Home ইতিহাস ও জীবনী গুপ্তহত্যা ও গুপ্তঘাতক: ইতিহাসের অতি গোপন এক অধ্যায়

গুপ্তহত্যা ও গুপ্তঘাতক: ইতিহাসের অতি গোপন এক অধ্যায়

গুপ্তহত্যা-র মতো ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু প্রাচীন। এই ধরনের গোপন কার্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রু শিবিরের সামরিক বা অসামরিক পদে আসীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। প্রাচীন সমাজে এই গুপ্ত ঘাতকদের সামরিক পদমর্যাদার সম্মান দেওয়া হত না। বরং তাঁদের কাজকে অসম্মানের বলেই মনে করা হত। তবে কেউ কেউ এই কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিছু রাজত্বে এই ঘাতকরা সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করত।

চিনা কৌশলবিদ সান জু-এর বিবরণে গুপ্তহত্যা

চিনা সেনা কৌশলবিদ সান জু তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে গুপ্ত ঘাতকদের কথা লেখেননি, তবে গুপ্তচর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর লেখা “দ্য আর্ট অফ ওয়ার” বইয়ের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি ও গুপ্তচরদের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, উদ্দেশ্য যুদ্ধ হোক বা কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা, একজন সেনা প্রধানের প্রধান কাজ হল গুপ্তচর দিয়ে সঠিক খবর অনুসন্ধান করে নেওয়া। তবে সান জু তাঁর লেখায় গুপ্তহত্যা বা কিভাবে গুপ্ত ঘাতকদের ব্যবহার নিয়ে কোনও বিস্তারিত বিবরণ দেননি।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গুপ্তঘাতক

কৌটিল্য বা চাণক্য ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর লেখা বই অর্থশাস্ত্র বিভিন্ন নামে অনুদিত হয়েছে, যেমন – সায়েন্স অফ মার্শাল গেন, সায়েন্স অফ পলিটিক্স, সায়েন্স অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি ইত্যাদি। এই বইয়ে রাজ্যশাসন, অর্থনৈতিক নীতি ও সেনা কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। তাঁর লেখা বইয়ে গুপ্তচরবৃত্তির আড়ালে গুপ্ত ঘাতকদের সম্পর্কে খোলাখুলি লেখা আছে।

আরও পড়তে পারেন-

কৌটিল্যের লেখা অনুসারে গুপ্তচরের বিভিন্ন প্রকার ছিল, যার মধ্যে গুপ্ত ঘাতক-ও ছিল। এই ঘাতকদের মধ্যে আবার বিভিন্ন ভাগ ছিল। তারা নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করতে আলাদা আলাদা কৌশল ব্যবহার করত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রাঁধুনি, রান্নার সাহায্যকারী বা স্নানের জল সংগ্রহকারীর ছদ্মবেশে থাকা বিষ প্রয়োগকারী গুপ্তঘাতকদের কথা। এই নির্মম ঘাতকদের মধ্যে কোনও দয়ামায়া ছিল না। এরা গুপ্তহত্যার স্বার্থে মূলত বিষ প্রয়োগ করত।

গুপ্তহত্যা ব্যতীত অন্যান্য পরিকল্পনা প্রয়োগ করার বিষয়ে বিভিন্ন কৌশলের ব্যবহার নিয়েও কৌটিল্য লিখেছিলেন। যেমন, যাঁকে লক্ষ্য করা হয়েছে সরাসরি তাকে হত্যা না করে তাঁর কোনও মন্ত্রীকে হত্যা করা কিংবা রাজ দরবারে কোনও বিবাদের সূত্রপাত ঘটানো ইত্যাদি করা উচিত। এর ব্যাখ্যা করতে কৌটিল্য “রাজদ্রোহী মন্ত্রী”-এর উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, কোনও রাজা তাঁর রাজদ্রোহী মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে চান। এই পরিস্থিতিতে সেই মন্ত্রীর কোনও ভাই থাকলে গুপ্তচর তাঁকে সম্পত্তির ভাগ চাইতে প্ররোচিত করবে। এই মন্ত্রীর ভাই প্ররোচিত হয়ে তাঁর দাবি নিয়ে সরব হলে, গুপ্তঘাতক সেই ভাইকে হত্যা করবে। এরপর রাজা সেই মন্ত্রীকে ভাইয়ের হত্যার শাস্তি হিসেবে বন্দি বা হত্যা করতে পারেন। গুপ্তহত্যার পাশাপাশি এমন বিভিন্ন কৌশল দ্বারা শত্রুপক্ষের রাজ দরবারে অশান্তির সৃষ্টি করার বহু কৌশলও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মজুত রয়েছে।

গুপ্তহত্যা ও হাশশাশিনদের কৌশল

হাশশাশিনরা সম্ভবত ইতিহাসের সব থেকে পরিচিত গুপ্তঘাতক ছিলেন। তাঁরা মূলত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্যে হাশশাশিনদের রাজত্ব ছিল। সেই সময় এই অঞ্চলে ক্ষমতাশালী সুন্নি সেলজুক ও ক্যাথলিক ক্রুসেডের রাজত্ব ছিল। হাশশাশিনদের লোকসংখ্যা কম হওয়ার জন্য সম্মুখ সমরে তারা কখনওই এই ক্ষমতাশালী রাজ্যের সাথে পেরে উঠত না। এই কারণে তারা অন্য কৌশল অবলম্বন করত। মধ্য প্রাচ্যের দুর্গ থেকে তারা গুপ্ত ঘাতক পাঠাত শত্রু নেতাদের গুপ্তহত্যা করার জন্য।

ছোট রাজত্ব হলেও হাশশাশিনরা খুবই দক্ষ হত্যাকারী ছিল। এই নিয়ে তাঁদের শত্রুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে তারা সক্ষম হয়েছিল। হাশশাশিনদের হাতে মৃত্যু হয়েছে এমন কয়েক জন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন, ত্রিপোলির ক্রুসেডার দ্বিতীয় রেমন্ড, মন্টফেরাটের কনরাড, সেলজুক উজির প্রমুখ। এমনকি মহান মুসলিম নেতা সালাদিন ছিলেন হাশশাশিনদের নিশানা, তবে তিনি তাঁদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যান। হাশশাশিনরা তাদের নিশানাকে জনসাধারণের মধ্যে হত্যা করতে পছন্দ করত। কারণ এর ফলে শত্রুদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়ত।

হাশশাশিনদের ভয়ঙ্কর কুখ্যাতি বেড়েই চলেছিল, কারণ তাদের নৃশংসতা নিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল। হয়ত, তাদের এই কুখ্যাতির কারণেই তাদের শত্রু রাজ্যগুলো সরাসরি হাশশাশিনদের রাজত্বে আক্রমণ করতে ভয় পেত। তবে হাশশাশিনরা তাদের ঘিরে যে অদম্য এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার ছদ্ম কাহিনী তৈরি করেছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। এই সময় মধ্যপ্রাচ্যে মোঙ্গলরা আক্রমণ করে। শোনা যায়, এই সময়ে আলামুত দুর্গ সমেত ৪০টি হাশশাশিন দুর্গ ধ্বংস করা হয়। এর সাথেই সংগঠিত শক্তি হিসেবে হাশশাশিনদের সমাপ্তি ঘটে। সূত্র: সালামওয়েবটুডে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।