Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মুসলিম দার্শনিকরা কি বিবর্তনবাদের আবিষ্কারক?

মুসলিম দার্শনিকরা কি বিবর্তনবাদের আবিষ্কারক?

।। হুজাইফা মাহমুদ ।।

বিগত দুই শতকের ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনে পৃথিবী মৌলিকভাবে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমত, উপনিবেশ শাসিত দেশগুলোর ধন, সম্পদ, কাঁচামাল, ব্যবসা-বাণিজ্য–সব লুট করে নিয়ে একদম ফতুর করে ছেড়ে দিয়েছে। এর পাশাপাশি দেশে দেশে লাখে লাখে মানুষ হত্যা করা হয়েছে নির্বিচারে। অন্যান্য জুলুম ও নিপীড়ন তো আছেই।

দ্বিতীয় সবচে বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি যে ক্ষতিটি করেছে তা হলো, তারা এমন এক প্রভুভক্ত শ্রেণী তৈরী করে গেছে সব দেশে, যারা যুগযুগ ধরে তাদের ঔপনিবেশিক প্রভুদের দাসানুদাস হয়ে থাকবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেবে ঔপনিবেশিক চিন্তা ও চেতনার লিগ্যাসি। নেপোলিয়ানের নেতৃত্বে ফরাসিরা যখন মিসর দখল করে, তখন তারা নিজেদের উপনিবেশ রক্ষার জন্যই এমন একটি উলামা দল তৈরী করে, যারা তাদের হয়ে কথা বলবে। যেহেতু মিসরের মতো মুসলিম দেশে যেকোন আলেমের কথার মূল্য সকলের কাছেই প্রণিধানযোগ্য। এই প্রক্রিয়ার সুবিস্তারিত বিবরণ এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজমে পাবেন।

ফরাসিরা প্রথমেই একদল আলেমকে ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই এনলাইটেনমেন্টের কল্যাণে ইউরোপ কিভাবে রাতারাতি পৃথিবীর মালিক বনে যায়, সেটা হাতে কলমে বুঝিয়ে দেয়। সেই উলামাদলের মাঝে অগ্রগণ্য ছিলেন মোহাম্মদ আবদুহু, জামালুদ্দীন আফগানী এবং তাদের অনুসারীদের বড় একটি দল। তারা মুসলিম জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদিতে এগিয়ে নিতে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইসলাম ও মুসলিম জাতির আধুনিকায়নের কথা বলেন, যে আধুনিকতার সর্বোচ্চ অর্থ হলো পশ্চিমা আলোকায়নের অন্ধ অনুকরণ। মোর মডার্নাইজেন মিনস মোর ওয়েস্টার্নাইজেশন।

ফলে ইসলামের গৌরবময় জ্ঞানচর্চা আর বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ইতিহাসে এমন এক বিপর্যয় ডেকে আনেন যার ক্ষতিপূরণ এখনও দিয়ে যেতে হচ্ছে। অপরদিকে একই ঘরানার লোক ছিলের স্যার আমির আলি, সৈয়দ আহমদ প্রমুখগণ। ইসলামকে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও আধুনিকতার অন্যান্য প্রপঞ্চগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এতোটাই মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন যে, ইসলামের অনেক মৌলিক বিষয়াবলীর যে ইন্টেগ্রিটি আর প্রোফাউন্ডলি এস্টাবলিসিটি ছিলো সেগুলোতে একযোগে আঘাত করতে শুরু করেন। মিসরে ওইসব উলামারা যখন নবী-রাসূলদের মু’জিযা, কারামাত, জ্বীন, জান্নাত, জাহান্নাম এবং অন্যান্য বিষয়-আশয়কে অস্বীকার করতে লাগলেন, ভারতের উলামারাও একই সুরে তাল দিলেন। কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত এমন অনেক বিষয়কে স্রেফ এই কারণে অস্বীকার করা শুরু করলেন যে, এগুলো আধুনিক (বলা ভালো ইউরোপের আলোকায়িত) বিজ্ঞান ও দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।

এরই ধারাবাহিকতায় বিবর্তনবাদের প্রশ্ন যখন সামনে আসলো, তখনও তারা কোন ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই একে সাদরে গ্রহণ করে নিতে একটুও দ্বিধাবোধ করেননি। আফগানী এবং স্যার সৈয়দ উভয়েই স্বাগত জানিয়েছেন একে। দাবী করেছেন, ডারউইনের এই মতবাদের সাথে ইসলামের আকীদাগত ও চৈতন্যগত কোন বিরোধ নেই। এই দাবীর সপক্ষে দলীল-প্রমাণ আর যুক্তি অনুসন্ধান করেছেন প্রাচীন ইসলামিক দার্শনিক ও যুক্তিবিদদের লেখাজোকায়। এবং খুব সহজেই মানুষকে বুঝাতে পেরেছেন, এই আবিষ্কার ডারউইনের নয়, তারও বহু আগে আমাদের মুসলিম দার্শনিকদের আবিষ্কার, সুতরাং বিরোধিতা করার কোন প্রশ্নই আসে না। তারা আগে দাবী করেছেন, তারপর যত্রতত্র দলীল-প্রমাণ ও যুক্তির খুঁজে চষে বেড়িয়েছেন। বিবর্তনবাদের ইসলামিকরণে কতটা মরিয়া হয়ে ছিলেন তারা সেটা বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জালালুদ্দিন আফগানি এক চিঠির জবাবে আবুল আলা মায়াররির মরমি ভাববাদী একটি কবিতার লাইন উল্লেখ করে দাবী করেন, এই কবিতায় বিবর্তনবাদের কথা বলা হয়েছে। আগের যুগে মুসলিম দার্শনিকরা বিবর্তনবাদ চর্চায় কতটা অগ্রসর ছিলেন, সেটা বুঝাতে চাইছেন তিনি। কবিতার মোটামুটি ভাবার্থটা ছিলো এমন–পৃথিবীর মানুষ ভেবে ভেবে হয়রান, মাটির ভেতর থেকে সৃষ্টি হবে নতুন প্রাণ।

এই একটা মাত্র তথ্য, বক্তব্যের মিস ইন্টারপ্রিটেশন, কতিপয় দার্শনিকের নাম, কিছু বইয়ের রেফারেন্স, অভাবনীয় ও আশ্চর্যরকমের প্রভাব ফেলেছে ইউরোপের আলোকায়নে আলোকিত শিক্ষিত মুসলিম সমাজে। অতীব বিস্ময়ের সাথে আমরা দেখি, ডক্টর হামিদুল্লাহর মতো বিজ্ঞ আলেম, আল্লামা ইকবালের মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি পর্যন্ত এই একই ফাঁদে পা দিয়েছেন। আলেম-উলামা থেকে শুরু করে শিক্ষিত জনসাধারণ পর্যন্ত গর্বের সাথে প্রচার করতে লাগলেন, এই তত্ত্ব আমাদের আবিষ্কার।

এর জ্বলন্ত উদাহরণ আপনি সহজেই দেখতে পাবেন ইন্টারনেটে। ইংরেজি এবং আরবীতে (অন্যান্য ভাষায়ও অবশ্যই আছে) অসংখ্য অগণিত বই, আর্টিকেল, রিসার্চ পেপার লিখিত হয়েছে, হচ্ছে, এই বিষয়ে। কোন কোন মুসলিম দার্শনিক বিবর্তনবাদকে সমর্থন করেছেন, কার বক্তব্য আধুনিক বিবর্তনবাদের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ–এ নিয়ে এক হুলুস্থুলে কান্ড তৈরী হয়েছে। সেই উপনিবেশ আমল থেকে নিয়ে এই সময় পর্যন্ত কত বই আর আর্টিকেল লেখা হয়েছে এর কোন ইয়ত্তা নাই। আমি কিছুদিন এসব ঘাটাঘাটি করেছিলাম। খুবই দুঃখিত আর হতাশ হয়েছি তখন। মানুষ এতোটা অন্ধ অনুকরণ করে? কোন প্রশ্ন নাই, সন্দেহ নাই, অনুসন্ধিৎসা নাই–এতো সহজে ঈমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে আপোষ করে বসে আছে, স্রেফ কিছু মানুষের কথার উপর ভিত্তি করে! এইসব ‘গর্বিত মুসলিমদের’ গর্ব আরও উস্কে দেয় বিবিসি, দ্যা গার্ডিয়ান, হাফিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস কিংবা নামি-দামি বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ক জার্নালগুলো। তারাও ফলাও করে প্রচার করে, বিবর্তনবাদ মুসলিমদের আবিষ্কার!

কিন্তু, বাস্তবেই কি ডারউইনের পূর্বে কোন মুসলিম স্কলার, দার্শনিক বিবর্তনবাদের কথা বলে গিয়েছেন? কারা বলেছেন, কী বলেছেন, তাদের কথার ইন্টারপ্রিটেশনের যথার্থতা কতটুকু?

আমি আপাতত কিছুটা সংক্ষেপে এসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। বিস্তারিত বলতে গেলে সেটা এক দীর্ঘ প্রবন্ধ বা বইয়ের দাবী রাখে, সে ধৈর্য্য এবং যোগ্যতা কোনটাই নাই আমার।

১.

সাধারণত যেসব মুসলিম দার্শনিকের নাম নেয়া হয় বিবর্তনবাদী হিসেবে, তারা হলেন জাহেয মিসকাওয়াইহ (৪৩১ হিঃ), ইবনে খালদুন (৮০৮ হিঃ), আল বেরুনী (১০৪৮ খৃষ্টাব্দ) এবং তৃতীয় শতাব্দীতে বসরায় গড়ে ওঠা ইখওয়ানুস সাফা নামক দার্শনিকদের একটি গুপ্ত সংগঠন। এছাড়া একই ধারার আরও কয়েকজনের নাম নেয়া হয়।

এদের মাঝে একমাত্র জাহেজ ব্যতীত অন্য সবার বক্তব্য কিছু শব্দ-বাক্য ছাড়া প্রায় এক। অর্থাৎ, ইখওয়ানুস সাফার দার্শনিকরা যা বলেছেন, মিসকাওয়াইহ ও ইবনে খালদুনও ঠিক তাই বলেছেন। সর্বোপরি এটা তাদের নিজস্ব কোন চিন্তা বা দর্শন না। সুতরাং তাদের বক্তব্যের উৎস ও সূত্র যে এক, এতে কোন সন্দেহ নাই। সেই উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে গ্রীক দর্শনে, নির্দিষ্ট করে বললে প্ল্যাটো, এরিস্টটলল ও প্লাটিনাসের দর্শনে।

এ কথা সর্বজনবিদিত, হিজরী তৃতীয় শতকে আব্বাসীয় খলীফাদের আমলে গ্রীক দর্শন প্রবলভাবে প্রবেশ করে ইসলামী জ্ঞান ও দর্শন চর্চায়। ইসলামী দর্শন চর্চাকে গ্রীক দর্শন এমনভাবে গ্রাস করে ফেলে যে, অনেক সময় উভয়ের মাঝে পার্থক্য করাই মুশকিল হয়ে যেতো। আল্লামা নাসাফির ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলামী দর্শনে যদি কুরআন ও হাদীসের উদ্বৃতি না থাকতো, তাহলে সেটা গ্রীক দর্শন না ইসলামী দর্শন, বুঝা যেতো না। গ্রীকদের দর্শন, গণিত, ভুগোল, চিকিৎসা বিদ্যা, কবিতা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য বই আরবীতে অনূদিত হতে থাকে। ইখওয়ানুস সাফা নামক দার্শনিকদের যে গুপ্ত সংগঠনটি, তারাও মূলত গ্রীক দর্শনের চর্চাই করতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, দর্শন ও ধর্মের মেলবন্ধন ঘটানো।

গ্রীক দার্শনিক প্লাটো, এরিস্টটল এবং প্লাটিনাস, এই তিনজনের সমন্বিত চিন্তায় জগতের সমস্ত সৃষ্টিকুলকে তাদের সৃষ্টিগত অবস্থান ও যোগ্যতার বিচারে স্তরবিন্যাস করেছেন। এর মাধ্যমে দেখিয়েছেন পৃথিবীতে কিভাবে জীব-জন্তু ও বস্তুসমূহের উৎকর্ষ ঘটেছে। যার একদম প্রথম স্তরে রয়েছে বস্তুসমূহের চারটি মৌল উপাদান–মাটি, আগুন, বায়ু, পানি। এর উপরে রয়েছেপাথরের স্তর, (ইবনে খালদুন বলেছেন খনিজ স্তর।) পাথর অস্তিত্বশীল একটি বস্তুমাত্র, নিস্প্রাণ। এর উপর রয়েছে উদ্ভিদ। উদ্ভিদে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, কিন্তু এটা জড়। এর উপরে সমস্ত প্রাণীকুল। তাদের প্রাণ আছে, এবং নিজ শক্তিতে চলাফেরা করতে সক্ষম। তারপর মানুষ। এদের প্রাণ, চলাফেরার শক্তির পাশাপাশি রয়েছে বুদ্ধি ও চিন্তা করার ক্ষমতা। এটা হলো দৃশ্যমান বস্তু জগতের স্তর সমূহ। মানুষ একই সাথে দৃশ্যজগত এবং অদৃশ্য জগতের সাথে সম্পৃক্ত। তার পঁচনশীল মাটির দেহটি ইহ জগতের, কিন্তু তার অবিনশ্বর আত্মা ঊর্ধ্বলোকের। মানুষের মাধ্যম হয়ে দৃশ্য জগতের স্তর উন্নীত হবে অদৃশ্য জগতের বা আলমে আকলীর স্তরে। এর প্রথম স্তরে মাহাকাশ ও গ্রহ নক্ষত্র। এর উপরে বিশ্ব-আত্মা বা (universal soul)। জগতের সমস্ত ক্রিয়া কর্মের চালিকা শক্তি। এর উপরে বোধগম্য জগতের স্তর (inteligible souls) অর্থাৎ, ফেরেশতা, মানবাত্মা বা এমন অদৃশ্য সৃষ্টি যাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। এবং সবার উপর স্তরে রয়েছেন একক বা আল্লাহ।

উপর থেকে ক্রমানুসারে স্তরবিন্যাস করলে চিত্রটি এমন দাঁড়ায়–

একক বা আল্লাহ
|
উপলব্ধিগত আত্মার স্তর ( inteligible world)
|
বিশ্ব আত্মা (universal soul)
|
গ্রহ নক্ষত্র
|
মানুষ
|
প্রাণীকুল
|
উদ্ভিদ
|
খনিজ স্তর
|
পৃথিবীর চার মৌল উপাদান। (এই স্তরটি প্লাটিনাস যুক্ত করেছেন)

সৃষ্টির ধারা

সৃষ্টিজগতের এই স্তরবিন্যাস ও শৃঙ্খলকে the great chain of beings বলা হয়। এই শৃঙ্খলে থাকা কোন বস্তু তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারবে না। সক্রেটিস মনে করতেন, প্রতিটি স্তর অপর স্তরের সাথে কিছু কিছু দিক দিয়ে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ প্রতিটি স্তরের মাঝেই এমন কিছু গুনাগুণ আছে যা তার উপরের স্তরেও পাওয়া যায়। এই কমন এলিমেন্টসের মাধ্যমে স্তরগুলোর পারস্পরিক সংযোগ তৈরী হয়েছে। এই ব্যাপারটা আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মুসলিম দার্শনিকগণ।

great chain of being থেকে একথা বুঝা অসম্ভব যে, একটি স্তর পরিবর্তিত হয়ে অপর স্তরে উন্নীত হয়েছে। বরং গ্রীক দার্শনিকদের বিশ্বাস ছিলো, গোটা জাগৎ তার যাবতীয় সৃষ্টিকূল-সহই অনাদি অবিনশ্বর। এই সৃষ্টির কোন শুরু নাই, শেষও নাই, এটা অখণ্ড এবং অপরিবর্তনীয়। নতুন কিছু সৃষ্টিও হয় না, আবার কোনকিছু ধ্বংসও হয় না। সবকিছু শুরু থেকে ছিলো, এবং চিরকাল থাকবে। যারা ইলমুল কালামের সাথে পরিচিত তারা ‘ক্বিদামুল আ-লাম’ নামক বাক্যটির সাথে পরিচিত আছেন। ইসলামী দর্শন এবং গ্রীক দর্শনের সাথে যে কয়টি মৌলিক বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে তার মাঝে এটি একটি। আমরা স্রেফ আল্লাহর ক্ষেত্রে অনাদি ও অবিনশ্বর হওয়ার কথা বলি।

সুতরাং গ্রীক দার্শনিকদের কাছে কোন বস্তুর এক স্তর থেকে পরিবর্তিত হয়ে অন্য স্তরে উন্নীত হওয়াটা অবান্তর কথা। তথাপি অনেককেই দেখেছি, তারা যখন বিবর্তনবাদের জিনিওলজি বর্ণনা করেন তখন প্লাটো এরিস্টটল বা অন্যান্য গ্রীক দার্শনিকদের থেকে শুরু করেন। আদতে ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের সাথে এই গ্রান্ড স্ট্রাকচারের সম্পর্ক ডায়ালেক্টিক্যাল। তবে ডারউইন এই স্তরবিন্যাস থেকে তার বিবর্তনবাদের ধারণাটি মডেল হিসেবে পেয়ে থাকতে পারেন। যেহেতু the great chain of being তত্ত্বের ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন। এক চিঠিতে তিনি জনৈক ডাক্তার হবসকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান সক্রেটিসের দ্য হিস্টোরি অফ এনিম্যাল বইটি দেয়ার জন্য।

২.

মুসলিম দার্শনিকগণ গ্রীক দর্শন থেকে অবাধে গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় the great chain of being এর ধারণাটিও গ্রহণ করেছেন, এবং সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যায় এটা ব্যাবহার করেছেন। আরবীতে বলা হয়, سلسلة وجود العظمي.

তবে যথারীতি মুসলিম দার্শনিকগণ এই তত্ত্বকে কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে চেয়েছেন। আমরা পূর্বেই বলেছি, ইখওয়ানুস সাফা, মিসকাওয়াইহ ও ইবনে খালদুন প্রমুখদের বক্তব্য প্রায় একই। বরং ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দিমায় মিসকাওয়াইহ-এর আল ফাওযুল আসগার কিতাব থেকে কিছু কাটছাট করে অনেকটা আক্ষরিক অনুলিপি করেছেন। সেজন্য এই তিনজনের ব্যাপারে আলাদা আলাদা করে না বলে একই সাথে বলা যায়। আমি আলোচনার সুবিধার্থে ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমাকে সামনে রেখেছি। এবং সেখান থেকে তার বক্তব্যের সার-নির্যাসটুকু উপস্থাপন করবো।

ইবনে খালদুন বলেন–‘আমরা যদি জগতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই পুরো সৃষ্টি জগতটাই খুব চমৎকারভাবে স্তরিত ও বিন্যস্ত, এবং কার্য ও কারণের সাথে মজবুতভাবে সম্পৃক্ত। একটি সৃষ্টি আরেকটি সৃষ্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রথমে পৃথিবীর মৌল উপাদান তৈরী হলো, সৃষ্টির ধারাবাহিকতার মাধ্যমে। জমিনে সৃষ্টি হলো মাটি, তারপর একে একে পানি, হাওয়া ও আগুন। এই চারটির প্রতিটিই একটি অপরটির সাথে সম্পৃক্ত। এবং এদের মাঝে এমন কিছু যোগ্যতা আছে যার মাধ্যমে সে তার নিম্ন স্তরে বা উপরের স্তরের বস্তুতে পরিণত হতে পারে।

‘তারপর আমরা দেখি, সৃষ্টি জগতের শুরু হয়েছে খনিজ থেকে। তারপর আসলো উদ্ভিদ, এর ধারাবাহিকতায় অনুপম আকারে সৃষ্টি হলো প্রাণী জগৎ। তারপর চিন্তা ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।
(এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বুঝাতে গিয়ে ইবনে খালদুন শব্দ ব্যবহার করছেন–তাদরীজ, ( تدريج) যা ক্রমপর্যায় বুঝায়। আর বিবর্তন বুঝানো হয়–তাত্বাওউর (تطور) শব্দ দিয়ে।)’

এই প্রতিটি স্তর আবার বহুস্তর বিশিষ্ট। খনিজের সর্বোচ্চ স্তর উদ্ভিদের সর্বনিম্ন স্তরের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন ঘাস বা বীজহীন উদ্ভিদ। এরা প্রায় নিষ্প্রাণ, অন্যান্য উদ্ভিদের মতো এরা বাড়ে না। আবার উদ্ভিদের সর্বোচ্চ স্তর প্রাণীর সর্বনিম্ন স্তরের সাথে সম্পৃক্ত। উদ্ভিদের সর্বোচ্চ স্তর হলো খেজুর গাছ। খেজুর গাছের সাথে শামুক ও ঝিনুকের সম্পৃক্ততা আছে। কেননা শামুক ও ঝিনুকের কেবল প্রাণ এবং স্পর্শশক্তিটুকুই আছে, অন্যকোন অনুভূতি শক্তি নেই। খেজুর কিভাবে উদ্ভিদের সর্বোচ্চ স্তর হয়, সেটা মিসকাওয়াইহ এবং ইখওয়ানুস সাফা-এর দার্শনিকগণ বর্ণনা করেছেন। তারা প্রমাণ হিসেবে একটি হাদীস উল্ল্যেখ করেছেন–রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা তোমাদের ফুফু খেজুর গাছের যত্ন নিও, কেননা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদম সৃষ্টির পর অবশিষ্ট মাটি থেকে।

হাদীসটি যদিও জাল, কিন্তু এখান থেকে একটি স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তারা যদি তথাকথিত বিবর্তনবাদের প্রবক্তা হতেন, তাহলে আদম সৃষ্টি সম্বলিত কোন হাদিসকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করতেন না।

ইবনে খালদুন বলেন, ‘এইযে আমি বলছি একটার সর্বনিম্ন পর্যায়ের সাথে অপরটার সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্পৃক্ততা আছে, এই সম্পৃক্ততার মানে কী? এর মানে হলো, এদের উভয়ের মাঝে কিছু কমন এলিমেন্টস আছে, যার মাধ্যমে সে অপর স্তরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিংবা সর্বনিম্ন স্তর থেকে সে অপর স্তরের সর্বোচ্চ স্তরে আসীন হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এই কমন এলিমেন্টসই তাদেরকে সম্পর্কযুক্ত করে রাখে।’ যে কথা সক্রেটিসও বলেছেন।

খালদুন বলেন, ‘প্রাণীদের সর্বোচ্চ স্তর হলো বানর। বানরের সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা আছে। কেননা বানর কিংবা এ জাতীয় প্রাণীদের অনুভূতি শক্তি, চালচলন, এমনকি কিছু কিছু দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের বেশ কাছাকাছি। কিন্ত সুসংহতভাবে চিন্তার ক্ষমতা, উন্নত বুদ্ধি, বাকশক্তি ইত্যাদির কারণে তারা মানুষের চেয়ে অনেক নিচের স্তরের প্রাণী।’

আমাদের উদ্দিষ্ট আলোচনা এতটুকুই। বাকি খালদুন তার সৃষ্টি শৃঙ্খলার বিবরণ আল্লাহ পর্যন্ত দিয়েছেন।

তো, ইখওয়ানুস সাফা, মিসকাওয়াইহ ও ইবনে খালদুনের এই লেখায় বানর শব্দটির উল্লেখ পেয়ে সকলেই প্রায় চোখবুজে নিশ্চিত হয়ে গেছেন, এটা ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদের প্রি-স্ট্রাকচার না হয়েই যায় না। কিন্তু কথার আগপর চিন্তা করে এবং এই বক্তব্যের মূল উৎস সন্ধান করে কেউ ভেবে দেখারও প্রয়োজন অনুভব করেন না যে বিবর্তনবাদের সাথে এই কথার দূরতম কোন সম্পর্কও নাই। এই কথা থেকে কি কোনভাবে বুঝে আসে যে, তিনি বানর থেকে মানুষ হওয়ার তত্ত্ব বলছেন? তাদরীজ এবং তাত্বাউর শব্দদয়ের পার্থক্য আমরা বলে এসেছি আগেই। বানরের সাথে আমাদের বহু সাদৃশ্যের কথা কেউ কি কখনো অস্বীকার করেছে? কিন্তু কারো সাথে কিছু বিষয়ের সাদৃশ্য থাকলেই কি ওই জিনিস থেকে বিবর্তিত হয়ে আসাটা আবশ্যক? যদি তাই হয়, তাহলে ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী শামুকের বিবর্তন খেজুর গাছ থেকে, ঘাসের বিবর্তন খনি থেকে, এবং ফেরেশতার বিবর্তন মানুষ থেকে হওয়াটা আবশ্যক হয়। সেটা কি এই নব্য বিবর্তনবাদীরা স্বীকার করেন?

ইবনে খালদুন এবং মিসকাওয়াইহ, উভয়েই এই আলেচনা এনেছেন নবুওয়তের অধ্যায়ে। খালদুন এই অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন–আমরা এখন নবুওয়তের হাকীকত নিয়ে আলোচনা করবো পূর্ববর্তীদের ব্যাখ্যানুযায়ী। তাদের উদ্দেশ্য হলো, এই দৃশ্যমান বস্তুজগতে যাবতীয় সৃষ্টিসমূহের যে স্তরবিন্যাস রয়েছে, এর মাঝে সর্বোচ্চ স্তরে মানুষের অবস্থান। এই মানুষের মাঝে সর্বোচ্চ স্তরে আছেন নবী ও রাসুলগণ। মানুষের সাথে ঊর্ধ্ব জগতের যে সম্পর্ক সেটা নির্মাণ হয়েছে তাদের মাধ্যমে। একজন নবীর উপর যখন ওহি অবতীর্ণ হয়, তখন তিনি এই বাহ্য জগৎ ছেড়ে ঊর্ধ্বলোকের সাথে সম্পর্কিত হন। এভাবে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের সাথে আলামে মালাকুত বা ফেরেশতা জগতের সাথে সম্পৃক্ততা তৈরী হয়। অর্থাৎ, যেভাবে মানুষ সৃষ্টিকুলের সর্বোচ্চ স্তরে আছে, তেমনই মানুষদের মাঝে সর্বোচ্চ স্তরে আছেন নবী-রাসুলগণ।

এর অব্যবহিত পরেই খালদুন রুহের প্রকার নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি প্রকার রূহের কথা বলেন- এর মাঝে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রূহ হলো নবী ও রাসুলদের। তাদের রূহ কেবল এই ইহলোকেই নয়, বরং মাঝেমাঝে তা ইহলোক ছেড়ে ঊর্ধ্বলোকের সাথে মিলিত হয়। কিন্তু পুরো আইডিয়াটা ঠিকই গ্রীক দর্শন থেকে নিয়েছেন। এটা একদম স্পষ্ট বিষয়।

সেদিন এক ভদ্রলোক ইবনে খালদুনকে বিবর্তনবাদী বানাতে গিয়ে যা-তা বলছিলেন। এবং আমাকে গোবেচারা টাইপের বোকা-সোকা মানুষ পেয়ে বলে বসলেন, ইবনে খালদুন আদম-হাওয়ার যে প্রচলিত ন্যারেটিভ আছে ধর্মের বইয়ে, সেটাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, আদম-হাওয়া বলতে নির্দিষ্ট কোন একজন পুরুষ ও নারীকে বুঝায় না, বরং মানুষের একটি দলকে বুঝায়।
মানে, যারা কেবল বিবর্তিত হয়ে মানুষ হয়েছে।

এমন উদ্ভট কথা ইবনে খালদুন কোন কিতাবে বলেছেন, কিভাবে বলেছেন সেসবের কিছুই তিনি জানালেন না। কিন্তু আমি যখন ‘তারিখে ইবনে খালদুন’ ওল্টালাম, তখন কিতাবের একদম প্রথম পৃষ্ঠাতেই দেখি তিনি লিখেছেন–‘বংশবিদগণ সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, মানুষের বংশতালিকা শুরু হয়েছে আদম ও হাওয়া থেকে। তারাই পৃথিবীর প্রথম মানুষ।’

এরপর খালদুন আদম সৃষ্টি সম্পর্কিত বেশকিছু আয়াত উল্লেখ করেন, এবং সে সংক্রান্ত আলোচনা করেন। কিন্তু এর মাঝে এমন একটি শব্দও পাইনি যা থেকে বুঝা যাবে যে আদম আঃ-এর প্রথম মানুষ হওয়ার ব্যাপারে তার মনে কোন ধরণের সন্দেহ আছে, কিংবা তিনি এসবের ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। একই কথা মিসকাওয়াইহ-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার রেখে যাওয়া প্রচুর কিতাব এখনও বিদ্যমান আমাদের মাঝে। এর কোনটা থেকে কেউ আজ পর্যন্ত এটা বের করতে পারে নাই যে, তিনি আদম আঃ-এর প্রথম মানুষ হওয়াকে অস্বীকার করছেন! তাহলে তারা কোনধরনের বিবর্তনবাদের সন্ধান দিয়ে গেলেন? ভাবা যায়, এই একটা-দুইটা প্রচ্ছন্ন শব্দ আর বাক্য দিয়ে একেকজন মানুষের উপর এতো বড় বড় বোঝা কী অবলীলায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে! তারপর শুরু হয় এক অসম মল্লযুদ্ধ। তখন লেখকের অন্যান্য স্পষ্ট বক্তব্যকেও মার-প্যাঁচে ফেলে নিজের অলীক দাবী ও ব্যাখ্যার মোয়াফেক করে রাখার অনর্থক চেষ্টা।

জাহেজকে নিয়ে সবচে বেশি উৎসাহ দেখান বিবর্তনবাদীরা। অনেকেই মনে করেন, জাহেয ডারউইনের চেয়েও এডভান্স ছিলেন বিবর্তনবাদী তত্ত্বে। এইভেবে আমাদের কতিপয় মুসলিম ভাই এক ভিন্ন রকমের গৌরব অনুভব করেন ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এই গৌরব দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষের একাডেমিক জালিয়াতি, বক্তব্যের ইচ্ছাকৃত মিস ইন্টারপ্রিটেশন, সর্বোপরি এক বৃহৎ অসততার উপর।

প্রতিটি প্রাণী তার নিজের খাবার সংগ্রহ এবং অপরের খাবার না হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামরত। এটা একটা দৃশ্যমান বাস্তবতা, কোন তত্ত্ব না। জাহেজ এই কথা বলেছেন। ইঁদুর যখন খাবার সংগ্রহের জন্য বের হয়, তখন সে নিজে যেন অন্যের খাবারে পরিণত না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকে। জাহেয তার কিতাবুল হাইওয়ানে এটা দেখিয়েছেন। এবং এও দেখিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি অঞ্চলের আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রতিবেশ অনুযায়ী প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য দান করেন। আফ্রিকার মরুসিংহ বাংলাদেশের সুন্দরবনে টিকবে না, তেমনি নর্থ পোলের শ্বেত ভল্লুক সাহারার মরু অঞ্চলে একদিনও টিকবে না। একইভাবে ভৌগলিক ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাণীকুলের স্বভাব-চরিত্র ও চাল-চলনে কী পরিমাণ পরিবর্তন সাধিত হয়, সেটা দেখিয়েছেন। ইবনে খালদুনও তার মুকাদ্দিমায় এই আলোচনা এনেছেন।

কিন্তু জাহেযের নামে যেটা বলা হয়,তিনি বলেছেন, প্রাণীরা তাদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি তাদের পরবর্তী বংশধরের কাছে পৌঁছে দেয়, সেটা এক অলৌকিক কথা। তার কিতাবাদি ঘেঁটে এমন কথার সন্ধান মেলে না। ইন্টারনেটে যত আর্টিক্যাল পাবেন জাহেযের বিবর্তনবাদ বিষয়ে, সবগুলোতে এমন প্রচুর হাওয়াই কথাবার্তা পাবেন তার নামে। এর উৎস হলো মেহমুত বায়ারকদার নামক এক তুর্কী মুসলিম গবেষক Al- jahij and the rise of biological evolution নামে একটি গবেষণাপত্র লেখেন। সেটা ছাপা হয় লন্ডনের নামিদামি একটি সাইন্স জার্নাল থেকে। সেখানে তিনি এমন অনেক কাণ্ড ঘটিয়ে রেখেছেন। ভুল তর্জমা, মনগড়া ব্যাখ্যা, কখনো নিজের কথাকে জাহেযের কথা বলে চালিয়ে দেয়া, এবং যথাযথ সূত্র ও রেফারেন্স না দেয়া, সবমিলিয়ে খুবই নিম্ন পর্যায়ের চাতুরিপূর্ণ একটি গবেষণাপত্র ছিলো সেটা। কিন্তু সেই গবেষণাপত্রটিই ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় সকলের কাছে। অসংখ্য বই, আর্টিক্যাল ও রিসার্চ পেপারে এর সাইটেশন আছে। তারমতো এরকম আরও কয়েকজনের এই অতিউৎসাহি কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ কোন বাছবিচার ছাড়াই জাহেযকে ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদের গুরু মেনে বসে আছে।

ডক্টর মেহমুতের জালিয়াতির একটা উদাহরণ দিই। পূর্বের যুগের অনেক সম্প্রদায়কে আল্লাহ শাস্তিস্বরূপ বিভিন্ন প্রাণীতে রূপান্তরিত করেন। কোন সম্প্রদায়কে বানর, কোন সম্প্রদায়কে শুকর, আবার কাউকে শয়তানের উপাসকেও পরিণত করেছেন। তো, জাহেয চতুষ্পদ প্রাণী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন–শাস্তিস্বরূপ চতুষ্পদ প্রাণীতে রূপান্তরিত হওয়ার (মাসখ) ব্যাপারে নানান ধরণের কথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, আজকের চতুষ্পদ প্রাণীরা তাদের বংশধর না। বরং যাদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছিলো তাদের মৃত্যুর মাধ্যমেই এর বংশধারা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে বানরের বংশধর রয়ে গেছে। অর্থাৎ এখনের বানররা সেই শাস্তিপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের বংশধর। তাদেরকে রেখা দেয়া হয়েছে মানুষের শিক্ষা লাভের জন্য। আবার কেউ কেউ মনে করেন, যারা শাস্তিস্বরূপ পশুতে রূপান্তরিত হয়েছিলো, তাদের বংশধররাই এখন পর্যন্ত আছে। এবং তাদের বংশ থেকেই অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি হয়েছে। একই কথা তারা সাপের ব্যাপারেও বলে।

তো এই হলো জাহেজের বক্তব্য। তার এই আলোচনা মূলত মুসলিম শরীফের একটি হাদীসের সাথে সম্পৃক্ত। সাহাবাগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পূর্বের যুগের শাস্তিপ্রাপ্ত পশু হয়ে যাওয়া মানুষদের বংশ বিস্তার হয়েছে কি হয়নি। কিন্তু এই আলোচনাকেই জনাব মেহমুত একটি কনক্রিট বিবর্তনবাদি থিউরিতে রূপান্তরিত করলেন। তিনি এই প্যারার অনুবাদ করতে গিয়ে লেখেন– He says: people said different things about the existence of al-miskh ( original form of the quadruped). Some accepted it’s evolution, and said that,it gave existence to dog,wolf,fox, and their similars. The members of this family came from this form ( al-miskh).

এই অংশটুকুর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে অনেক বই ও আর্টিক্যালে, আমি নিজে দেখেছি বেশ কয়েক জায়গায়। অথচ এখানে জাহেযের কথার পুরো অর্থটাকেই পাল্টে দেয়া হয়েছে এবং সুযোগমতো
তার উদ্দিষ্ট এভ্যুলোশন শব্দটি বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিবর্তনবাদকে এডাপট করার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আদম ও হাওয়া সৃষ্টির কাহিনিকে অস্বীকার করতে হবে, নতুবা বিবর্তনবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, এমন কোন ব্যাখ্যা করতে হবে। কিন্তু ইসলামের এই সুদীর্ঘ জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এমন কাউকে আমরা দেখি না যারা এই কাজটি করেছেন। না জাহেয, না ইবনে খালদুন, না মিসকাওয়াইহ, না ইখওয়ানুস সাফা। তারা সকলেই নিজেদেরকে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের বংশধর মনে করতেন। এর হাজার হাজার প্রমাণ রয়েছে। নিজেদেরকে বানরের কাজিন মনে করতেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রিচার্ড ডকিন্স যেমন বলেছেন–এতে সামান্যতম কোন সন্দেহও নাই যে, আমরা বানরের কাজিন!

যাইহোক, আমার ইচ্ছা ছিলো জাহেজের প্রসঙ্গে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করার। কিন্তু বিষয়ের জটিলতা, লেখার দৈর্ঘ্য আর ধৈর্যের অভাব–সবমিলিয়ে যারপরনাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সামনে কোনদিন জাহেযকে নিয়ে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে, আরেকটু ব্যাপকভাবে, এবং আরও দলীল প্রমাণসহ।
[সৌজন্যে- ফাতেহ ২৪ ডট কম]