Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ‘নেলসন’স আই’ এবং মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদী সঙ্কট

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ‘নেলসন’স আই’ এবং মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদী সঙ্কট

।। জামালউদ্দিন বারী ।।

ইংরেজি ‘নেলসন’স আই’ ইডিয়মটি কূটনীতি ও রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত হয়। এর মানে হচ্ছে, কোনো কিছু ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য করা বা দেখেও না দেখার ভান করা। এর পেছনে রয়েছে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় যুদ্ধের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বৃটিশ নৌবাহিনীর ভাইস এডমিরাল হোরেশিও নেলসনের জীবনে ঘটে যাওয়া ট্রাজিক ঘটনা। ১৭৯৭-৯৮ সালে ট্রাফালগার ও সেন্ট ভিনসেন্টের যুদ্ধে বিস্ফোরনে নেলসনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সেই নষ্ট চোখে সমুদ্রে টেলিস্কোপ ধরে তিনি বলেছিলেন তিনি কিছুই দেখতে পাননি। এ ভুলের কারণে শত্রু বাহিনীর হাতে তার বাহিনীকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

নেলসনের কাহিনী ইংরেজের ইতিহাস ও সাহিত্যে বিশেষ স্থান পেয়েছে। ফিলিস্তিন ও আরব-ইসরাইল সংকট এবং ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসী তৎপরতার বৃটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন ও অনুসৃত নীতিকে ‘নেলসন’স আই’ বলে অভিহিত করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের পরও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষা এবং ইরানের সাথে পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি নিয়ে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে প্রাথমিক পদক্ষেপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাননীতি এবং ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়।

গত কয়েক সপ্তাহে এটা অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে যে, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ী অভিযুক্ত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দেশে বিরোধিদের তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে মানবাধিকার হরণ ও আগ্রাসনের মাত্রা বাড়ানোর পাশাপাশি ইরানের সাথে দ্বন্দ্বকে একটা টানটান উত্তেজনার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষত উপসাগরীয় পানিসীমায় ইরানি জাহাজে চোরাগোপ্তা হামলা এবং গাজা এলাকায় সাধারণ জেলেদের উপর ইসরাইলী ড্রোন হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে ইসরাইলের অসহিষ্ণু ও আগ্রাসী মনোভাব ক্রমে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এতে বোঝা যাচ্ছে, জো বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন মার্কিন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তাদের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের আগে ইসরাইল তার কঠোর অবস্থানের জানান দিতে চায়। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারাই ক্ষমতায় থাক না কেন, তারা ইসরাইলের সাথে শর্তহীন বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষায় সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য নীতিগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির কারণেই গত ৭ দশকেও আরব ইসরাইল সংকটের সমাধান হয়নি।

আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ সমর্থন থাকা সত্তে¡ও আল আকসা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মর্যাদা পুনপ্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই কার্যকর করা যায়নি। সেই সাথে এটাও স্মর্তব্য যে, পশ্চিমা সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে ইসরাইল যত শক্তিশালী হোক না কেন, গত ৭৩ বছরেও ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে কখনো স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালে রাতের অন্ধকারে জাহাজ ভিড়িয়ে বুলডোজার ও ট্যাঙ্ক নামিয়ে পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং পাওয়া হাগানা মিলিশিয়ারা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর দখল করে যে ইসরাইলের ভিত্তি রচনা করেছিল, সাত দশক পেরিয়ে এসেও সে আগ্রাসন এখনো অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বৃটিশ ইহুদি রাজনীতিবিদ-লেখক মার্টিন অডনি ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমাদের একপাক্ষিক ও অন্ধ সমর্থনের একটি ঐতিহাসিক পটভ‚মি ও বিশ্লেষণ তুলে ধরতে গিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ‘হাই পলিটিক্স’ বা বিশ্বরাজনীতির চারিত্র এবং ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের ইউরোপ ও রাশিয়া-জার্মানি ও অটোমান সাম্রাজ্যের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ভবিষ্যতের রূপরেখা বিশ্লেষণ করেছেন। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের হুমকির আশঙ্কার মধ্যে থাকা অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে সাথে ১৮৭৮ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বৃটিশ কংগ্রেস উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি বা অ্যালায়েন্সের ঘোষণা দেয়া হয়। সে চুক্তি অনুসারে উসমানীয়া খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত সাইপ্রাসে বৃটিশ সেনাঘাটি গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া হয়।

আর সাইপ্রাসের এই সেনাঘাটি ব্যবহার করেই পরবর্তিতে সুয়েজখালকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সামরিক উদ্যোগে বৃটিশদের সামরিক কর্তৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হয়। মার্টিন অডনি তার নিবন্ধে লিখেছেন, ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৃটিশদের অর্থায়নে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথ সুয়েজখাল খননের পর লোহিত সাগর ও ভূমধ্য সাগরের বিশাল নৌরুটকে সংক্ষিপ্ত পথে রূপ দেয়ার এই যুগান্তকারী উদ্যোগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব অনেক কমিয়ে দিতে সক্ষম হলেও এ খালের উপর পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বহাল রাখতে গিয়ে দুইটি মহাযুদ্ধের ভূ-রাজনৈতিক হিসাব, ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মকে অবধারিত করে তোলাসহ পরবর্তী প্রতিটি পদক্ষেপে সাথে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ নেপথ্য ভূমিকা বিশ্বব্যবস্থায় এক জটিল মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যসহ সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ ও ম্যান্ডেটগুলোতে নয়া ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক ডিসপিউটগুলো জিইয়ে রাখা এবং সময়মত তা কাজে লাগানোর ফর্মুলা সচল রাখতেই এসব সমস্যা সম্পর্কে ‘নেলসনস আই’ নীতি গ্রহণ করে ইঙ্গ-মার্কিনীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫১ সালে ইরানে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক অ্যাংলো ইরানিয়ান তেল কোম্পানীকে জাতীয়করণ করায় সামাজিক-রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীতে গোপন গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামরিক অভ্যুত্থান মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালে একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেখানে আবারো শাহের রাজতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।

অন্যদিকে ১৯৫৬ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের সুয়েজখান নৌপথের উপর প্রায় ৮০ বছরের বৃটিশ নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে সুয়েজখাল জাতীয় করণ করার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সূত্রপাত ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেই সোভিয়েত-আমেরিকা ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে ফরাসি ও বৃটিশ বাহিনী ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সিনাই উপত্যকতা থেকে পোর্ট সাঈদ বন্দর সহ সুয়েজখাল এলাকায় সামরিক অভিযান ও দখলদারিত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল।

এ দ্বন্দ্বে মার্কিনীদের হিসেবে ছিল ভিন্ন। তারা মনে করেছিল, ইঙ্গ-ফরাসি সামরিক আগ্রাসন মিশরকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বৃটিশ ও ফরাসি সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। তবে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিনীদের নীতিগত সিদ্ধান্ত যাই হোক, তারা মধ্যপ্রাচ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে সামরিকভাবে শক্তিশালী ইসরাইলের ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বের বিষয়টি যথার্থভাবেই বুঝতে পেরেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে ইসরাইলের নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব পশ্চিমাদের কূটনৈতিক অবস্থানের মূল মানদন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধ এবং গত দুই দশক ধরে চলা ওয়ার অন টেররিজমের ভূ-রাজনৈতিক ফলাফল যাই হোক, এসব যুদ্ধের নেপথ্যে পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা এবং জায়নবাদী এজেন্ডার নীলনকশা অনেকটাই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুয়েজখাল ও নৌপথের একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব সব সময়ই লক্ষ্য করা যায়।

সুয়েজখালের উপর মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিহত করতেই ইসরাইলকে কৌশলগত শক্তি হিসেবে বহাল রাখতে গিয়েই তার সব অপকর্ম, আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য করে শর্তহীনভাবে সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যহত রেখেছে। এ ছাড়া ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিশ্বযুদ্ধসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইহুদি ও জায়নবাদের প্রভাবিত ব্যাংকার, ধনকুবের, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, থিঙ্কট্যাঙ্ক ও কর্পোরেট মিডিয়ার সমর্থন ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

ইসরাইল ও জায়নবাদী এজেন্ডা না থাকলে দুইটি মহাযুদ্ধ এত দীর্ঘ এবং বিশ্ব এত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতো না। আটবছর ধরে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, প্রথম গাল্ফ ওয়ার, মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ন্যাটো জোটের ইরাক ও আফগানিস্তান দখল, ওয়ার অন টেররিজম, আইএস’র সন্ত্রাস, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধে মানবতার বিপর্যয় সৃষ্টির মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। আরব ও ফিলিস্তিনিদের উপর আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বরাবর অভিযুক্কত ইসরাইল নেগেভ মরুভূমিতে পারমানবিক সমরাস্ত্রের বিশাল মজুদ গড়ে তুলেছে। এ নিয়ে পশ্চিমা শক্তিগুলো কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি।

ভানুনু মরদেচাই নামে ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা ইসরাইলের ভয়াবহ পারমানবিক অস্ত্র-ভান্ডার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দেয়ার পরও ইঙ্গ-মার্কিনীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশ্বসম্প্রদায়ও যেন ‘নেলসনস আই’ নীতি গ্রহণ করেছে। বৃটিশ রাজনীতিবিদ ও সাবেক হোম সেক্রেটারি প্রিতি প্যাটেলের ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে বৃটিশ সাংবাদিক ও কবি ইলিয়নর পেনি রেড পেপার অনলাইন ম্যাগাজিনে লেখা নিবন্ধের শিরোনামে লিখেছেন, ‘ইউকে হ্যাজ বিন সার্পোটিং ইজরায়েলস ওয়ার ক্রাইমস ফর ইয়ার্স’। বছরের পর বছর(দশক) ধরে বৃটেন ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা যতই উটপাখির ভূমিকা গ্রহণ করুক না কেন, বিশ্বসম্প্রদায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও মানবাধিকারে পক্ষে বার বার জোরালো সমর্থন দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে জায়নবাদী নীলনকশা বিশ্বসম্প্রদায়ের সব উদ্যোগের বিপরীতে অত্যন্ত চতুরতার সাথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।

একদিকে প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি কৃষকদের শস্যখামার, জলপাই- আনারের বাগান এবং বাড়িঘর বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে দখল করা হচ্ছে। মাননবাধিকার হরণের এসব অমানবিক বর্বরতার ঘটনাগুলো পশ্চিমা মিডিয়া পারতপক্ষে সম্প্রচার করে না। করলেও এমনভাবে প্রচার করা হয় যাতে পাঠক-দর্শকদের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসনকে জাস্টিফাই করা সম্ভব হয়। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি স্বার্থের শিখন্ডি হয়ে জায়নবাদের ব্লু প্রিন্ট বাস্তবায়ণে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ফিলিস্তিনিরা প্রত্যাখ্যান করে দিলেও আরব আমিরাতসহ জিইসিভুক্ত কয়েকটি দেশকে শর্তহীনভাবে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে দেখা গেল।

মধ্যপ্রাচ্যকে ডিস্টাবিলাইজ করে রাখার জায়নবাদী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অগ্রসর শক্তি ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের সাথে আরব দেশগুলো এক ধরনের আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলের পর জো বাইডেন যখন ৬ জাতির পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইসরাইল তখন ইরানকে ক্রমশ হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ইরানের অভ্যন্তরে সামরিক গোয়েন্দা ড্রোন দিয়ে সেনা কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যা, সমুদ্রে ইরানি জাহাজে হামলার মত প্রকাশ্য তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল ও আমেরিকার হুমকি যখন নতুন মাত্রা লাভ করতে চলেছে, তখন গাজাসহ ফিলিস্তিনি ভূ-খন্ডে ইসরাইলী হত্যাযজ্ঞ ও দখলবাজি ব্যাপক রূপ নিয়েছে।

গত সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , গত এক বছরে ইসরাইলের চোরাগোপ্তা হামলায় উপসাগরে অন্তত ১২টি ইরানি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জায়নবাদী নীলনকশায় প্রোপাগান্ডা-প্রচারণার ধরন সম্পূর্ণ বিপরীত। কিছু পশ্চিমা মিডিয়া জোরের সাথে প্রচার করছে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণের হুমকি দিয়েছে।

এ সম্পর্কে পশ্চিমা একজন সাংবাদিক ফিলিপ ওয়েস লিখেছেন, এ সংক্রান্ত অপপ্রচার এক ধরনের স্কাম বা ধাপ্পাবাজি। তিনি মধ্যপ্রাচ্য তথা ফিলিস্তিন সংকটের সাথে ইরান জুজু ও আমেরিকাকে ক্রীড়নক হিসেবে কাজে লাগানোর জায়নবাদী তৎপরতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবি বা আইপাকের ভূমিকা এবং ইসরাইলের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে নিজের স্বৈরাচারি ভূমিকা টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহুর চাতুর্যপূর্ণ ভূমিকার প্রামান্য তথ্যাবলী উপস্থাপন করেছেন।

দুই দশক আগে যখন ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে শান্তি আলোচনায় একটি ইতিবাচক অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তখন নেতানিয়াহু আমেরিকায় ইহুদি লবির-শক্তি সামর্থের দিকে ইঙ্গিত করে হিব্রুতে বলেছিলেন, তিনি এসব শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ভীত নন, তার ভাষায়- ‘আমেরিকা ইজ অ্যা থিং ইউ ক্যান মোভ ভেরি ইজিলি’। ইহুদি লবি কিভাবে আমেরিকাকে পরিচালিত করছে তা মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে খুব স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রশ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্প অথবা জো বাইডেনের মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা যায় না। কারণ ডিপ স্টেট, হাই-পলিটিক্স ডেমোক্রেট বা রিপাবলিকান পালাবদলে বিশ্বাস করে না।

ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে উটপাখি নীতি এবং জায়নাবাদী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত ফয়সালা। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান-তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের কৌশলগত মৈত্রী এবং ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ পরিবর্তনের নতুন বার্তা বহন করছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সামরিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতা বিশ্বকে সেই বার্তাই দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পতনের আগেই ইসরাইলে নেতানিয়াহুর পতনের আলামত দেখা দিয়েছিল। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে ক্ষমতাচ্যুতি ও জেলে যাওয়ার আশঙ্কা সামনে রেখে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ইরানের সাথে যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে যাচ্ছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব। ইমেইল- bari_zamal@yahoo.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।