Home ওপিনিয়ন আমি শেখ মুজিবর রহমানের অভাববোধ করি

আমি শেখ মুজিবর রহমানের অভাববোধ করি

।। ফরহাদ মজহার ।।

ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়, তবে ইতিহাসের প্রতিশোধ নেবার বিশেষ ধরণ আছে, যা বোঝার মতো অধ্যবসায় ও বিচারবুদ্ধি আমরা এখনও অর্জন করিনি।

শেখ মুজিবর রহমানের ইতিহাস জানা ছিল। বাঙালি মুসলমানের লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁর হত্যায় ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির একটা ছেদ ঘটেছে। বিশেষত বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে গিঁট বাঁধা কঠিন হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিব ছিলেন সেই গিঁট। শেখ মুজিবর রহমানকে আমি তাই মিস করি।

এভাবে ভাবুন, তাহলে বুঝবেন। ‘বাঙালি মুসলমান’-কথাটি থেকে ‘মুসলমান’ বাদ দিয়ে তাকে শুধু ‘বাঙালি’ দাবি করার অর্থ, বাঙালি মুসলমানের লড়াই-সংগ্রাম – অর্থাৎ ঔপবেশিক আমলের নিপীড়িত জনগোষ্ঠির লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস মুছে দেওয়া। ঔপবেশিক ভারতবর্ষের ইতিহাসকে নয় মাসের যুদ্ধে পর্যবসিত করার অর্থ এটাই বলা যে বাঙালি মুসলমানের কোন অতীত নাই, তারা ভুঁইফোড়। বাঙালি জাতিবাদিরা এই ভূয়া বিশ্বাসই প্রাণপণ প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াইয়ের এটাই প্রধান ভারকেন্দ্র। বাংলাদেশে সে লড়াই এখন বাঙালি জাতিবাদি ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে দল নির্বিশেষে জনগণের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

পাকিস্তান বাঙালিকে খালি ‘মুসলমান’ বানাতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বীর বাঙালি গর্জে উঠে অস্ত্র ধরেছিল। দিল্লি চেয়েছে বাঙালি মুসলমান তার ইতিহাস ভূলে গিয়ে শুধু হিন্দু্র ইতিহাসকেই বাঙালির ইতিহাস হিশাবে মানুক। বাঙালি মুসলমান থেকে ‘মুসলমান’ শব্দটি ছেঁটে ‘আমি কে, তুমি কে, বাঙালি, বাঙালি’ — এই শ্লোগান বাঙালি জনগোষ্ঠিকে হিন্দুকরণের রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি।

ভেবে দেখুন, একাত্তরে বাঙালি মুসলমানের রণধ্বণি ছিল ‘জয় বাংলা’। কিন্তু ‘জয় বাঙালি’ ছিল কি? অবশ্যই না। জাতিবাদি ঘৃণার রাজনীতি শেখ মুজিবর রহমান শেখাননি। বরং ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনির মধ্যে সকল মজলুম জাতি, গোষ্ঠি ও নিপীড়িত প্রাণের আবাস নিশ্চিত করবার সংকল্প আছে। ঐ শ্লোগানে বৃহৎ বাংলা ও ভূগোলের দাবিও স্পষ্ট। একে নস্যাৎ করবার জন্যই নিকৃষ্ট জাতিবাদী চিন্তা গড়ে তোলা হয়েছে। ‘জয় বাংলা’ অন্যান্য জাতিসত্তাকে অস্বীকার ও জুলুম করবার রাজনীতিতে পর্যবসিত হয়েছে। পর্যবসিত হয়েছে বাঙালি মুসলমানের স্মৃতি, ইতিহাস অতীত নিশ্চিহ্ন করে দেবার হিন্দুত্ববাদী পরিকল্পনায়। ভাল খবর হোল, সীমান্তের দুই পাশের জনগণই আবার রুখে দাঁড়াচ্ছে।

ভুলে গেলে চলবে না, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ দিয়ে শুধু পাকিস্তান বানানো হয় নি। গান্ধি-নেহেরুর ভারতও বানানো হয়েছে। ভারতও দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিণতি, কারন হিন্দু নিজেদের আলাদা ‘জাতি’ গণ্য করে বলেই ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে, বাংলা ভাগ হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকেই ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্র বা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র। ফারাক এতোটুকুই যে নরেন্দ্র মোদী সেটা এখন স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

দ্রুত সতর্ক হওয়া দরকার: পুরা উপমহাদেশ ব্যাপী পাকিস্তানি রণনীতির আদলে এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। মহড়াও চলছে ভারতে। এই যুদ্ধ ভারতবর্ষ মুসলমান মুক্ত করার যুদ্ধ, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই পর্বটিকে হিন্দুত্ববাদিরা ব্যবহার করতে চাইছে। বাংলাদেশ সেই যুদ্ধের প্রথম পরীক্ষাগার। খরচের খাতায় এক নম্বরে।

বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস শেখ মুজিবর রহমান জানতেন। তাঁর কাছে বাঙালির লড়াই একই সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের লড়াই। সেই লড়াই বাঙালিকে পাকিস্তানীদের মতো শুধু ‘মুসলমান’ বানানোর লড়াই ছিল না, বরং তার ধর্ম ও সংস্কৃতিসহ সত্য সত্যই বাঙালি বানাবার সংগ্রাম।। কিন্তু মুসলমান হিশাবে বাঙালির লড়াই বাদ দিয়ে সেটা বাঙালির লড়াই না, উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ভুল ইতিহাস।

আজ ১৫ অগাস্ট । তীব্র কান ফাটা আওয়াজে শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা বাজানো হচ্ছে। এই ফাঁকে বরং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কিছু পাতা অন্তত পড়েন। আমার মতো তাঁর অনুপস্থিতি আপনিও টের পাবেন। আপনাকে বাকশাল করতে হবে না, কিম্বা হাতুড়ি হাতে ছাত্রদের মেরুদণ্ড ভাঙতে হবে না। হেলমেট পরে শিক্ষার্থিদের ওপর হামলা চালাতে হবে না। শুধু উপলব্ধি করুন বাঙালি মুসলমানের এক দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের গৌরব্জনক ইতিহাস আছে।

পড়ুন-

“আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত । আর হাবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের ‘পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও ‘পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তর বই লিখেছিলেন সেটা; এই দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্তের মত ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত “।

কী বুঝলেন?

“সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল । কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হল — মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা কেন ? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত । ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙ্গালি মুজাহিদরা ? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিলেন। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়জি আন্দোলন সমন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিনদারদের আক্রমণ করতাম “।

এর কারণ কি?

“এর কারণও যথেষ্ট ছিল। একসাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে বল খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যখন কোন হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আমাকে অনেক সময় তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা “।

“একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত । ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির । আমি বললাম ‘ননী কি হয়েছে?” ননী আমাকে বলল, “তুই আর আমার বাসায় যাস না । কারণ তুই চলে আসার পর কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে ।” আমি বললাম, “যাব না, তুই আসিস।” আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু কোন সহপাঠীরা আমাকে কোনদিন একথা বলে নাই । অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন । এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙ্গালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে । শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। কারণ আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলির বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল “।

এই হোল ইতিহাস। শেখ মুজিবর রহমান যে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল ‘লাহোর প্রস্তাব’ । জ্বি, পড়ুন-

“পাকিস্তান দু’ইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে— পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে । অন্যটা হবে হিন্দুস্তান । ওখানে হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে । তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও “।

বঙ্গের পুরা ভূখণ্ডের সকল অধিবাসীর ভূগোল যে স্বপ্নের অন্তর্গত তাকে ঔপনিবেশিক ইংরেজের মানচিত্র দিয়ে কিম্বা ‘জাতিবাদ’ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবেন না। বহুর, বৈচিত্রের, ভিন্নতার মহিমা ও উৎসব হিশাবে ভাবুন। নিজের তারিফ করতে শিখুন, আপনি বাঙালি, আপনি সবার জন্য স্বপ্ন দেখেন, দেখাতে পারেন; আপনি শুধু বাঙালির জন্য না। ভুলে যাবেন না হোয়াট বেঙ্গল থিংক্স টু ডে, ইন্ডিয়া থিংক্স টু মরো। সর্বোপরি ইসলাম ধর্মালম্বি হিশাবে গর্ব করতে শিখুন, কারন জালিমের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে ধর্ম নির্বিশেষে সকল মজলুমের পক্ষে দাঁড়াবার হিম্মত ঐতিহাসিক ভাবে আপনি অর্জন করেছেন। নইলে মদিনা থেকে মক্কা জয় করে যে স্থান একদা ত্যাগ করতে হয়েছিল সেই পবিত্র নগরীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারতেন না। বিশ্ব-ইতিহাসের কর্তা ও বিশ্বনাগরিক হওয়াই আপনার সাধনা, সাম্প্রদায়িক ‘মুসলমান’ হওয়া আপনার সাধনা না।

আমি তাই শেখ মুজিবর রহমানের অভাব বোধ করি।

– ফরহাদ মজহার, কবি ও বুদ্ধিজীবী।