Home পরিবার ও সমাজ আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা

আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা

মুনির আহমদ। ছবি- উম্মাহ।

।। মুনির আহমদ ।।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ সৃষ্টি জগতে একমাত্র মানুষই জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুক্বাত। মানবিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন কল্পে সমাজ বেঁধে বসবাস করা তার জন্য অপরিহার্য। কেননা, মানুষ সামাজিক জীব হেতু সে কখনো একাকী থাকতে পারে না, একাকী থাকাকে ভালবাসে না, একাকী থাকাকে পছন্দ করে না এবং একাকী থাকায় শান্তিও পায় না।

ইসলাম বলে- হে মানুষ! পৃথিবীতে তুমি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তাআলার মহান প্রতিনিধি। তাই ভেবে দেখো! তোমার মর্যাদা কত শ্রেষ্ঠ, তোমার মান কত উচ্চ। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকেন্দ্র কর্তৃক তোমার জীবন ও জীবনের উদ্দেশ্য, তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ ও গতিপথ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। সৃষ্টিকেন্দ্রের পূর্ণ আনুগত্যের বন্ধনে থেকে ব্যক্তিগত জীবন গঠনের সাথে সাথে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলাই হবে তোমার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

আর এ পথে যত বাধা-বিপত্তি, বিষকন্টক ও বিষক্রিয়া তথা উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, পর-আপন, স্বধর্মী-বিধর্মী ইত্যাদির বেড়াজাল ও মিথ্যার লৌহ দেওয়ালকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতঃ একাকার করার মাধ্যমেই ফুটে উঠবে পূর্ণ মানবতা এবং এরই অভিব্যক্তি ও উৎকর্ষ সাধনের নামই আদর্শ সমাজ গঠন বা মানবতার বিকাশ।

আর এরই সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে এও সম্যক উপলব্ধি করতে হবে যে, সুমহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন যে উদ্দেশ্যে, সে উদ্দেশ্য সাধনে সচেষ্ট হওয়ার নামই মানব প্রেম বা মানবতার সাধনা। পক্ষান্তরে সে তার মানবিক সাধনার উদ্দেশ্য হতে দূরে সরে লক্ষ্য বিচ্যুত, লক্ষ্য বিস্মৃত মানুষ নিজেকে মানুষ বলে বাহ্যিক যতই পরিচয় দান করুক এবং যত আস্ফালনই করুক না কেন, সে রক্ত-মাংসের মানুষ হলেও তার এ মানুষরূপী কাঠামো বাস্তবতঃ মনুষত্ব ও মানবতার গণনার বাইরে বরং মানবতার জীবনীশক্তি হতে বঞ্চিত। কেননা, লিখার জন্য কলম, সময় নিরূপণের জন্য ঘড়ি, আলো প্রাপ্তির জন্য হ্যারিকেন বা বিজলী বাতি এবং দূর চলাচলের জন্য যানবাহন। এগুলি তৈরীর উদ্দেশ্য কি এসবের মাহাত্ম্য নয়?

তাই একথা বলা অত্যাবশ্যক যে, কলম যদি লিখার অযোগ্য, ঘড়ি যদি সময় নিরূপণের অযোগ্য, হ্যারিকেন বা বিজলী বাতি যদি আলো দিবার ক্ষেত্রে অযোগ্য এবং ট্যাক্সি-টেম্পো ইত্যাদি যানবাহনও অনুরূপ যদি অকেজো হয়ে পড়ে, তাহলে এগুলোকে কি তাদের মর্যাদা দেওয়া যায়? এর জবাবে এক কথাই বলা যেতে পারে যে, দৃশ্যতঃ এসবের বাহ্যিক কাঠামো যত সুন্দরই হোক না কেন, এসব অচল জিনিস-পত্রকে এদের মূল নামে অভিহিত করা যায় না। বেশীর চাইতে বেশী এতটুকু বলা যেতে পারে যে, বেকার কলম, অচল ঘড়ি, ভাংগা হ্যারিকেন বা ফিউজড বাল্ব এবং নষ্ট ট্যাক্সি-টেম্পো ইত্যাদি। অনুরূপ মানুষ যদি মানবিক মর্যাদা গুণে ভূষিত না থাকে, তখন সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকেও মানুষের কাতারে স্থান দেয়া যায় না। যে কারণে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনের ভাষায় এরূপ বাহ্যিক খোলস পরিহিত মানুষ সম্পর্কে বলেছেন- “এরা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং এর চাইতেও নিকৃষ্ট।”

এর সঠিক কারণ যাচাই করলে আমরা বুঝি, যেমন পানির ধর্ম শীতলতা ও নিম্নগামিতা এবং আগুনের ধর্ম তাপ ও ঊর্ধ্বমুখিতা। ঠিক তেমনি জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন সৃষ্ট মানুষের ফিতরাত বা স্বভাবধর্ম হওয়া চাই মানব সমাজে মানবতার উৎকর্ষ সাধন এবং মহান স্রষ্টা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর বাস্তব পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন।

এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা মহাগ্রন্থ কুরআনে একান্ত জোরালোভাবে ইরশাদ করেছেন- “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত (সম্প্রদায়), তোমাদেরকে মানব জাতির কল্যাণের জন্যই উদ্ভব ঘটানো (সমুত্থিত করা) হয়েছে। তোমাদের প্রধান কাজ হলো (মানব জাতির আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক সংশোধনের চেষ্টায়) তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাঁধা দিবে এবং আল্লাহর প্রতি (পরিপূর্ণভাবে) ঈমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান)।

এর অন্তর্নিহিত তথ্য এই যে, পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের তুলনায় মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের (জ্ঞানী-গুণী আলেম-উলামাদের) মাধ্যমে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব অধিকতর পূর্ণত্ব লাভ করেছে। কেননা, মুসলিম সম্প্রদায় বর্ণিত নিয়ম-পদ্ধতিতে এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে মানুষকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা-নিষেধ প্রদানের মাধ্যমে আদর্শ সমাজ গড়েছিলেন। আদর্শ সমাজ গঠনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ-

(১) তোমাদের মধ্যকার যে কেউ কোন আপত্তিকর (গুনাহ্’র কাজ) তথা আল্লাহ্ ও রাসূলের অপ্রিয়-নিষিদ্ধ কোন কিছু সমাজের কোথাও হচ্ছে দেখে, তবে (স্থলবিশেষে) সে যেন বাহুবলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়, যদি বাহুবলে না পারে, তবে কথা দ্বারা প্রতিবাদ করবে, অগত্যা যদি তাও না পারে, তবে (এধরনের পাপাচারকে) অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এটাই ঈমানের দুর্বলতার সর্বশেষ স্তর। (সহীহ্ মুসলিম শরীফ)।

আমরা সামাজিক জীব-মানুষ হিসেবে আমাদের চোখের সামনেই ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে এ পৃথিবীর বুকে। অনুরূপ সুস্থতা-অসুস্থতা, রোগ-ব্যাধিও চলে আসছে পরস্পর পাশাপাশি। তাই রোগ ও ব্যাধির আক্রমণ থেকে আÍরক্ষার এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেমন সতর্ক থাকতে হবে সকল স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থতা প্রত্যাশীকে; তেমনি রোগের প্রভাব-প্রসার ও জন্ম-উৎপত্তি এবং পরিবেশ দূষণ সম্পর্কেও সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে একমাত্র এতেই দেহগত সুস্থ সমাজ গড়ে উঠতে পারে, অন্যথায় চলমান সুস্থ সমাজও একদিন না একদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যে সর্বস্বান্ত হবে, এতে সন্দেহ নেই।

এ কারণেই দুষ্কর্ম করা যেমন পাপ, অন্যায়-অত্যাচার এবং দুষ্কর্ম দেখেও এর প্রতিকার না করা, বরং নিরীহ ভাল মানুষ সেজে নির্বিকার থাকাও পাপ, অন্যায়-অপরাধ। সমাজ সংস্কারের অভাবে শুধু পাপাচারীই পাপী নয়, বরং এর নিষ্ক্রিয় দর্শককেও এর প্রতিক্রিয়া এবং শোচনীয় পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর কারণ, পাপী পাপাচারের অপরাধে এবং নীরব দর্শক প্রতিকার-প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা ও কর্তব্য-দায়িত্বহীনতার অপরাধে অপরাধী এবং দণ্ডিত হবে। কেননা, সুস্থ সমাজ গড়ার পথে আমি অন্যায় করিনি, অমুকে অন্যায় করেছে, তার দোষ, সে-ই শাস্তি ভোগ করবে। পক্ষান্তরে আমি পাপাচারের দর্শক মাত্র, আমিতো পাপ করিনি, আমি কেন শাস্তি ভোগ করবো, এমন কথা ও এরূপ কৈফিয়ৎ ইসলামী সমাজ সংস্কার আইনে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।

যেমন কোন এক লোক রাজপথে প্রস্রাব-পায়খানা করে গেলে পর এর দুর্গন্ধ অপরাপর পথচারীর নাকে লাগবেই, তাদের চোখে মুখে এর প্রতিক্রিয়া এবং বিরক্তি দেখা দিবেই। কেননা, মানুষ মাত্রেরই দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, অনুভূতিশক্তি এবং ভাল-মন্দের ফলাফল ও তারতম্য-বোধশক্তি অবশ্যই থাকে। যে কারণে এই দোষ কর্মের উপর সকলেই মর্মাহত ও অনুতপ্ত হন। ঐক্ষেত্রেও কেউ এরূপ বলবে না যে, অমুকে এই দোষণীয় কাজ করেছে এর দুর্গন্ধ আমার নাকে লাগছে কেন?

বস্তুতঃ এরূপ অপকর্মের প্রতিবাদ-প্রতিকারের সূচনাতেই তৎপর না হলে শেষ পর্যন্ত পথচলাই দুঃসহ হয়ে পড়বে। তাই সম্মিলিতভাবে সকলকেই এর দায়ভার বহন করতে হবে, এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। অতএব ইসলামী আদর্শ সমাজ গড়ার তাকীদে- সমাজ স্বাস্থ্য, সমাজ সংস্কার এবং সুস্থ সামাজিক পরিবেশ গঠনের সার্বিক গুরুত্বের প্রেক্ষিতেই সর্বপ্রকার অন্যায়-অনাচারের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সদা-সতর্ক, সদা-তৎপর থাকতে এবং যথাশক্তি প্রয়োগ করতঃ উন্নত সমাজ গড়ার প্রয়াসে প্রতিটি সমাজ সভ্যকে ইসলাম কঠোর নির্দেশ দিয়েছে।

(২) মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “সমাজে অন্যায় ও অপকর্মকারী এবং এর নীরব দর্শকের অবস্থা ঐ নৌযানের যাত্রীদের মত, যার নিচতলার যাত্রীরা উপর তলা থেকে পানি আনতে গেলে পানির ছিটা পড়ে উপর তলার যাত্রীদের কষ্ট হয়, হেতু তারা বিরক্তিবোধ করে। তাই নীচ তলার যাত্রীরা উপর তালায় না গিয়ে নৌযানের নীচ তলায়ই ছিদ্র করে পানির ব্যবস্থা করতে যায়। তখন উপর তলার যাত্রীরা এই বলে নীরব হয়ে বসে থাকে যে, তাদের কাজ তারা করুক, আমরাতো ছিদ্র করিনি! তবে এর পরিণতি কি হবে? অঝোারে পানি ঢুকে গোটা নৌকা যখন ডুবে যাবে, তখন উপর তলার যাত্রীরা যদি এই বলে যে, আমরাতো ছিদ্র করিনি, আমরা কেন মরব? তখন কি কেবল নীচ তলার লোকেরাই মরবে, না সকলের অবস্থা একই হবে? কাজেই দোষণীয় কাজের হোতা এবং দর্শকদের পরিণতি একই সমান।” (সহিহ বুখারী)।

(৩) মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “একদা আল্লাহ্ তাআলা পাপের দরুণ একটি বস্তি এবং জনপদকে এর অধিবাসীসহ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য জনৈক ফেরেশ্তাকে হুকুম দেন। তখন ঐ ফেরেশতা বললেন, ওগো আল্লাহ্! ওখানেতো তোমার অমুক এক নেককার বান্দা রয়েছে, এতে যে সেও মারা যাবে। তদুত্তরে আল্লাহ্ বলেন- সেতো কখনো মুহূর্তের জন্যও এ সমস্ত পাপাচারের (অপকর্মের) প্রতি বিরক্তিও প্রকাশ করেনি।” (মিশকাত শরীফ)।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ঐ বস্তির জনগণ তাদের কৃত গুনাহ্’র দরুণ পাপী আর ঐ ব্যক্তি (দরবেশ) তার দায়িত্ব ছিল এদেরকে পাপ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে সাধ্যমত বাধা-নিষেধ প্রদান করা। কিন্তু সে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করায় অথবা কোনরূপ বাধা-নিষেধ না করায় স্বীয় কর্তব্যে অবহেলার অপরাধে অপরাধী। তাই সকলেই সমানভাবে আল্লাহর আযাবে দণ্ডনীয় হবে।

(৪) মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “সমাজের মানুষ যখন প্রকাশ্যে যুলুম করতে দেখেও বাধা-নিষেধ প্রদানের মাধ্যমে যালিমের হাত ধরে না, তখন (পাপী ও নীরব দর্শক) সবারই উপর ব্যাপকভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব-গযবের সম্ভাবনা স্থিরীকৃত হয়ে যায়; এমতাবস্থায় তাদের দোয়া প্রার্থনা কবুল হয় না।” (তিরমিযী শরীফ)।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, সামাজিকভাবে পাপীদের পাপ এবং অন্যদের তাতে বাধা-নিষেধ না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের দরুণ আল্লাহর দরবারে আবেদন-নিবেদনের পথই যদি বন্ধ হয়ে যায়, আর সবাই গযবে পতিত হয়, তখন এর চাইতে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে?

পরন্তু সমাজ সংস্কারে এ মহান কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের তিনটি স্তরও রয়েছে। আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যায় ক্ষেত্র-পাত্র এবং শক্তি-সামর্থ হিসেবেই স্তরসমূহ নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন, বাহুবল তথা ক্ষমতাবলে পাপাচারীকে সরাসরি বাধা প্রদান করবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ (শাসকবৃন্দ)। মৌখিক বাধা প্রদান করবে সমাজের শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামা ও জ্ঞানী-গুণীব্যক্তিবর্গ। আর অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করবে দুর্বল-নিরীহ জনগণ। বিশেষতঃ বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাধাপ্রদান-প্রতিকারের অধিকার সর্ব-সাধারণের নেই, এটা একমাত্র শাসক সম্প্রদায়ের সঠিক বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উপরই বর্তায়। আর মৌখিক বাধা-নিষেধের ক্ষেত্রেও হুজুগী সত্যভাষণ এবং সত্যপ্রচারের নামে কারো গোপনীয় দোষত্রুটি জনসমক্ষে প্রকাশ করে বা ধরিয়ে দিয়ে প্রতিকারের নামে তাকে অপদস্থ করাও অপরাধ।

তবে সমাজের কোথাও এরূপ পাপকর্ম পরিলক্ষিত হলে প্রথমে ঐ দোষী ব্যক্তিকে মানবতা সূলভ ব্যবহারের মাধ্যমে একান্ত চুপি চুপি বলুন ও বোঝান। এতেও যদি সংশোধন না হয় এবং এর দ্বারা সমাজে পাপ কর্মের বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখনি এর প্রতিরোধ-প্রতিবিধানে সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন। অতঃপর একান্ত নিরীহ -দুর্বল জনের তো পাপকর্মকে স্বীয় অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করা ছাড়া উপায়ই নেই।

আরও পড়তে পারেন-

(৫) মহানবী (সা.) বলেছেন- “খোদায়ী গযবের মাধ্যমে বনী ইসরাঈলের মধ্যে তখনি সর্বনাশের সূচনা হয়, যখন তাদের মধ্যকার প্রজ্ঞাবান আলেম-উলামারা তাদের সমাজের লোকদেরকে তাদের অপকর্মের বারণ করেও নিজেরাই আবার তাদের সঙ্গে মেলামেশা করত এবং তাদের পাপাচার চলতে থাকা সত্ত্বেও তারা (বাহ্যিক উদারতার ভান করে) তাদের সঙ্গে অবাধে-অসংকোচে খানা-পিনা, উঠা-বসা করতো। আলেম-উলামাদের এরূপ আচরণের ফলে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরকে নিস্তেজ ও পঙ্গু করে দেন এবং হযরত দাঊদ (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) প্রমুখের যবানে তাদের প্রতি লা’নত ও অভিসম্পাত বর্ষণ করতে থাকেন।” (আবুদাঊদ ও তারগীব)।

(৬) মহানবী (সা.) বলেছেন- “সমাজে অন্যায়-অত্যাচার হচ্ছে দেখেও যদি মানুষজন তা বন্ধে পদক্ষেপ না নেয়, তবে (এর দোষে) গোটা সমাজই আল্লাহর গযবে পতিত হবে।” (নাসাঈ শরীফ)।

(৭) মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “আমার উম্মতকে যখন যালিমকে যালিম বলতে ভয় পেতে দেখবে, তখন তারা আমার উম্মত (-এর গণ্ডি) থেকে বিদায় নিল বলে মনে রাখবে।” (হাকিম ও তারগীব)।

(৮) হযরত আবু যার গিফারী (রাযি.) বলেছেন, মহানবী (সা.) আমাকে উপদেশ দিয়েছেন- (সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা কল্পে) আল্লাহর পথে আমি যেন কারো তিরস্কার এবং ভর্ৎসনার ভয় না করি এবং সত্য কথা অপ্রিয় হলেও যেন নির্দ্বিধায় বলতে থাকি। (আবুদাঊদ শরীফ)।

(৯) সমাজ সংস্কারের প্রথম ধাপে মানুষকে তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনের সংস্কার সাধন করতে হবে সর্বাগ্রে। তাই এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- “জেনে রাখো! তোমার উপর তোমার দেহেরও হক বা দাবী রয়েছে এবং তোমার স্ত্রীর দাবীও তোমার উপর রয়েছে।” (বুখারী শরীফ)।

এ হাদীস থেকে বোঝা গেল যে, ইসলাম শুধু ত্যাগের ধর্মই নয়, পরিমিত ভোগের অবকাশও তাতে রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ইসলাম বলে মানুষের সামাজিক জীবনে শুধু ত্যাগ কিংবা শুধু ভোগ কোনটাই সুস্থ মানবতার আদর্শ হতে পারে না। এরই আলোকে কেবল খোদা প্রেম ও খোদা ভক্তিতেই মানবতার বিকাশ সাধিত হয় না; বরং একজন মানুষের জন্য সৎ ও সাধুতার মাধ্যমে খোদা প্রেমিক হওয়ার সাথে সাথে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে সকল অবক্ষয় দর করার ভিতর দিয়ে সমাজ সংস্কারে আÍনিয়োগ না করা পর্যন্ত পূর্ণ মানবতার দিশারী বলে দাবী করা হবে তার জন্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অযৌক্তিক।

উপসংহারে বলতে হয়, পূর্ণ সমাজ সংস্কারের অভাবেই আজকের একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও সমগ্র বিশ্বব্যাপী চলছে অন্যায়-অত্যাচার এবং যুলুম ও নির্যাতনের তাণ্ডবলীলা। বিপন্ন মানবতায় নিরীহ-অসহায় ও মযলুম মানুষের গগনচুম্বী আর্তনাদে আজ বিশ্ববিবেক কম্পমান ও আতংকগ্রস্ত। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, পুঁজিবাদী প্রসারণ, রাজনৈতিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, সংস্কৃতির নামে বেহায়া ও নগ্ন-পাশবিক কর্মকাণ্ড এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার ছদ্মাবরণে আমদানী হচ্ছে সকল অসভ্যতাজনিত নোংরামী, যা এখন আমাদের সমাজ জীবনের নিত্যদিনের চিত্র। প্রকাশ্য অশ্লীলতা ও চরিত্র বিধ্বংসী যান্ত্রিক ও বস্তুতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড কামানোর ন্যায় এর বিষক্রিয়া কাজ করতে চলেছে। নিত্যনৈমিত্তিক মানুষ হত্যা, চুরি-ডাকাতি, হাইজ্যাক-রাহাজানী এমনকি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ ও নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে চারদিকে কেবলি মানুষের হাহাকার।

তাই প্রকৃত মানবতার আলোক বর্তিকা নিয়ে আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তথা সমাজের সর্বস্তরে সকলে মিলে সংঘবদ্ধভাবে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। কেননা, দুনিয়াতে একমাত্র ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাই নিখুঁত-মজবুত ও বিজ্ঞান সম্মত। আর ইসলামী সমাজ সংস্কার ও সমাজ উন্নয়ন নীতি যা একদেশ অথবা এক সমাজদর্শী নয়, বরং গোটা বিশ্বভিত্তিক, সকল দেশ, সকল জাতি এবং সর্বযুগে যুগোপযোগী বিধায় মানব সমাজে পরিপূর্ণ উন্নতি অগ্রগতি, ঐক্য-সংহতি এবং অনাবিল সুখ ও শান্তির অমর বার্তা তথা আসমানী কানুন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।