Home ইসলাম মাহে রমযান ও সিয়াম সাধনা

মাহে রমযান ও সিয়াম সাধনা

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

বছর শেষে আবারও আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে মহান একটি মাস, মাহে রমযানুল মুবারক। রহমত, বরকত, মাগফিরাতের এই মাসে আর মাত্র কয়দিন পরই আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ তথা পবিত্র কুরআনুল কারীমের অবতীর্ণ হবার মাস এই মাহে রমযান।

মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “রমযান মাসই হলো সেই মাস, যে মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে, ‘কুরআন’। যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সৎপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ। আর ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী”। সহস্র মাসের চেয়েও অধিক বরকতময় রজনী শবে-ক্বদর বা লাইলাতুল ক্বদরের আলোক রৌশনীতে মহিমান্বিত এ রমযানুল মুবারক বা মাহে রমযান।

তাই তো রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “হে মানবকুল! তোমাদের সামনে একটি বরকতময় মাস (রমযান) উপস্থিত হয়েছে, যাতে লাইলাতুল ক্বদর নামে একটি রাত রয়েছে, উক্ত রাতটিতে আল্লাহর দরবারে ইবাদত করার প্রতিদান সহস্র মাস ইবাদত করার প্রতিদান অপেক্ষা শ্রেয়তর”।

রহমত-মাগফিরাত, জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভের বরকতময় মাস এ মাহে রমযান। ফেরেস্তা ও পশুত্বের সমন্বয়ে গঠিত মানবদেহের পশুত্ব দিক বর্জন করে ফেরেস্তার পূণ্যময়গুণ অর্জন করার মাস এ রমযানুল মুবারক। রাত্র-দিন ইবাদত-প্রার্থনা, দান-সদক্বা, কুরআনুল কারীম পাঠ ও শ্রবণ, তারাবিহ্ , তাহাজ্জুদ ইত্যাদি ইবাদত করার মাস এ মাহে রমযান।

পড়তে পরেন- ‘কখন জমিনে মহামারি ছড়িয়ে পড়ে এবং মু’মিনদের করণীয়’

এ মাসের সাওম বা রোযা রেখে এবং বিবিধ ইবাদতের অধ্যাবসার মধ্যদিয়ে মানবদেহের পশুত্বকে বর্জন করে ফেরেস্তার ন্যায় কলুষমুক্ত পূণ্যময় গুণাবলী অর্জনের মাস এ রমযানুল মুবারক।

গরীব অত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, এতিম, বিধবা, মাযূর, বিকলাঙ্গসহ সমাজের দুঃস্থ ও অসহায় লোকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সহানুভূতি প্রকাশের মাস এ মাহে রমযান। আল্লাহর নাফরমানী ত্যাগ, রোযার যথার্থ হক্ব রক্ষা ও হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত পালনের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধতায় নির্মূল করার মাস এ পবিত্র রমযানুল মুবারক।

আল্লাহর ভয় মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। মানব মনে সদা জাগ্রত আল্লাহর ভয় বিরাজমান থাকলে মানুষ কখনো আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্টিকূলের হককে নষ্ট করতে পারে না। আর হক নষ্ট করতে পারে না বলে এই মানুষ সমাজের মাঝে কোন প্রকার অশান্তির দাবানল ছড়াতে পারে না। এ মহা গুণটি অর্জনের একটি মাস, এ মাহে রমযান। এ মাসেই সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ আল্লাহর ভয় মানব জীবনে অর্জিত হয়।

এ মাস ধৈর্য্য ধারণের মাস, সহানুভূতি প্রকাশের মাস, ইবাদত প্রার্থনা করার মাস। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে মানব সমাজ! একটি মহান মাস, একটি বরকতময় মাস তোমাদের উপর ছায়াপাত করছে, যে মাসের মধ্যে এমন একটি রাত্রের উপস্থিতি বিদ্যমান, যে রাতের মর্যাদা সহস্র মাসের চেয়েও অধিক।

এ মাসের প্রতিটি দিবসে আল্লাহর রোযা (বা পানাহার ও জৈবিক ক্ষুধা নিবারণ থেকে মুক্ত থাকা)কে ফরয করেছেন। আর এ মাসের প্রতিটি রাতে দন্ডায়মান (বা তারাবিহ্র নামায)কে অসীম পুণ্য অর্জনের কাজরূপে নির্ধারণ করেছেন।

এ মাসের একটি ফরয (বা অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য)কে অন্য মাসের সত্তর ফরযের সমান এবং একটি নফল (বা যে কাজ করলে পুণ্য, তবে না করলে কোন ক্ষতি নেই এমন কাজ)কে অন্য মাসের একটি ফরযের সমান করেছেন। এটি সবর (বা ধৈয্য ধারণ)এর মাস। আর সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটি সমবেদনা প্রকাশের মাস।

এ মাসে মু’মীনদের রিযিক বৃদ্ধি করা হয়। এ মাসের প্রথম অংশ রহমতের, (দ্বিতীয়াংশ মাগফিরাতের) এবং শেষাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের। তিনি আরো বলেন, “যখন রমযান মাস আসে, বেহেস্তের প্রতিটি দরজা খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের প্রতিটি দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়”।

এ মাস তাক্বওয়া অর্জন (বা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা)এর মাস। তাক্বওয়ার শাব্দিক অর্থ বেঁচে থাকা, বিরত থাকা, সর্তক হওয়া ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায়, জীবনের সকল পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়-আনাচার, জুলুম-নির্যাতন, অশ্লীলতা, প্রবৃত্তির দাসত্ব প্রভৃতি থেকে বিরত হয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাঁরই নির্ধারিত পথে এবং হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথে যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পাদন করার নামই ‘তাক্বওয়া’।

আরও পড়ুতে পারেন- ‘ইসলামে জুমার দিনের ফযীলত ও আমলসমূহ’

পবিত্র কুরআনুল কারীমে তাক্বওয়া শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা: ভীতি, আনুগত্য ও গুনাহ্ বর্জন। তাই, তাক্বওয়া অর্জনের জন্য অন্তরে একমাত্র আল্লাহর ভয় রেখে তার পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে সমস্ত গুনাহ্ বর্জন করতে হবে। এভাবে চলতে গেলে মন বা অন্তরসহ শরীরের বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে হিফাযত করে চলতে হবে, তথা: চোখ, কান, জিহ্বা, অন্তঃকরণ ও যৌনাঙ্গকে নাজায়েয কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। আর এভাবে চলার জন্য রমযান মাস তথা রোযাই উপযোগী। তাই, এ মাস তাক্বওয়া অর্জনের মাস।

এ মাস অত্যধিক পুণ্যার্জনের মাস। কামাই রুজি বৃদ্ধি করার মাস। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে বেহেস্তে গমনের মাস। এ মাসেই মানুষের প্রবৃত্তি দমনের প্রশিক্ষণের মাস। এ মাস সংযম প্রশিক্ষণের মাস। মোটকথা, রমযানুল মুবারক বা মাহে রমযান মানুষের জন্য শুদ্ধতায় পরিপূর্ণ হবার একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস।

রমযান মাসের বিধানঃ

রমযান মাসের বিধান হলো রমযান মাসের রোযা পালন করা। মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলা। আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাহরী থেকে ইফতার পর্যন্ত সময়টুকু জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের উপভোগ থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর রহমত-মাগফিরাত-নাজাত পাবার লক্ষ্যে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সকল পাপ কাজ ছেড়ে দেয়া। আল্লাহ্ তাআলা এ মাসের রোযাকে ফরয করেছেন। রাতের বেলায় ইবাদত অর্থাৎ তারাবিহ্কে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা (যাহা পালন করতে হবে, না করলে গুনাহে জড়িত হতে হবে এমন কাজ) হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন।

রমযান মাসের রোযার নিয়ম শরয়ী দিবসের অর্থাৎ- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ দ্বি-প্রহরের পূর্বেই হতে হবে। শর্ত হলো সুবহে সাদিক থেকে নিয়্যাত করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোন কিছু পানাহার করা যাবে না বা রোযা ভঙ্গ হয় এমন কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া যাবে না। রমযান মাসের পুরো মাসের রোযা প্রত্যেক স্বজ্ঞান, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব, কৃষক-শ্রমিক নির্বিশেষে সবার উপর ফরয। [চলবে]

লেখক: প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ ডটকম, সিইও- এম.জেড. ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পুরানা পল্টন, ঢাকা।

আরও পড়তে পারেন-

রমযান মু’মিনের জন্য কী প্রতিফল বয়ে আনে?

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com/