Home মহিলাঙ্গন নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতের ইসলামী বিধান-১

নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতের ইসলামী বিধান-১

।। শেখ মুহাম্মদ তৈয়বুর রহমান নিজামী ।।

নারী এবং পুরুষ মহান আল্লাহ্র এক অনন্য সৃষ্টি। জন্মগতভাবেই এরা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং একে অপরের পরিপরক। বিশেষ বয়স থেকে এদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলামী বিধান নিয়ন্ত্রিত উপায়ে এর স্বাভাবিক লালন এবং সুস্থ বিকাশ সাধনে উৎসাহিত করে। মূলতঃ ধর্ম, বর্ণ, মানবতা ও সামাজিকতা সংরক্ষণের তাগিদেই এর নিয়šণ অপরিহার্য। ফলে বয়োঃপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ করে। পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রেও ইসলাম সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়। নারী-পুরুষের দৃষ্টিপাত সংক্রান্ত সেই বিধিবিধানই হবে বক্ষমান প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামী বলেন, “(হে রাসূল!) আপনি মু’মিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চোখ নিুগামী রাখে (হিফাযত করে) এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহের সংরক্ষণ করে। এটি তাদের জন্য পবিত্রতম ব্যবস্থা, তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তার খবর রাখেন।” (সূরা নরঃ ৩০)। পরের আয়াতেই আবার বলেন, “তারা যেন তাদের চোখ নিুগামী রাখে ও সংরক্ষণ করে এবং আপন লজ্জাস্থানসমূহের হিফাযত করে।” (সূরা নর, ৩১ আয়াত)।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রাযি.)কে উদ্দেশ্য করে বলেন- “হে আলী! একবার নজর পড়ে গেলে দ্বিতীয় বার তাকাবে না। কেননা, (অজানতে) প্রথম দৃষ্টি তোমার জন্য দোষমুক্ত, তবে পুনরায় নজর দেওয়া বৈধ নয়।” (সুনানুল কুবরা-৭/৯০)।

হযরত আবু উমামা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত অপর হাদীসে বলা হয়েছে- “কোন মুসলমান কোন মহিলার সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই যদি সে (পুরুষ) তার চোখ হিফাযত করে, তবে আল্লাহ্ তাকে এমন ইবাদত নসীব করাবেন, যার অপর্ব স্বাদ তাকে পরিতৃপ্ত করবে।” (মুসনাদে আহমদ- ৫/২৬৪ পৃষ্ঠা)।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। শয়তানী খাহেশাত ও কু-রিপু তার এ শ্রেষ্ঠত্ব আর মর্যাদাকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষের মনে এ শয়তানী খাহেশাত আর কুমšণা বহুলাংশে নারী-পুরুষ একে অন্যের প্রতি দৃষ্টিপাতের দ্বারা সঞ্চারিত হয়ে থাকে। পরিণামে মানবতা ও পবিত্রতা হয় ভূলুণ্ঠিত। তাই ইসলাম নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতের বিশেষ বিধান আরোপ করেছে। সে সব বিধানের আলোচনা নিম্নরূপ।

(ক) পুরুষের দৃষ্টিপাত নারীর প্রতি। (খ) নারীর দৃষ্টিপাত পুরুষের প্রতি। (গ) স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাত।

পুরুষের দৃষ্টিপাত নারীর প্রতি

পুরুষের জন্য কোন স্বাধীন বেগানা মহিলার শরীরের যে কোন স্থানের প্রতি কামদৃষ্টিতে তাকানো হারাম। এ ব্যাপারে কোন আলেমের দ্বিমত নেই। (সানায়ে’ বাদায়ে’-৫/১২১)। কারণ-

(১) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “যে ব্যক্তি কোন বেগানা মহিলার সৌন্দর্যের প্রতি কামদৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, ক্বিয়ামতের দিন তার চোখে ‘উনুক’ ঢেলে দেওয়া হবে। ‘উনুক’ হল গলিত সীসা।” (লিসানুল আরব)।

(২) যেহেতু কামদৃষ্টিতে তাকানো অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণ বা উৎস; সুতরাং হারাম কাজের উৎসও (তাকানো) হারাম। তবে কামাসক্তিমুক্ত দৃষ্টিপাত কতটুকু অপরাধ সে ব্যাপারে ফিক্বাহ্বিদগণের মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা এটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। ক. যুবতী বেগানা মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত। খ. বৃদ্ধার প্রতি দৃষ্টিপাত।

যুবতী মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত

বেগানা মহিলার কয়েকটি অঙ্গ ছাড়া সম্পূর্ণ শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করা জমহুর ফিক্বাহবিদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে মতৈক্য পোষণ করেন। আর যেগুলো ব্যতিক্রম যেমন, চেহারা, হাত ও পা, এগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাতের ব্যাপারেও তাঁদের মতপার্থক্য দেখা যায়। নিম্নে তাঁদের বিভিন্ন মতামত এবং আমরা কোন মতটিকে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করি, তা পেশ করা হল-

চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত

হানাফী, মালেকী, হাম্বলী মাযহাবের প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত, শাফিঈ মাযহাবের গৌণ মত এবং আহলে জাওয়াহেরের মতানুসারে মহিলার চেহারার প্রতি কামশন্য দৃষ্টিপাত বৈধ। তাঁদের দলীল নিম্নরূপ-

এক. আল্লাহ্ তাআলার ঘোষণা, “আর তারা (মহিলারা) যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তবে যা (সাধারণভাবে) প্রকাশিত। (সূরা নর, ৩১ আয়াত)। উক্ত আয়াত দ্বারা এভাবে প্রমাণ পেশ করা হয় যে, সৌন্দর্যের দুই অর্থ- (ক) সৃষ্টিগত সৌন্দর্য, (খ) বিলাস সামগ্রী ব্যবহারের সৌন্দর্য।

প্রথম অর্থের ভিত্তিতে আয়াতের ভাবার্থ হবে, “মানুষ স্বাভাবিক ও প্রচলিত অভ্যাস অনুযায়ী শরীরের যেটুকু প্রকাশ করে থাকে। যেমন, মহিলাদের চেহারা এবং হাতের কব্জি।” (মাফাতিহুল গায়েব- ৬/১৩৬ পৃষ্ঠা)।

দ্বিতীয় অর্থের ভিত্তিতে আয়াতের মর্মার্থ দাঁড়ায়- প্রকাশমান এমন সৌন্দর্য সামগ্রী যা চেহারা ও হাতের কব্জি পর্যš ব্যবহার করা হয়, এগুলো প্রকাশ করা বৈধ। যেমন, চোখের সুরমা, হাতের আংটি বা মেহেদীর রং ইত্যাদি।

উক্ত দলীলের ভিত্তিতে মহিলাদের চেহারা ও হাতের সৌন্দর্যের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিপাত বৈধ ও হালাল প্রমাণিত হয়। আর মহিলাদের এতটুকু সুযোগ শরীয়ত এ জন্যই দিয়েছে যে, এ দুই অঙ্গ আবৃত করতে হলে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ সাক্ষ্য প্রদান ও নানা কাজে এটি খোলা রাখা প্রয়োজন। (তাফ্সীরে তাবারী- ১/১১৮ পৃষ্ঠা)।

দুই. হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, আসমা বিনতে আবু বকর (রাযি.) একদিন পাতলা কাপড় পরিধান করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এলে তিনি তাঁর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বল্লেন, আসমা! মেয়েরা বয়োঃপ্রাপ্তা হলে তাদের এটা আর এটা ব্যতীত দেখা বৈধ নয়, বলে তিনি চেহারা ও হাতের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। (আবুদাঊদ শরীফ- ২/৩৮৩ পৃষ্ঠা)।

তিন. এক হাদীসে বর্ণিত আছে, জনৈকা মহিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে তাঁকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেন। তখন তিনি তার চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন; তবে তিনি (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার প্রতি কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।

এসব দলীল দ্বারা এভাবে প্রমাণ পেশ করা যায় যে-

(ক) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েদের কতিপয় এমন অঙ্গকে নির্দিষ্ট করেছেন, যেগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা বৈধ। যেমন, হযরত আসমা (রাযি.)এর হাদীসে চেহারা এবং হাত।

(খ) এছাড়া চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করার বৈধতা সেই মহিলার ব্যাপারেও প্রমাণিত হয়েছে, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে বিবাহের প্র¯াব করেছিলেন।

শাফিঈ মাযহাবের গ্রহণযোগ্য মতে এবং হাম্বলী মাযহাবের কারো কারো মতে স্বাধীন বেগানা মহিলার চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত হারাম। তাদের দলীল নিম্নরূপ-

(ক) আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, “যখন তোমরা তাদের (মহিলা) নিকট কোন দ্রব্য প্রার্থনা করবে, তবে তা প্রার্থনা করবে পর্দার আড়াল থেকে।” (সূরা আহযাব, ৫৩ আয়াত)।

(খ) আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, “হে রাসূল! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, মেয়েদেরকে এবং মু’মিনদের মহিলাদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের (শরীরের) উপর তাদের চাদর বা ওড়না দিয়ে আবরণ করে দেয়। এটি তাদেরকে চিনিয়ে দিতে সহায়তা করবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হবে না, (বিরক্ত করা হবে না) আর আল্লাহ্ অত্যš ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (সূরা আহযাব, ৫৯ আয়াত)।

প্রথম আয়াত দ্বারা এভাবে প্রমাণ দেওয়া হয় যে, চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করা জায়েয নয়। কারণ যদি জায়েয হত, তাহলে আল্লাহ্ তাআলা পর্দার আড়ালে থেকে প্রার্থনা করতে বা চাইতে নির্দেশ দিতেন না। দ্বিতীয় আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, যদি চেহারার প্রতি তাকানো মুবাহ্ বা বৈধ হত, তবে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে স্ত্রী, কন্যা ও মুসলিম মহিলাদেরকে চাদর বা ওড়না দ্বারা চেহারা আবৃত করার নির্দেশ পৌঁছে দেওয়ার হুকুম করতেন না। সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তাআলার এ নির্দেশ দান চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত হারাম হওয়া প্রমাণ করে।

এছাড়া আল্লামা বায়যাবী (রাহ্.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- অর্থাৎ “মহিলারা তাদের চাদর-ওড়না তাদের উপর ঢিলেঢালাভাবে ছেড়ে দিয়ে তা দ্বারা তাদের চেহারা ও এপাশ ওপাশ ঢেকে নেবে।” (তাফ্সীরে কাশশাফ- ৩/৫৬০ পৃষ্ঠা)।

(গ) হযরত জাবির ইব্নে আব্দুল্লাহ্ (রাযি.) বলেন- “আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দৃষ্টিপাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তুমি তোমার চোখ ঘুরিয়ে নেবে”। (আবুদাঊদ শরীফ-১/৪৯৫ পৃষ্ঠা)।

(ঘ) সমগ্র মুসলিম মিল্লাত এ কথায় একমত যে, মহিলাগণ বেসামাল সাজসজ্জা ও উন্মুক্ত চেহারায় বাইরে বের হবেন না। বিশেষ করে ফাসিকের সংখ্যাধিক্যের এ যামানায়। মহিলাদের চেহারা উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের এ উক্তি দৃষ্টিপাত বৈধ না হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। (আল-ইকনা-১/১১৯ পৃষ্ঠা)।

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতের ইসলামী বিধান-২