Home ইসলাম রোযার শর্ত, বিধান, কর্তব্য ও প্রতিফল

রোযার শর্ত, বিধান, কর্তব্য ও প্রতিফল

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

রোযার উদ্দেশ্যঃ মানব জীবনের জৈবিক যথেচ্ছা চারিতার পরিবর্তে আত্মিক উৎকর্ষতা, পাপাচার দুষ্ট উশৃঙ্খলতার পরিবর্তে কাঙ্খিত মানবতা এবং আল্লাহ্ বিমুখিতার পরিবর্তে আল্লাহর খুশীর পথ উন্মোচন করাই রোযার আসল উদ্দেশ্য। ক্ষুধার দ্বারা মানব মনের অত্ম-কামনাকে বিসর্জন দিয়ে মনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্তরকে পবিত্র করে অত্মশুদ্ধি লাভ করানোই রোযার উদ্দেশ্য।

রোযার বিধানগত ইতিহাস

প্রত্যেক পয়গাম্বরের যুগে আল্লাহ্ তাআলা রোযার বিধান জারী করেছিলেন। তবে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন নিয়মে রোযার বিধান জারী ছিল। যাথা-

১। হযরত আদম (আ.)এর উপর প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা ফরয ছিল।
২। হযরত নূহ্ (আ.) সর্বদা রোযা রাখতেন।
৩। হযরত দাউদ (আ.) একদিন পর একদিন রোযা রাখতেন।
৪। ইহুদীদের উপর আশুরা বা ১০ই মুহররম-এর রোযা এবং প্রত্যেক শনিবারের রোযা ছাড়া আরো কিছু দিনের রোযা ফরয ছিল।
৫। হযরত ঈসা (আ.) দু’দিন পর পর রোযা রাখতেন।
৬। নাসারাদের উপর রমযানের রোযাই ফরয ছিল। কিন্তু, বেশী গরম ও ঠান্ডার সময় তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে বসন্তকালে ত্রিশ রোযার স্থলে পঞ্চাশ রোযা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।
৭। শেষ পর্যায়ে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর রমযানের রোযা ফরয হয়।

লেখার প্রথম অংশ পড়ুন- ‘মাহে রমযান ও সিয়াম সাধনা’

রোযার বিধান

সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়্যাতে পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই রোযার বিধান। এটা ফরয তথা অবশ্যই করণীয় কাজ। এ জন্যেই আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর ফরয করা হয়েছিল”।

উল্লেখ্য যে, ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে মুসলমানদের উপর মুহররম মাসের দশম তারিখে রোযা রাখার বিধান ছিল। তারপর এ হুকুম রহিত করে প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযার বিধান আরোপ করা হয়। এরপর এ বিধান রহিত করে রমযান মাসের রোযাগুলো ফরয করা হয়। এ বিধানমতে রমযান মাসের প্রতিদিন সুব্হে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে রোযার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তাই আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর”।

তাছাড়াও, রোযার বিধানের মধ্যে রয়েছে- (১) যাদের উপর রোযা ফরয। (২) রোযার শর্ত। (৩) রোযার মধ্যে করণীয় কর্তব্য সমূহ। (৪) রোযার ক্বাযা ও কাফ্ফারা। (৫) ক্বাযা রোযার হুকুম। (৬) কাফ্ফারার রোযার হুকুম। (৭) রোযা ভঙ্গের কারণ। (৮) রোযা না রাখার শর্ত। (৯) রোযার মাকরূহ বা ক্ষতিকর দিক সমূহ। (১০) সাহরীর হুকুম। (১১) ইফতারীর হুকুম। (১২) তারাবিহ্র নামায ইত্যাদি। নিুে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা যাচ্ছে।

যাদের উপর রোযা ফরযঃ
রমযান মাসের রোযা প্রত্যেক সাবালক সুস্থ্য মস্তিস্কের অধিকারী মুসলমান ধনী-গরীব, চাষা-মজুর, নর-নারীর উপর রোযা রাখা ফরয।

রোযার শর্ত

রোযা রাখার জন্য রোযার নিয়্যাত করতে হবে। (অর্থাৎ সংকল্প করতে হবে যে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা রাখব এবং পানাহার বা সহবাস করব না)। রোযার নিয়্যাত সুবহে সাদিকের পূর্বে রাত্রি ভাগে করা উত্তম। তবে, ভুলে গেলে দ্বীপ্রহরের পূর্বেই নিয়্যাত করতে হবে। কিন্তু, শর্ত থাকবে যে, ঐ সময় পর্যন্ত কোন পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। বেলা ১১টার পরে রোযার নিয়্যাত করলে রোযা হবে না। তবে ঐ অবস্থায় উপবাস থাকতে হবে। ঐ দিনের রোযা পুণরায় ক্বাযা করে পুরণ করে দিতে হবে।

লেখার ২য় অংশ পড়ুন- রমযান মু’মিনের জন্য কী প্রতিফল বয়ে আনে?

রমযানের রোযা রেখে ইচ্ছাপূর্বক দিনের বেলায় পানাহার করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে তার জন্য ক্বাযা এবং কাফ্ফারা উভয়ই আদায় করতে হবে। সূর্যোদয়ের দেড় ঘন্টা পূর্বেই সাহরী খাওয়া শেষ করতে হবে। অনিচ্ছাকৃত বা ভুলের কারণে রোযা ভেঙ্গে গেলে কাফ্ফারা আদায় করতে হবে না, তবে ক্বাযা আদায় করতে হবে।

চাঁদ দেখে রোযা রাখতে হবে এবং চাঁদ দেখে ঈদ করতে হবে। যে সব দেশে রাত-দিন ছয় মাস পর্যন্ত দীর্ঘ হয়, সে সব দেশের অধিবাসীগণ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দিবা-রাত পরিবর্তন হয়, এমন পার্শবর্তী দেশের সাথে মিলে রোযা রাখবে এবং ইফতার করবে। নিয়্যাত যদিও শর্ত, তবে সাহরী খাওয়াটাই নিয়্যাতের স্থলাভিষিক্ত ধরা হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমাদের রোযা আর ইহুদী-নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো, সাহরী খাওয়া”। তাই রোযার নিয়্যাতেই সাহরী খেতে হবে।

রোযার মধ্যে করণীয় কর্তব্য সমূহ

নামাযকে সংরক্ষণ করা, উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া এবং কুফরী ও দ্বীনের প্রতি গালমন্দ করা থেকে সতর্ক থাকা। কোন অসার ও কটূ কথা না বলা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যদি তোমাদের কেউ সিয়াম (রোযা) পালনকারী হয়, তবে সে যেন কোন বেহুদা কথা না বলে। আর যেন কর্কশ ভাষি না হয়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা মারতে উদ্যত হয়, তবে সে যেন বলে আমি রোযাদার।

ধুমপান ত্যাগে সচেষ্ট হতে হবে। নিজকে দৃঢ় প্রত্যয়ের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, ইফতারের সময় অতিভোজন না করা, চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন উপভোগ থেকে বিরত থাকা, অধিক সময় রাত্রি জাগরণ না করা, অধিক পরিমানে নিজ অত্মীয়-স্বজনের বাড়ী ও অভাবীদের দান করা, নিকটত্মীয়দের বাড়ীতে বেড়াতে যাওয়া, শত্রুতা পোষণকারীদের শত্রুতার মীমাংসা করা।

তিলাওয়াত করা, কুরআন শ্রবণ করা, কুরআনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সচেষ্ট হওয়া এবং তার উপর আমল করা। মসজিদে গিয়ে ওয়ায-নসীহত শ্রবণ করা, রমযানের শেষ দশ দিন (পারতপক্ষে) মসজিদে গিয়ে ই’তিকাফ করা। মোটকথা, রোযার সংরক্ষণ করাই করণীয় কর্তব্য।

রোযার প্রতিফল

রোযা রাখার ফলে কয়েকটি সৎ গুণ অর্জিত হয়। যথা- (ক) যে সকল বিষয়ে আল্লাহ্ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, সে সকল বিষয় থেকে মনকে বিরত রাখার শক্তি অর্জিত হবে। (খ) আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল বিষয়ে আদেশ করেছেন, সে সকল বিষয় পালনের ক্ষমতা অর্জিত হবে। (গ) বিপদাপদ ও কষ্টের সময় ধৈর্য্য ধারণের গুণ অর্জিত হবে।

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ্ তাআলা রমযানের রোযাকে ফরয করেছেন। আর আমি রমযানের রাত্রি জাগরণকে (তারাবিহ্ ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য আল্লাহর হুকুম) তোমাদের জন্য সুন্নাত করেছি (যা পালন করা আবশ্যক)। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখে এবং রাত্রি জাগরণ করে, সে ব্যক্তি ঐ দিনের ন্যায় পাপ মুক্ত হয়ে যাবে, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল”। তিনি আরো ইরশাদ করেন, “রোযা এবং কুরআন মজিদ উভয় বান্দার সুপারিশকারী”। তিনি অন্য হাদীসে উল্লেখ করেন, “সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেস্তা রোযাদার ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন”।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পালন করার সাথে সাথে শাওয়ালের আরো ছয়টি রোযা আদায় করে, সে যেন পুরো বৎসরই সিয়াম (রোযা) পালন করল। [সমাপ্ত]

– আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন, প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ ডটকম, সিইও- এম.জেড. ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পুরানা পল্টন, ঢাকা।

আরও পড়তে পারেন-

যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে গেছেন

ভাইরাস ও ভ্যাকসিন ব্যবসা: এখনি সোচ্চার হওয়ার সময়

গুনাহর ক্ষতি এবং বেঁচে থাকার উপায়

ঢাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ বিষণ্ণতায় ভূগছে, সমাধান কী?

মহানবী (সা.)এর মহিয়সী সহধর্মীনীগণ