Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন পবিত্র কুরআন নাযিলের সূচনাকাল ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

পবিত্র কুরআন নাযিলের সূচনাকাল ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

।। মুফতি আবু সাঈদ ।।

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন আল্লাহ তা‘আলার গ্রন্থ ও বাণী। এটি অনন্তকাল থেকে ‘লওহে মাহফুজে’ লিখিত রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- بَلْ هُوَ قُرْاٰنٌ مَّجِيْدٌ، فِىْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ.
“বরং এটা অতি উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।”
তা দু’ধাপে এ জগতে অবতীর্ণ হয়।

প্রথমত: রমযান মাসে ‘শবে কদর’ তথা কদর রজনীতে কুরআনের পূর্ণ অংশ লওহে মাহফূজ থেকে প্রথম আসমানের ‘বাইতুল মা’মুরে’ অবতীর্ণ হয়। দ্বিতীয়ত: প্রথম আসমান থেকে সূরা আলাকের উল্লিখিত পাঁচ আয়াতের মাধ্যমে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চল্লিশ বৎসর বয়সে কুরআন অবতরণ শুরু হয়। এরপর স্থান-কাল-পাত্রভেদে প্রয়োজন অনুসারে মোট তেইশ বৎসরে অবতরণ সম্পন্ন হয়।

এই অবতরণের সূচনাকাল, সঠিক ও বিশুদ্ধ মতানুসারে রমযানের ‘লাইলাতুল কদর’ তথা কদর রজনী। কিন্তু রমযানের কোন তারিখের রজনী, তাতে মতের ভিন্নতা রয়েছে। কিছু বর্ণনাতে ১৭ই রমযান আর কিছু বর্ণনাতে ১৯ রমযান, আবার কিছু বর্ণনাতে ২৭শে রমযানের কথা পাওয়া যায়।

কুরআন নাযিলের ২৩ বৎসর

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন দুনিয়ার আসমান হতে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হৃদয়ে নবুওয়াতের তেইশ বছর জিন্দেগীর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তি থেকে পরলোকগমন পযর্ন্ত সময়ে।

এভাবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে অবতীর্ণ হওয়ার কথা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুরআনে কারীমে ঘোষণা করেন-

وَقُرْاٰنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلٰى النَّاسِ عَلٰى مُكْثٍ وَّنَزَّلْنَاهُ تَنْزِيْلًا.

“এবং আমি কুরআনকে পৃথক পৃথক (আয়াত, আয়াত) করে সাজিয়েছি, যাতে আপনি ধীরে ধীরে লোকদের কাছে পাঠ করেন এবং একে আমি অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছি।”

অন্যস্থানে তিনি ইরশাদ করেন-

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْاٰنُ جُمْلَةً وَّاحِدَةً كَذٰلِكَ لِنُثَبِّتَ بِهٖ فُؤَادَكَ وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيْلًا.

“কাফেররা বলে, সমগ্র কুরআন তাঁর প্রতি একসাথে অবতীর্ণ হলো না কেন? (হে নবী!) আমি এ জন্য এমন করেছি, যাতে এর মাধ্যমে আপনার হৃদয়কে মজবুত ও দৃঢ় রাখি এবং আমি একে ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি।”

বর্ণিত আছে- এভাবে দফায় দফায় কুরআন অবতরণে ইহুদি-মুশরিকরা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আপত্তি করত। নবীজির সামনে তাদের প্রস্তাব ছিল, তিনি যেন কুরআনে কারীমকে এক দফায় অবতীর্ণ করে দেখান।

ইহুদিরা একবার বলেই বসলো- হে আবুল কাসেম! এই কুরআন পুরোটা একসাথে অবতীর্ণ হলো না কেন? যেমন আমাদের তাওরাত হযরত মূসার ওপর একসাথে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন তাদের কথার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা উপরিউক্ত আয়াত দু’টি নাযিল করলেন।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লামা যুরকানী রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার প্রদানকৃত জবাবটি দুটি বিষয়ে প্রমাণ বহন করে- এক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিলকৃত কুরআন দফায় দফায় প্রয়োজন অনুসারে অবতীর্ণ হয়েছে। দুই. পূর্ববর্তী আসমানী সকল গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছিল পুরোটা একসাথে। শেষোক্ত মতটিকেই উলামায়ে কেরাম সুপ্রসিদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেন।

উল্লিখিত দুটি কথার প্রমাণ হল- তারা আসমানী গ্রন্থসমূহের ব্যাপারে এক দফায় অবতরণের যেই দাবি করেছে, সে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা তাদের দাবি খ-ন করেননি, বরং পৃথক পৃথকভাবে কুরআন অবতরণের হিকমত কী, তা বর্ণনা করে তাদের জবাব দিয়েছেন। আসমানী অন্য সকল গ্রন্থও যদি কুরআনের মতোই স্থান-কাল-পাত্রভেদে অবতীর্ণ হতো, তাহলে তিনি অবশ্যই তাদের সেই কথার জবাব দিতেন।

ধাপে ধাপে কুরআন নাযিলের হিকমত ও নিগূঢ় রহস্য

প্রয়োজন অনুসারে ধাপে ধাপে কুরআন অবতরণের মাঝে রয়েছে বহু নিগূঢ় রহস্য এবং বড় বড় অনেক হিকমত। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো-

১. মুশরিকদের পক্ষ থেকে শত সহ¯্র কষ্ট ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার ছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই শত সহ¯্র ঝঞ্ঝার মাঝে হযরত জিবরাঈল আ. যখন বারবার ওহী নিয়ে আসতেন, নবীজি একটু শান্তি ও স্বস্তি অনুভব করতেন। এর দ্বারা নবীজির হৃদয় সুদৃঢ় হত।

২. ওহী অবতরণের ক্ষেত্রে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কোমলতা প্রদর্শন করা। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। যদি পূর্ণ কুরআন এক সাথে অবতীর্ণ হত, কুরআনকে স্মৃতিতে ধারণ করা ও আত্মস্থ করা নবীজির জন্য কষ্টকর হয়ে যেত।

হযরত মূসা আ. লেখাপড়া শিখেছিলেন, পূর্ণ তাওরাত তাঁর ওপর একসাথে অবতীর্ণ হওয়া তাঁর জন্য কষ্টকর ছিল না। তাই পুরো তাওরাত তাঁর ওপর একসাথে অবতীর্ণ হয়।

৩. আসমানী বিধান বর্ণনায় ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা।

৪. মুসলমানদের জন্য কুরআনকে বোঝা এবং তাকে মুখস্থ করা যাতে সহজ হয়।

৫. কুরআনের বড় একটি অংশ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এবং বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়। বিশেষ কোন ঘটনা ঘটে গেলে সে প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হত এবং যদি কোন ভুল সংঘটিত হত তাহলে সাথে সাথে ওহী অবতীর্ণ করে তার সংশোধন করে দেওয়া হত। কিন্তু পুরো কুরআন একসাথে অবতীর্ণ হলে এগুলো সম্ভব হত না।

এভাবে পৃথক পৃথকভাবে কুরআন অবতীর্ণ হওয়াতে মুসলমানদের অন্তর্দৃষ্টি বেশি খুলত এবং কুরআনের সত্যতা আরো বেশি স্পষ্ট হত।

৬. যদি সম্পূর্ণ কুরআন একসাথে অবতীর্ণ হত, মুসলমানগণ আল্লাহ প্রদত্ত সকল আদেশ নিষেধ একসাথেই পালন করতে বাধ্য থাকত, এর দ্বারা দ্বিগুণ কষ্টের সম্মুখীন হতে হত।

এ ধরনের হিকমতের কারণেই মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন পুরোটা এক সাথে অবতীর্ণ না হয়ে দফায় দফায় অবতীর্ণ হয়।

– মুফতি আবু সাঈদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। খতীব- বারীয়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।