যেমন অনেক বেশি বেনিফিট জড়িত তেমনি অনেক বেশি ঝুঁকিও জড়িত। তাই যখন আপনার জমা টাকা কোথাও বিনিয়োগ করার কথা ভাববেন, তখন সাবধান হতে হবে এবং কোথাও বিনিয়োগ করার আগে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবচাইতে বড় যে প্রয়োজন সেটা হচ্ছে আপনার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে যাত্রার জন্য আপনাকে প্রথমেই ফিন্যানসিয়ালি লিটারেট হতে হবে, টাকা ম্যানেজ করার জ্ঞান থাকতে হবে, টাকা বিনিয়োগ করার জ্ঞান থাকতে হবে কারণ আমাদের দেশে এখনো পার্সোনাল ফাইন্যান্স এক্সপার্ট, ফিন্যানসিয়াল কাউন্সিলর, ফিন্যানসিয়াল কনসালটেন্ট যাদের কাছ থেকে আপনি বুদ্ধি পরামর্শ করবেন তাদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। সেজন্য যদি আপনি স্বশিক্ষিত হতে পারেন তাহলে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কোথায় নিজের টাকাটা বিনিয়োগ করবেন। (এই ব্যাপারে আপনি আমার ইউটিউব চ্যানেল ফিনফ্যাক্টস (finfacts) দেখতে পারেন কারণ আমি ওই চ্যানেলটিতে এই সংক্রান্ত ভিডিও আপলোড করি নিয়মিত)।

কারণ আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে চান তাহলে শুধু সঞ্চয় করলে হবে না, সঞ্চয় একটা নেশার মত। সঞ্চয় করছেন তো করছেন, সঞ্চয় করে আপনার কয় টাকা আসবে, যদি সেই টাকা আপনি বিনিয়োগ করতে না পারেন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করে সেইভাবে পোর্টফোলিওকে সাজাতে না পারেন?

এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরী যে, যখন আপনি আপনার সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের কথা চিন্তা করবেন তখন প্রথমেই ভাবতে হবে, ‘আপনার বয়স কত?’ ‘আপনার বয়স কি ত্রিশ এর মধ্যে?’ “আপনার বয়স কি ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যে, ৫০ থেকে ৭০ এর মধ্যে’ নাকি ‘৭০ এর উপরে?’ আপনার বয়স যদি ৩০ এর মধ্যে হয় তাহলে আপনার পোর্টফোলিওতে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ বেশি থাকলে অসুবিধা নেই। কারণ বয়স যত কম ঝুঁকি তত বেশি নেয়া যাবে। বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত আপনি যে ঝুঁকি নিতে পারবেন ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত সেই পরিমাণ ঝুঁকি আপনি নিতে পারবেন না। তারপর যখন ৫০ থেকে ৭০ এর মধ্যে চলে যাবেন তখন ৩০ এর নিচে যেমন আপনার ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা ছিল, তখন ঠিক তার উল্টো হবে। এই সময় ঝুঁকিপূর্ণ ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ কমে যাবে।

আর যখন আপনি ৭০ ছাড়িয়ে যাবেন তখন আপনাকে আর ঝুঁকি নিতে হবে না, কারণ তখন আর আপনি সেই ঝুঁকি নেয়ার বয়সে থাকবেন না। তখন আপনার পুরো টাকা এক জায়গায় করে, কিছু টাকা ব্যাংকে, কিছু টাকা সরকারী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে রাখুন।

এখন ধরুন আপনার বয়স ৩০-এর মধ্যে এবং আপনার কাছে ১০ লাখ টাকা আছে, এই টাকাটা আপনি কোথায় বিনিয়োগ করবেন? বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্ট এর যেগুলো ভেইকেল আছে, তার থেকে উন্নত বিশ্বের ভেইকেলের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের ইকুইটি মার্কেট আছে, কমোডিটি মার্কেট আছে, ম্যাচিউরড শেয়ার মার্কেট আছে, তাদের প্রোপার্টি মার্কেটও খুব সুন্দর এবং সুগঠিত। কিন্তু বাংলাদেশের যতগুলো ক্ষেত্র আছে তার মধ্যে একটি হলো আপনি আপনার টাকা ব্যাংকে রাখতে পারেন। ব্যাংকে টাকা রাখলে শুধুমাত্র আপনার ইনফ্লেশনের ক্ষত কাভার হয়। তাছাড়া আপনি টাকা রাখতে পারেন সরকারি সঞ্চয়পত্রে, ব্যাংকের বিভিন্ন স্কিম আছে, স্টক মার্কেট আছে, আইসিবি ইউনিট আছে, চাইলে প্রোপার্টিতেও ইনভেস্ট করতে পারেন। কিন্তু এর চেয়ে আর বিশেষ কোন খাত আসলে নেই। আমাদের এখানে আপনি ফরেন কারেন্সিতে ইনভেস্ট করতে পারবেন না। কারণ আমাদের দেশে ফরেন কারেন্সিতে ইনভেস্টমেন্ট বৈধ নয়।

আরও পড়তে পারেন-

এখন ভাবতে হবে এর মধ্যে সেফ ইনভেস্টমেন্টের জায়গা কোনটা কোনটা? আমি বলেছি আগেই, যদি আপনি ব্যাংকে টাকা রাখেন বা যদি সরকারি সঞ্চয়পত্র রাখেন এইটা আপনার নিরাপদ। তবুও আরেকটা বিষয় বলা জরুরি যে ব্যাংকে টাকা রাখার ক্ষেত্রেও একটু চিন্তা করতে হবে। কিছু ব্যাংক এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। আপনি ইন্টারনেটে সার্চ দিলে বুঝবেন কোন কোন ব্যাংক প্রবলেমের মধ্যে আছে তাহলে ভালো ভিত্তি দেখে ভালো ব্যাংকে আপনার টাকা রাখা ভালো। শুধুমাত্র রেট একটু ভালো দিলেই যে আপনি যেকোনো একটা প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখবেন সেটা ঠিক হবে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোন বেসরকারি সমিতি আছে সেখানে।

এরপরে স্টক মার্কেট আছে, সেখানে আপনি বিনিয়োগ করতে পারেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ খুবই দেখেশুনে ও বুঝে করতে হবে। আপনার জানতে হবে, অল্প কিছু হাতেগোনা শেয়ার আছে যাদের মৌলভিত্তি খুবই ভাল। কিন্তু এখন দেখবেন যে, অনেক ক্ষেত্রে যেসব শেয়ারের দাম বাড়ছে যেসব শেয়ারের মৌলভিত্তি ভালো না। কারণ এখানে কোন একটা প্রবলেম আছে। কিন্তু এই প্রবলেম যদি চিহ্নিত না করতে পারেন তাহলেই আবার প্রবলেম আছে। আপনি লোভে পড়ে সেখানে ইনভেস্ট করলেন এবং দেখলেন আপনার লাভ তো হচ্ছেই না বরং মূলধন হারিয়ে ফেললেন।

যখন স্টক মার্কেটে ইনভেস্ট করবেন, লং টার্মের জন্য করবেন এবং সব চাইতে ভাল মৌলভিত্তির শেয়ার যেগুলো আছে সেটাতে করবেন। হয়তো শেয়ার এর দাম রাতারাতি বাড়বে না, কিন্তু প্রতি বছর যে মুনাফাটা তারা আপনাকে দিবে, সেটার পরিমাণ কিন্তু কম না। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে শেয়ার মার্কেট খুব ‘ভোলাটাইল’ এবং খুবই ‘রিস্কি’ একটা জায়গা। আরেকটি ভেইকেলের কথা বলেছি, সেটা হচ্ছে আইসিবি ইউনিট। এটা কিনতে হবে আপনাকে আইসিবি অফিস থেকে। ওদের ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট আছে সেখানে যেয়ে আপনার অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, ব্যাংকের মতোই। অ্যাকাউন্ট খুলে আপনি ইউনিট কিনতে পারবেন। আগে তারা কাগজের সার্টিফিকেট দিত এখন ইলেকট্রনিক্স ট্রান্সফার দেয় আপনার হিসেবে। এটা আপনি ইন্টারনেটে একটু ঘাটাঘাটি করলেই জানতে পারবেন। স্টকমার্কেট যেমন ঝুঁকিপূর্ণ এখানে সে তুলনায় রিস্ক বা ঝুঁকি কম এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে রিটার্নও বেশ ভালো।

তারপরে ধরেন আপনি প্রোপার্টিতে ইনভেস্ট করবেন। এখানে ইনভেস্ট করতে হলে লোকেশন খুব বড় একটা ব্যাপার, কাদের কাছ থেকে কিনছেন, সেখানেও নজর দিতে হবে। তারপরে জমির টাইটেল ঠিক আছে কিনা, জমির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা, দখল আছে কিনা, এগুলো দেখেশুনে আপনার এমন জায়গায় জমিটি কিনতে হবে যে জমি আপনি সহজে বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু যারা জমিতে ইনভেস্ট করবেন, মনে রাখবেন, যদি অন্তত পাঁচ বছরের জন্য জমিতে ইনভেস্ট করতে পারেন, তাহলে জমিতে যাবেন। অন্যথায় এখানে যাওয়াটা বেশি লাভের বিষয় হবে না। আর জমিতে ইনভেস্ট করলে সহজে আপনি নগদায়ন করতে পারবেন না। এখন যে জমির দাম এক লাখ টাকা কাঠা, ২০ বছর পরে সেই জমির দাম হতে পারে ২০ লাখ টাকা। যারা পদ্মা সেতুর দুই পাশের জমি কিনে রেখেছিলেন তারা এখন অনেক লাভবান।

তারপরে গোল্ডে ইনভেস্ট করতে পারেন। ধরেন ১০ বছর আগে কেউ যদি গোল্ড কিনে রাখতেন তাহলে এখন অনেক লাভ করতে পারতেন। কিন্তু সেখানেও গোল্ড বার কিনতে হবে, আপনি যদি অর্নামেন্ট কিনেন তাহলে যখন বিক্রি করবেন তখন অর্নামেন্টের অনেক অংশ বাদ চলে যাবে।

আর ইনভেস্ট করবেন না কোথায় কোথায়? সেটা একটু বলে দেওয়া জরুরী। আপনার কোন আত্মীয-স্বজনের ব্যবসায় ইনভেস্ট করা খুবই খুবই রিস্কি। ইভেন কোনো বন্ধু-বান্ধবের ব্যবসায় ইনভেস্ট করা অনেক বেশি রিস্কি। সম্পর্ক নষ্ট হবার ঝুঁকি আছে টাকার ঝুঁকি ছাড়াও।

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, তা হলো, ওই যে বলেছিলাম বয়সের সাথে সাথে রিস্কের পরিমাণও কমতে থাকবে। এটা অবশ্যই মাথায় রাখবেন। কিন্তু একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না, তা হলো, আপনি সেভিংসের যে অভ্যাস গড়ে তুলেছেন সেই অভ্যাস যেন রিটায়ার করা পর্যন্ত বজায় থাকে। তাহলে দেখবেন আপনি যে ফান্ডগুলো ইনভেস্ট করেছেন, পাশাপাশি আপনার সেভিংসের ফান্ডও ইনভেস্টমেন্টে এসে প্রতি বছর জমা হচ্ছে। একসময় দেখবেন আপনার বড় একটা ফান্ড জমা হয়ে যাবে। এবং তখন আপনি আনন্দে আপনার অবসর জীবন কাটাতে পারবেন। যদি আপনার জীবন যাপনের মান পূর্বের মত বজায় থাকে তাহলে তখন বলা যাবে আপনি আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছেন।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল। ইমেইল: [email protected]

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।