Home ইতিহাস ও জীবনী আধ্যাত্মিক জগতের মুকুটহীন দুই সম্রাট হাকীমুল উম্মত থানভী ও শায়খুল ইসলাম মাদানী...

আধ্যাত্মিক জগতের মুকুটহীন দুই সম্রাট হাকীমুল উম্মত থানভী ও শায়খুল ইসলাম মাদানী (রাহ.)

।। মুজাহিদে মিল্লাত শামসুদ্দীন কাসেমী (রাহ.) ।।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছলে-বলে কৌশলে যখন ভারত উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা গ্রাস করে নিয়েছিল, তখন ইমামুল হিন্দ হযরত মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ’র সুযোগ্য উত্তরসূরী হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রাহ.) ভারতবর্ষকে “দারুল হরব” (বিধর্মী শাসিত) দেশ বলে ফতোয়া প্রদান করেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ফরজ বলে ঘোষণা দেন। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষিত বলে আলেম সম্প্রদায়কে বুঝানো হতো। কেননা ঐ সময়ে অন্য ধরনের কোন শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলবীর (রাহ.) ফতায়োর প্রেক্ষিতে আলেম সম্প্রদায়ই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে সারা ভারতবর্ষে জেহাদের স্পিরিট ছড়িয়ে দেন। অতঃপর উলামাদের এ নিরলস সংগ্রামের ফলে দেশটি যেন একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। এবং দিল্লীর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এর নেতৃত্বে ১৮৫৭ সনে সিপাহী জনতাসহ সমগ্র দেশবাসী জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এ জেহাদের প্রায় ক্ষেত্রেই উলামায়ে কেরাম নেতৃত্ব দান করেন। সেমতে ভারতের উত্তর প্রদেশের আমীর মনানেীত হন হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.)। তখন হতেই যাদেরকে উলামায়ে হক্কানী বলা হয় তাদের মাঝে দুটি ধারা চলছিল। একটি ধারার লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মাঝে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার, প্রসার, বিদআত-কুসংস্কার দূর করে সুন্নতের অনুসারী হিসেবে মুসলমানদের গড়ে তোলা। তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিকতার নামে যেসব বিদআত শিরিকের প্রচলন ছিল তা মিটিয়ে সত্যিকার অর্থে কোরআন সুন্নাহ মুতাবিক আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন করার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী শাসকদের থেকে দেশ মুক্ত করে ইসলামের অনুশাসন কায়েম করা।

উলামাদের অপর ধারাটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের জেহাদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থেকে মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার, প্রসার, বিদআত-কুসংস্কারকে মিটিয়ে সত্যিকারের সুন্নতের অনুসারী হিসেবে মুসলিম সমাজকে গড়ে তালো এবং সুন্নত মুতাবিক তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের বিকাশ সাধন করা। এবং দাওয়াত ও তাবলীগ, ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে ইসলামের সেবা করা।

প্রথমাক্তে ধারাটির নেতৃত্ব প্রদান করেন আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) তার সঙ্গে যারা এ জিহাদে ওতপ্রাতভাবে জড়িত ছিলেন তাঁদের মধ্যে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.), ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.) ও হযরত মাওলানা হাফেজ জামেন শহীদ (রাহ.)এর নাম বিশেষভাবে উল্লোগযাগ্যে।

অপর ধারাটি পরিচালিত হয় হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.)এর পীর ভাই হযরত  মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ থানাভেী (রাহ.)এর নেতৃত্বে। তিনি সে যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে একজন অন্যতম আলেমে দ্বীন এবং বিশিষ্ট বুজুর্গ ছিলেন। জেহাদ সম্পর্কে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন বলে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) তার সাথে মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.) ও ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.)কে সঙ্গে নিয়ে থানাভবন তার বাস ভবনে যান।

হযরত মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ থানভী (রাহ.)এর সামনে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.) ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ ফরজ হওয়া সম্পর্কে অকাট্য দলীল প্রমাণ পেশ করেন। এ সমুদয় দলীল প্রমাণ শুনে হযরত মুফতি মোহাম্মদ থানভী (রাহ.) বলেন, জেহাদের জন্য যেসব যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজন সেগুলিতো আমাদের কিছুই নেই। কি করে আমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। উত্তরে হযরত নানুতুবী (রাহ.) বলেন, বদরের যুদ্ধের সময় আমাদের নিকট যে যুদ্ধাস্ত্র ছিল বর্তমানে তার চাইতে অনেকগুণ বেশী আছে। অতঃপর হযরত  মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ থানাভেী (রাহ.) বলেন, জেহাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে এখন আমি আর ভিন্নমত পোষণ করছি না, তবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সাহস আমার হচ্ছে না। অতঃপর  হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) বলেন, আপনি জেহাদে অংশগ্রহণ করুন বা না করুন তাতে আমাদের কিছু বলার নেই, তবে জেহাদ ফরজ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের সাথে যে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। প্রতি উত্তরে হযরত মুফতি মোহাম্মদ থানাভেী  (রাহ.) বলেন, আমি যদিও সক্রীয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সাহস পাচ্ছি না, তবুও আমি সর্বদা জেহাদে আপনাদের সফলতার জন্য দোয়া করব। সে সময় হতেই আমাদের অতীতের বুজুর্গদের  মধ্যে এমনি দুটি ধারা চলে আসছে।

এ দু’ধারার বুজুর্গদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সুসম্পর্ক, ভালবাসা কোনটাই কম ছিল না।  পরবর্তিতে ১৮৬৭ সনে যখন দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে যদিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদ করাও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, তথাপি এই মাদ্রাসার পরিচর্যা, পরিচালনা এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে উভয় ধারার বুজুর্গানে দ্বীন এক সাথেই কাজ করেছেন। এ জন্যই বলা হয় দেওবন্দীদের মাঝে উভয় ধারাই চলে আসছে। উভয় ধারার বুজুর্গগণ পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবাধে ও সৌহার্দপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন।

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সর্বাগ্রে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.)এর নাম এজন্য উল্লেখ করা হয়, যে মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারার ধারক বাহক ছিলেন তিনিই। পরবর্তিতে তাঁর পীরভাই ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.) এই চিন্তাধারা ও উদ্দেশ্যের ধারক ও বাহক ছিলেন। উল্লেখ্য তারা দু’জনেই শতাব্দির অন্যতম আলেমেদ্বীন সংস্কারক ও দারুল দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের ধারক ও বাহক এবং বুজুর্গ ছিলেন। এ উভয় মনীষীই অতি যতেœ তাদের চিন্তাধারার মানসপুত্র এবং উত্তর পুরুষ  হিসেবে উপ-মহাদেশের আজাদী আন্দোলনের মুকুট বিহীন সম্রাট শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীকে (রাহ.) গড়ে তুলেছেন।

উপ-মহাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.)এর ন্যায় এমন একজন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, বহু গুণসম্পন্ন আলেমেদ্বীন আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। কেননা ইসলামের ইতিহাসে একই উস্তাদের তত্ত্বাবধানে এত অধীক সংখ্যক ক্ষণজন্মা আলেমে দ্বীন তৈরী হওয়ার নজীর খুবই বিরল। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান যাদের সংস্পর্শে গড়ে উঠেছিলেন, তাঁদের অন্তরে জেহাদের যে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত ছিল তিনি তা সম্পূর্ণরূপে আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক কথায়, হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.) ও ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.)এর তিনিই সুযোগ্য স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.) অতি স্বযতেœ আজাদী আন্দোলনের বীর সেনানী শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.), সিংহপুরুষ হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী (রাহ.), অগ্নিপুরুষ হযরত মাওলানা মুফতি কেফায়েতুল্লাহ (রাহ.), আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ.), আল্লামা শিব্বীর আহমদ উসমানী (রাহ.), মাওলানা সায়ীদ আহমদ সন্দীপী (রাহ.), মাওলানা মোহাম্মদ মিয়া আনসারী (রাহ.), মাওলানা উজায়ের গুল (রাহ.) প্রমুখ অসংখ্য অকুতোভয় বীর মুজাহিদ ও শতাব্দীর অন্যতম অনেক আলেমে দ্বীন তৈরী করেছেন।

আরও পড়তে পারেন-

যেমনিভাবে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রাহ.) ও হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.) অতি সযতেœ শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রাহ.)কে তাদের ইলম ও জেহাদী প্রেরণার উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান অসংখ্য আলেম তৈরীর সঙ্গে সঙ্গে শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) কেও তাঁর ইলম ও আজাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানের জন্য স্থলাভিষিক্ত হিসাবে গড়ে তোলেন।

উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) যে সূত্রে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন, সেই সূত্র ধরেই হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.) ও ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.) এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করে তুলেছেন। পরবর্তিতে তাদেরই স্থলাভিষিক্ত শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.) ‘রেশমী রূমাল’ আন্দোলন নামে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচী প্রনয়ণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন । বিপ্লবের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছিল  ঠিক সেই মুহুর্তে কাবুলের শাসক আমীর আমানুল্লাহের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে হযরত শায়খুল হিন্দ (রাহ.) তাঁর সঙ্গী সাথীসহ মক্কায় গ্রেফতার হন এবং এই গ্রেফতারের ফলে বিপ্লব সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.) তার সহযোগী শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.), মাওলানা উজায়ের গুল (রাহ.), মাওলানা সাইয়্যেদ ওয়াহিদুজ্জামান (রাহ.), হাকিম নাসীর উদ্দীন (রাহ.) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গসহ ইউরোপের মাল্টা দ্বীপের কারাগারে সাড়ে তিন বছর বন্দী জীবন কাটান।

শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.) মাল্টা হতে মুক্ত হয়ে যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন ভারতীয় রাজনীতি স্বশস্ত্র বিপ্লবের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে রূপ নেয়। শায়খুল হিন্দ (রাহ.) নিজেই খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন এবং তার শিষ্য ও ভক্তদেরকেও খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসে যোগদানের নির্দেশ দেন। শায়খুল হিন্দ (রাহ.) মাল্টা জেলে থাকা অবস্থায় “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” অস্তিত্ব লাভ করে এবং তিনি দেশে আসার পর তাঁরই নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আন্দোলন তীব্রতর হয়। শায়খুল হিন্দ (রাহ.)এর অনুসরণে শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.), মাওলানা মুফতি কেফায়েতুল্লাহ (রাহ.), মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রাহ.) প্রমুখ উলামায়ে কেরাম খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সচেষ্ট হন।

আমাদের এই দীর্ঘ বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হচ্ছে, শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর কংগ্রেসে যোগদান এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্লাটফরম থেকে উপ-মহাদেশের আজাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান সেই সূত্রে গ্রোথিত যে সূত্রে হযরত মাওলানা হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রাহ.) মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.) ও শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহ.) স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করেছেন।

হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দীদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) দারুল উলুম দেওবন্দের একজন কৃতি সন্তান। তাঁর অধিকাংশ উস্তাদই হচ্ছেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর উস্তাদ। এ দু’জনের মাঝে ব্যবধান শুধু এতটুকুই যে, হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) হযরত মাওলানা সইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) এর কয়েক বছর পূর্বেই শিক্ষা সমাপন করেন। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) দেওবন্দী উলামাদের পূর্বোক্ত দ্বিতীয় ধারারই অনুসারী ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতির সাথে তার সম্পর্ক ছিল না। তিনি তালীম তরবীয়ত, ওয়াজ, দাওয়াত, তাবলীগ ও লেখনীর মাধ্যমে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মুসলিম সমাজকে সংস্কারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। উপরন্তু তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিকতা শিরিক, বিদআত আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। তা থেকে আধ্যাত্মিকতাকে মুক্ত করে স্বচ্ছ ও সঠিক, কোরআন সুন্নাহ মোতাবিক যুগান্তকারী সংস্কার সাধন করেন। এ কারণেই তাকে “মুজাদ্দীদে মিল্লাত” ও “হাকীমুল উম্মত” নামে আখ্যায়িত করা হয়। আধ্যাত্মিকতা ও মুসলিম সমাজ সংস্কারে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা উপ-মহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসে শতাব্দির পর শতাব্দি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

রাজনীতির ক্ষেত্রে এ মহামনীষীর কোন আকর্ষণ ছিল না। তবে তিনি মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের পক্ষপাতি ছিলেন। তার মুরীদ, শাগরিদ ও ভক্তবৃন্দের বেশীর ভাগই পাকিস্তান আন্দোলনের স্বপক্ষে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এ সমুদয় কারণে কেউ যদি তাকে পাকিস্তান আন্দোলনের স্বপক্ষীয় হিসেবে চিহ্নিত করতে চায় তবে তা একেবারে অযৌক্তিকও বলা যাবে না। হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দীদে মিল্লাত, হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) ও শায়খুল ইসলাম, হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর মাঝে এই একটি সাময়িক বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অন্যথায় জীবনের আর কোথাও এ উভয় মনীষীর মাঝে কোন বৈসাদৃশ্য ছিল না। বরং পরস্পর পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব, সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্ক বিরাজমান ছিল।

হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) এর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদানের জন্য হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রাহ.) ফকীহে উম্মত হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.)এর নিকট সোপর্দ করেন। অপরপক্ষে শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) কুতবে আলম হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী (রাহ.)এর নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। বয়াতের পরপরই তিনি মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তখন হযরত গংগুহী (রাহ.) হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর নিকট তাঁকে সোপর্দ করেন। এ দুই মনীষীর বায়াত ও দীক্ষা গ্রহণের মাঝে এই যে অভূতপূর্ব সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তা একটি নজীর বিহীন ঘটনা।

উল্লিখিত বুজুর্গদ্বয়ের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্ব, আস্থা ও সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্কের অসংখ্য নিদর্শনের মাঝে একটি স্মরণীয় ঘটনাঃ

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রশাসনের সাথে মতানৈক্যের কারণে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ.) দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীনের পদ থেকে যখন পদত্যাগ করলেন তখন দারুল উলুমের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.)। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ.)এর পদত্যাগ পত্র গৃহীত হওয়ার পর অনেকেই উক্ত পদের জন্য দরখাস্ত করেন। দরখাস্তকারীদের মধ্যে কেউ কেউ হযরত থানভী (রাহ.) এর মুরীদও ছিলেন। হযরত থানাভেী (রাহ.) তাঁদের কারো দরখাস্তের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন, শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) সিলেটে অবস্থান করছেন, আমার পক্ষ হতে তাঁর নিকট চিঠি লিখে জানান-তিনিই শায়খুল হিন্দ (রাহ.)এর স্থলাভিষিক্ত। আজ দেওবন্দের শায়খুল হিন্দ (রাহ.)এর মসনদ শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। অনতিবিলম্বে যেন তিনি দেওবন্দে এসে শায়খুল হিন্দ (রাহ.)এর মসনদকে অলকৃত করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করা সত্ত্বেও একমাত্র হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.)এর নির্দেশেই শায়খুল ইসলাম মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) দারুল উলুম দেওবন্দের সদরে মুদাররীসের পদে অধিষ্ঠিত হন।

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্থে দেওবন্দ হতে আধ্যাত্মিক ও তরিকতের দু’টি শক্তিশালী ধারা প্রবাহিত হয়। একটি ধারার উৎসমূলে ছিলেন থানা ভবনে-হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দীদে মিল্লাত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) অপরটির উৎসমূলে ছিলেন স্বয়ং দেওবন্দে কুতুবে আলম শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)। উপমহাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে দ্বীন পিপাসু লোকেরা এ উভয় ব্যক্তিত্বের নিকট থেকে দ্বীনের পিপাসা নিবারণ করতেন এবং নিজ নিজ এলাকায় দ্বীন প্রচারে লিপ্ত হতেন।

হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানাভেী (রাহ.) ও শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল বটে কিন্তু পরস্পর পরস্পরের প্রতি অত্যাধিক শ্রদ্ধাশীল ও সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তাদের রাজনৈতিক পার্থক্য কোন দিনও ব্যক্তিগত মতপার্থক্যের পর্যায়ে পৌঁছেনি।

এ প্রসঙ্গে হযরত মাদানী (রাহ.) এর একটি পত্র যা তিনি থানাভবনে মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদীর নিকট লিখেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। উক্ত পত্রে তিনি হযরত থানভী (রাহ.) সম্পর্কে “হযরত মাওলানা দামাত বারাকাতুহুম” এর ন্যায় সম্মানজনক বাক্য ব্যবহার করেছেন। নিয়ম মোতাবিক এ পত্রের উত্তর মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদীর লেখার কথা ছিল। কিন্তু হযরত থানভী (রাহ.) তাকে এ পত্রের উত্তর লিখতে না দিয়ে নিজেই মাদানী (রাহ.)এর নিকট চিঠি লিখেছিলেন। উভয় পত্র পাঠ করলে অনুভব করা যায় যে, উভয় মনীষীর মধ্যে একটি সুসম্পর্কের ভাব বজায় ছিল এবং পরস্পর পরস্পরের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী ও মাওলানা আবদুল বারী নদভী বায়াত লাভের উদ্দেশ্যে হযরত মাদানী (রাহ.)এর খেদমতে দেওবন্দে উপস্থিত হন। তাদেরকে বায়াত না করে বরং উভয়কে নিয়ে থানাভবনে হযরত থানভী (রাহ.)এর খেদমতে উপস্থিত হন এবং এদেরকে বায়াত করার জন্য অনুরোধ করেন। হযরত থানভী (রাহ.) এই বলে বায়াত করতে অস্বীকার করলেন যে, এরা তো আপনার নিকট বয়াতের জন্য আগ্রহী। আমি এদেরকে বায়াত করলে এরা লাভবান হতে পারবে না বরং আপনিই এদেরকে বায়াত করে নিন। পরস্পরের মত বিনিময় এবং পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, হযরত মাদানী (রাহ.) এদেরকে বায়াত করবেন এবং হযরত থানভী (রাহ.) তা’লীম ও ছবক দান করবেন। এ ঘটনাই প্রমাণ করে যে এ দুই মনীষীর মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সৌহার্দপূর্ণ সুসম্পর্ক বিরাজমান ছিল। সাদৃশ্যের এমন অনুপম দৃষ্টান্ত আর কেউ দেখাতে পারবে কিনা আমাদের জানা নেই।

(মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী রচিত “নূকূশ ও তাআসসুরাত” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, যারা থানভী ও মাদানী সিলসিলার নামে বিভেদ রেখা সৃষ্টির প্রয়াস চালায় তাদেরকে আসলে দেওবন্দী মতাদর্শ তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মধ্যমপন্থার অনুসারী বলে মেনে নেয়া যায় না।

– মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী (রাহ.), বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের অকুতোভয় সাহসী সৈনিক, খতমে নবুওত আন্দোলন পরিষদ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি, মাসিক পয়গামে হক্ক ও সাপ্তাহিক জমিয়তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং জামেয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ-ঢাকা-এর পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।