Home সোশ্যাল মিডিয়া দ্বীনের তরে নিবেদিত এক মহান বুযূর্গ পীরে কামেল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী...

দ্বীনের তরে নিবেদিত এক মহান বুযূর্গ পীরে কামেল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (দা.বা.)

।। মাহদী হাসান ।।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসচিব ও রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শায়খুল হাদীস পীরে কামেল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (দা.বা.)এর শান ও ব্যক্তিত্ব এতটা উচ্চ মাকামে যে, হযরতকে নিয়ে কিছু লেখার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু জামিয়ার একজন নগন্য ছাত্র হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে হযরতকে কাছে থেকে দেখে আসছি। হযরতের স্পষ্ট কারামত, দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগ, উন্নত ব্যক্তিত্ববোধ ও উচ্চ মাকাম সংশ্লিষ্ট বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য দান করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের এমনই একটি ঘটনা লেখার ইচ্ছা সংবরণ করতে না পেরে কলম হাতে নিলাম।

গত ২৮ জানুয়ারী ২০২০ইং মঙ্গলবার মাহফিল ছিল জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার একটি মাদ্রাসায়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে হযরতের দাওয়াত প্রায় একবছর আগে ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল। লেখার পর থেকেই সময়ে সময়ে সেই মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতী শামসুদ্দিন সাহেব যোগাযোগ করে আসছিলেন। সকালে একবার ফোন দিতেন তো বিকালে আবার ফোন দিতেন। হযরতের উপস্থিতির বিষয়ে মুফতী শামসুদ্দিন সাহেবের ব্যাকুলতা ছিল খুবই গভীর ও অতুলনীয়।

দেখতে দেখতে সামনে এসে হাজির হলো ২৮ জানুয়ারী ২০২০ইং মঙ্গলবার। আগের রাতে হুজুরের প্রোগ্রাম ছিল ঢাকার বাহিরে অন্য এক মাদ্রাসায়। সেখানে বয়ান শেষ করে জামিয়ায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাতের আড়াইটা বেজে যায়। হালকা নাস্তা ও ঔষুধ খেয়ে বিছানায় যেতে তিনটা বেজে যায়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়ে ছিলেন হয়তো। ফজরের জামাতের এক ঘণ্টা আগে হযরত বিছানা ছেড়ে তিলাওয়াত ও অন্যান্য নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যান।

অতঃপর ফজরের সালাত আদায় শেষে দেখা যায় হযরতের চোখে ঘুমের গভীর চাপ। বৃদ্ধ মানুষ, লাগাতার ভ্রমণের ক্লান্তি ও প্রয়োজনীয় ঘুমের অভাব।

ঘুম চোখেও ফজরের পর প্রতিদিনের মত সে দিনও কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াতের পর দূর্বল শরীর নিয়ে আর বসে থাকতে পারলেন না, বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। সফরসূচী নিয়ে আগের দিনের আলোচনায় আজ জামালপুর প্রোগ্রাম থাকায় সকালেই রওনা দেওয়ার কথা ছিল।

জামালপুর আমার মাতৃভূমি, আমার জন্মস্থান। তাই আমি সাহস করে হুজুরকে মৃদস্বরে অনুনয় করে বললাম, “হুজুর! আজ জামালপুর প্রোগ্রাম, এখন রওয়ানা দেয়ার কথা ছিল”। হুজুর বললেন, “অবশ্যই এই প্রোগ্রামে জমিয়তের স্বার্থে যেতেই হবে; তবে একটু বিশ্রাম করে নেই”।

এরপর মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে হযরত রওয়ানা হলেন আমার প্রিয় মাতৃভূমির জামালপুর মেলান্দহ জামিয়া হুসাইনিয়ার ঐতিহাসিক ইসলামী মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্যে। রাস্তার অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। বিশেষভাবে মোমেনশাহী থেকে জামালপুরের দিকে মুক্তাগাছার রোড ছিল প্রচন্ড ভাঙা-চোরা। হুজুরের অনেক কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু নীরবই থাকলেন। অবশেষে কাঙ্খিত জামালপুরের মেলান্দহ গিয়ে পৌঁছলাম। জামালপুর জেলা যুব জমিয়তের আহবায়ক মাওলানা ইমাম হোসাইন ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, রাস্তায় রাহবার হিসেবে সহযোগিতা করার জন্য।

অতঃপর হুজুরের জন্য নির্ধারিত খাস কামরায় হুজুরকে নিয়ে যাওয়া হলো। জামালপুরে উলামায়ে কেরামগণ সাক্ষাৎ করলেন এবং যথেষ্ট ক্বদরও করলেন। এর মধ্যে মুফতি শামসুদ্দিন সাহেব এসে আমাকে ডাক দিলেন- মাহদী সাহেব, আল্লামা কাসেমী সাহেব হুজুরকে বাদ মাগরীব বয়ানে দিবো। আমি বললাম জ্বি ঠিক আছে। অত:পর নির্ধারিত সময়ে বাদ মাগরীব হুজুর মঞ্চে তাশরীফ নিলেন। খতমে নবুওয়াতে অস্বীকারকারী ভ্রান্ত কাদিয়ানী ফেরকাসহ মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয় ও বহুবিধ সংকট এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশ্লেষণ ও দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান বয়ান করলেন।

বয়ান শেষ করার পর স্টেজ থেকে নেমেই হুজুর গাড়িতে ওঠলেন। অতঃপর হুজুর ড্রাইভারকে বললেন, সরাসরি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে। হুজুর বিকেলে হালকা নাস্তার পর বয়ান শেষে যেহেতু রাতের খাবার খাননি, তাই ড্রাইভার আমীর ভাই ও আমি ইতস্ত করছিলাম, হুজুরের কষ্টের কথা ভেবে। কিন্তু হুজুর তাগিদ দিয়ে বললেন, বয়ান যেহেতু শেষ হয়েছে এখানে আর সময় ক্ষেপণের জরুরত নাই। ঢাকার রাস্তা বেশ লম্বা, রাস্তাও ভাল না, রাতেই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। কাল ফজরের পর আবার ফেনীতে দ্বীনি প্রোগ্রাম আছে। বয়ান শেষে হাদিয়ার দিকেও হুজুরের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। (বয়ানে গেলে হুজুর হাদিয়ার জন্য মূলত: কোথাও ভ্রুক্ষেপ করেন না)।

আমি অবাক হয়ে গেলাম সেই সুদূর ঢাকা থেকে জামালপুরের ক্লান্তিকর দীর্ঘ সফর, ভারি কোন খাবারও খেলেন না। আবার হুজুরের হাদিয়ার দিকেও কোন ভ্রুক্ষেপই নেই এবং এ ব্যাপারে কাউকে কোন কিছু জিজ্ঞাসাও করলেন না। সত্যিই হুজুরের কোন তুলনা হয় না। হুজুর অনন্য, হুজুরের তুলনা হুজুর নিজেই। আমি চিন্তা করলাম, আমাদের আকাবীরগণ মনে হয় এমনই ছিলেন, যারা নিজেদের অর্থ ও পরিশ্রম দিয়ে সবসময় দ্বীনের খেদমত করে যেতেন। এই বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ ও দুর্বল শরীর নিয়ে একের পর এক দ্বীনি মাহফিলের প্রোগ্রামে হাজির হওয়া, জমিয়তের কাজ, মাদ্রাসায় দরসদান, ইবাদগুজার, সাক্ষাতপ্রার্থীদেরকে সময়দান; কোন তরুণ সবল আলেমের পক্ষেও এত পরিশ্রম দু:সাধ্য। স্রেফ হুজুরের স্পষ্ট কারামত, দৃঢ়মনোবল এবং আল্লাহর গায়েবী মদদ ও রহমত ছাড়া এটা কখনোই সম্ভবপর ছিল না।

শুধু এই প্রোগ্রামই না, আমি অনেক প্রোগ্রামেই হুজুরকে দেখেছি, হুজুর হাদিয়ার দিকে কোন প্রোগ্রামেই ভ্রুক্ষেপ করেন না। কোন চেয়ারে বসলেন, পোস্টারে নাম কোথায় দিল না দিল- এসবকে হুজুর কখনোই গুরুত্ব দিতেন না। যে কোন প্রোগ্রামেই হুজুরের বয়ান শেষ হলেই পরবর্তী প্রোগ্রামের পথে রওনা হন অথবা হুজুরের সুপ্রতিষ্ঠিত বারিধারা মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। আল্লাহর ওলী ও বুযূর্গগণ এভাবেই প্রতিটা মিনিট ও সেকেণ্ডকে কাজে লাগান। একটু সময়ও কখনো অপচয় হতে দেন না।

হযরতের সুস্থতা ও দীর্ঘ হায়াতের জন্য সকলের কাছে বিশেষভাবে দোয়া চাচ্ছি। পরম করুণাময় আল্লাহ যেনো হযরতের ছায়াকে আমাদের উপর অনেক অ-নে-ক দীর্ঘায়িত করেন। আমীন।

– মুহাম্মদ মাহদী হাসান, মাদারগঞ্জ, জামালপুর।
শিক্ষার্থী- জামিয়া মাদানীয়া বারিধারা, ঢাকা।