Home মহিলাঙ্গন উম্মাহাতুল মু’মিনীন বা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পুণ্যবতী সহধর্মিনীগণ

উম্মাহাতুল মু’মিনীন বা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পুণ্যবতী সহধর্মিনীগণ

।। আল্লামা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী ।।

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর জীবনের বিভিন্ন সময়ে মতান্তরে এগার জন মহিয়সী রমণীকে স্বীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদেরকে ‘উম্মাহাতুল মু’মিনীন’ বা ‘উম্মতের জননী’ নামে অভিহিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম হযরত খাদিজা (রাযি.)কে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমা স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন তিনি দ্বিতীয় কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি। সুপ্রিয় পাঠক সমীপে উম্মত জননীগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরছি।

হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাযি.)
তাঁর পিতার নাম খুয়াইলিদ এবং মাতার নাম ফাতিমা বিনতে যাইদা। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পতিত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি দু’জন স্বামীর ঘর করেছিলেন। প্রথম পক্ষে দু’জন পুত্র সন্তান এবং দ্বিতীয় পক্ষে মাত্র একজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথম পক্ষের ‘হিন্দ’ নামক এক পুত্র ইসলাম গ্রহণ করেন অতঃপর জঙ্গে জামালে হযরত আলী (রাযি.)এর পক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন।

হযরত খাদিজা (রাযি.)এর গর্ভে হযরত নবী কারীম (সা.)এর একজন পুত্র মতান্তরে দু’জন পুত্র জন্মগ্রহণের পর বাল্যকালে ইন্তিকাল করেন। পরবর্তীতে চার জন কন্যা যথাক্রমে হযরত যাইনাব (রাযি.), হযরত রুকাইয়্যা (রাযি.), হযরত উম্মে কুলসূম (রাযি.) এবং খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাযি.) যথারীতি সংসার জীবন-যাপন করেন। হযরত ফাতিমা (রাযি.)এর বংশধারার মাধ্যমেই আহলে বাইতের রক্তধারা আজও দুনিয়ায় বিদ্যমান রয়েছে।

হযরত খাদিজা (রাযি.) ৪০ বছর বয়সে ২৫ বছর বয়সী যুবক হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর সাথে মুবারক দাম্পত্য জীবন শুরু করেন এবং ২৫ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছেন। যে কারণে তাঁর জীবদ্দশায় অন্যকোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি।

একদিন হযরত আয়েশা (রাযি.) নবী কারীম (সা.)কে বলেছিলেন, “একজন বৃদ্ধা, তাও মারা গেছেন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করা সত্ত্বেও আপনি সবসময় শুধু তাঁরই স্মৃতিচারণ করে থাকেন”। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, “কখনও তোমরা তাঁর চেয়ে উত্তম নও। হে আয়েশা! যখন মানুষ আমাকে মিথ্যাবাদী বলত, তখন সে-ই আমাকে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছিল। যখন মানুষ কাফির ছিল, তখন সে-ই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। যখন আমার কোন সাহায্যকারী ছিল না, তখন সে-ই আমাকে সাহায্য করেছিল”।

উল্লেখ্য, ইসলামের ইতিহাসে নারীদের মধ্যে হযরত খাদিজা (রাযি.) সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত খাদিজা (রাযি.) হিজরতের পর ৬৫ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তিকাল করেন। নবীপত্নীগণের মধ্যে একমাত্র তাঁরই কবর পবিত্র মক্কায় অবস্থিত। আজও মুসলমানরা শ্রদ্ধাভরে তাঁর কবর যিয়ারত করে থাকেন।

হযরত সাওদা (রাযি.)
হযরত খাদিজা (রাযি.)এর ইন্তিকালের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নিঃসঙ্গতা অবলোকন করে হযরত খাওলা বিনতে হাকিম (রাযি.) তাঁর সম্মতিক্রমে হযরত সাওদা (রাযি.)এর পিতার বরাবরে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেন। পরবর্তীতে হযরত সাওদা (রাযি.)এর সম্মতিক্রমে হযরত জামআ (রাযি.) চারশ’ দিরহাম মোহর ধার্য করেন এবং নিজেই মুবারক বিবাহ পড়িয়ে দেন।

হযরত সাওদা (রাযি.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে প্রথম স্বামী হযরত সাফ্ওয়া ইবনে উমায়ের (রাযি.)এর সঙ্গে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পর তাঁর স্বামী ইন্তিকাল করায় একমাত্র পুত্র হযরত আব্দুর রহমানকে নিয়ে বিধবা জীবন কাটান। পরবর্তীতে তাঁর উক্ত পুত্র জালুলার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন।

হযরত সাওদা (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আনুগত্য ও নির্দেশ পালনে সব স্ত্রীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। উদারতা ও দানশীলতায় তিনি হযরত আয়েশা (রাযি.) ব্যতীত সবার উপরে ছিলেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ ও স্থূল দেহের অধিকারী। এ কারণে তাঁর চলাফেরার গতি ছিল খুব মন্থর।

তাঁর মাধ্যমে মাত্র পাঁচটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং যার একটি মাত্র বুখারী শরীফে উল্লেখ হয়েছে। তিনি হযরত উমর (রাযি.)এর খিলাফতের শেষ সময়ে মদীনায় ইন্তিকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে দাফন হন।

হযরত আয়েশা (রাযি.)
নবুওয়্যাতের দশম বর্ষে হযরত খাওলা বিনতে হাকিমের প্রস্তাবনায় রাসূলে কারীম (সা.)এর সাথে চারশ’ দিরহাম মোহরে পবিত্র শাওয়াল মাসে মাত্র ৬ বছর বয়সে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের পর নবীজি (সা.) মাত্র এক বছর মক্কায় ছিলেন। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সার্বক্ষণিক সাথী ছিলেন। তাঁর মাতার নাম হযরত উম্মে রুম্মান (রাযি.)।

মদীনায় হিজরতের পর নবী কারীম (সা.) ও হযরত আবুবকর (রাযি.) তাঁদের স্ব-স্ব পরিবার পরিজন নিয়ে মদীনায় আসার পর মাত্র ৯ বছর বয়সে শাওয়াল মাসে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর মুবারক দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তাঁর বয়স যখন মাত্র আঠার বছর তখন নবী কারীম (সা.)এর ওফাত হয়। এরপর তিনি ৪৮ বছর দুনিয়ায় বেঁচে ছিলেন। হিজরী ৫৭ সনে ৬৬ বছর বয়সে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন। হযরত আবু হুরাইরাহ (রাযি.) তাঁর নামাযে জানাযার ইমামতি করেন এবং রাতেই তাঁকে জান্নাতুল বাকী গোরস্থানে দাফন করা হয়।

তিনি ২২১০টি হাদীস বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে এককভাবে ৫৪টি হাদীস বুখারী শরীফে এবং ৬৮টি মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে। কারো কারো মতে শরীয়তের বিধিমালার এক চতুর্থাংশ তিনিই বর্ণনা করেন। তিনি একাধারে মুহাদ্দিসা ও ফক্বিহা ছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি অনেক জটিল বিষয়ে ফায়সালাসহ ফাতওয়া প্রদান করতেন। বিশিষ্ট সাহাবীগণও অনেক জটিল ব্যাপারে তাঁর ফাতওয়ার শরণাপন্ন হতেন।

হযরত হাফ্সা (রাযি.)
তিনি ছিলেন ইসলামের লৌহমানব হযরত উমর (রাযি.) ও হযরত যাইনাব বিনতে মাজঊন (রাযি.)এর কন্যা। নবুওয়্যাতের ৫ বছর পূর্বে তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম বিবাহ হযরত খুলাইস ইবনে হুযাইফা (রাযি.)এর সাথে সম্পাদিত হয়। স্বামীর সঙ্গে মদীনায় হিজরত করার পরবর্তীতে তাঁর স্বামী বদর যুদ্ধে আহত হয়ে মদীনায় শাহাদাত বরণ করেন। নিঃসন্তান হযরত হাফ্সা (রাযি.) বিধবা হয়ে যাওয়ায় হযরত উমর (রাযি.) বেশ চিন্তিত ছিলেন। হযরত নবী কারীম (সা.) ইসলামের এ বীর পুরুষের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজেই প্রস্তাব দিয়ে তাঁকে বিবাহ করেন।

হযরত হাফসা (রাযি.)এর মেজায পিতার মত একটু কড়া ছিল। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে কথায় সমান উত্তর দিতে অভ্যস্ত ছিলেন। হযরত উমর (রাযি.) বিষয়টি জ্ঞাত হয়ে তাঁকে সাবধান করে দিয়ে তিরস্কার করেন।

হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সাথে তাঁর সবচেয়ে বেশি হৃদ্যতা ছিল। অবশ্য মাঝেমধ্যে তাঁদের উভয়ের মধ্যে স্বপত্নী সূলভ ছোটখাটো বিরোধও হত।

হিজরী ৪৫ সনে হযরত মুআবিয়া (রাযি.)এর আমলে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন। যৎসামান্য আসবাবপত্র ছিল, তা তিনি গরিব-মিসকীনদের মধ্যে অন্তিমকালে বিলিয়ে দেন। তৎকালীন মদীনার শাসনকর্তা হযরত মারওয়ান ইবনে হাকাম (রহ.) তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) এবং তাঁর পুত্রগণ তাঁর লাশ কবরস্থ করেন। হযরত আবু হুরাইরাহ (রাযি.)ও তাঁর দাফনে অংশগ্রহণ করেন।

হযরত যাইনাব বিনতে খুযাইমাহ (রাযি.)
প্রথমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রাযি.)এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পাদিত হয়। উহুদের যুদ্ধে তাঁর স্বামী শহীদ হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বিধবা অবস্থায় তাঁকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তিনি মাত্র ৩/৪ মাস বেঁচে ছিলেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। জান্নাতুল বাকীতে তাঁর দাফন হয়।

তিনি গরিব-মিসকীনদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ছিলেন। তাই তিনি ‘উম্মুল মাসাকীন’ বা মিসকীনদের জননী নামেই সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। হযরত খাদিজা (রাযি.)এর পরে একমাত্র তিনিই রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মুবারক হাতে কবরস্থ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

হযরত উম্মে সালামা (রাযি.)
তাঁর প্রকৃত নাম হিন্দ এবং ডাক নাম উম্মে সালামা। তাঁর পিতার নাম সুহাইল এবং মাতার নাম আতিকা। তাঁর প্রথম বিবাহ সম্পন্ন হয় রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দুধ ভাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবুল আসাদ (রাযি.)এর সঙ্গে। তিনি ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণ করে স্বামীর সাথে হাবশাতে হিজরত করেন। পরবর্তীতে হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে আসেন এবং দ্বিতীয় দফায় মহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর স্বামী উহুদ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন এবং পরবর্তীতে মদীনায় শাহাদাত বরণ করেন। সে সময় তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সন্তান প্রসবান্তে ইদ্দত পালনের পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই প্রস্তাব পাঠিয়ে তাঁকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন।

তিনি উম্মুল মু’মিনীনগণের মধ্যে সর্বশেষে মদীনায় ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। নির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে তিনি ৮৪ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।

মেধা ও পান্ডিত্যে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর পরেই তাঁর স্থান সর্বজন স্বীকৃত। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর মতামতের পর তাঁর মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হত। হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাযি.) মতান্তরে হযরত আবু হুরাইরাহ (রাযি.) তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে তাঁর দাফন হয়।

হযরত যাইনাব বিনতে জাহাশ (রাযি.)
হযরত যাইনাব বিনতে জাহাশ (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ফুফাত বোন ছিলেন। প্রথমে হযরত যায়েদ (রাযি.)এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পাদিত হলেও তিনি হযরত যায়েদ (রাযি.)এর সাথে ঘর করতে অনীহা প্রকাশ করার প্রেক্ষিতে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে তিনি ৩৫ বছর বয়সে নবী কারীম (সা.)এর স্ত্রী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সমকক্ষতা আশা করতেন।

তিনি ইবাদত-বন্দেগীতে ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী ও উদার চিত্তের অধিকারীনী। তিনি নিজ হাতে উপার্জন করে কষ্টে জীবন-যাপন করেও সবকিছু আল্লাহর রাহে ব্যয় করতেন।

হযরত উমর (রাযি.)এর খিলাফতকালে ২০ হিজরীতে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন। তিনি তাঁর কাফনের সরঞ্জাম নিজেই আগাম ব্যবস্থা করে রাখেন। হযরত উমর (রাযি.) তাঁর নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। হযরত উসামা (রাযি.), হযরত মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ (রাযি.) প্রথমে তাঁর লাশ জান্নাতুল বাকীর কবরে নামান। নবীজি (সা.)এর ইন্তিকালের পর নবীপত্নীদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্তিকাল করেন।

হযরত জুওয়াইরিয়াহ (রাযি.)
তাঁর পিতার নাম হারিস ইবনে যারারা। তাঁর পিতা মুস্তালিক গোত্রাধিপতি ছিলেন। মুনাফ ইবনে সাফ্ওয়ানের সাথে তাঁর প্রথম বিবাহ হয়। মুরাইসীর যুদ্ধে তাঁর স্বামী নিহত হওয়ায় তিনি যুদ্ধ বন্দিনীরূপে মদীনায় আনীত হন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে তিনি হযরত সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রাযি.)এর ভাগে পড়েন। তৎকালীন আইন মোতাবেক অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ঊনিশ উকিয়া স্বর্ণ মুক্তিপণের শর্ত চূড়ান্ত করত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত সাহায্য প্রার্থনা করেন। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। দয়ার নবী (সা.) তাঁর মুক্তিপণ আদায়ের নিশ্চয়তা প্রদান করেন এবং বিবাহের প্রস্তাব পেশ করলে তিনি বিবাহে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

আরও পড়তে পারেন-

পরবর্তীতে এ বিবাহের খবর জানাজানি হলে সাহাবায়ে কিরাম বনী মুস্তালিক গোত্রের প্রায় সাত শতাধিক যুদ্ধবন্দীকে (যারা দাসদাসী হিসেবে ইতোমধ্যে সাহাবীগণের মধ্যে বন্টিত হয়ে ছিলেন) মুক্তি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর এই দাম্পত্য সম্পর্কের শুভ প্রতিক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। কোন কোন বর্ণনা মতে হযরত জুওয়াইরিয়াহ (রাযি.)এর অনুরোধেই এ মুক্তির ঘটনা ঘটে। তিনি ৫০ হিজরী সনে ৬৫ বছর বয়সে মদীনায় ইন্তিকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে তাঁর দাফন হয়।

হযরত উম্মে হাবীবাহ (রাযি.)
তাঁর প্রকৃত নাম রামলা এবং উপনাম উম্মে হাবীবাহ। তিনি নবুওয়্যাতের ১৭ বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশের সাথে বিবাহ হয়। নবুওয়্যাতের পর স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ইসলাম গ্রহণের গৌরব লাভ করেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই হাবশায় হিজরত করেন। সেখানে হাবীবাহ নামে তাঁদের এক কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

আবিসিনিয়ায় পৌঁছে তাঁর স্বামী খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও তিনি ইসলাম ধর্মের উপর অটূট থেকে স্বামী পরিত্যক্তারূপে দিন কাটান। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বিপন্নাবস্থা ও ঈমানের দৃঢ়তার বিষয় জানতে পেরে হযরত উমর ইবনে উমাইয়া মুযারী (রাযি.)কে বাদশা নাজ্জাশীর কাছে হযরত উম্মে হাবীবাহ (রাযি.)এর জন্য বিবাহের পয়গাম নিয়ে প্রেরণ করেন। বাদশা নাজ্জাশীর প্রস্তাবনায় হিজরতকারী মুসলমানদের উপস্থিতিতে ৪০০ স্বর্ণমুদ্রা মোহরের বিনিময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পাদিত হয়। বাদশা নাজ্জাশী নিজে মোহরের অর্থ পরিশোধ করে ওলীমা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।

পরবর্তীতে বাদশা নাজ্জাশী বেশ কিছু উপঢৌকনসহ সাহাবী হযরত শরাইবিল ইবনে হাসনা (রাযি.)এর মাধ্যমে হযরত উম্মে হাবীবাহ (রাযি.)কে মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)এর খেদমতে প্রেরণ করেন। তিনি হিজরী ৪৪ সনে মদীনায় ইন্তিকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে দাফন হন।

হযরত মাইমুনাহ (রাযি.)
হযরত মাইমুনাহ (রাযি.)এর পিতার নাম হারিস এবং মাতার নাম হিন্দা। প্রথম স্বামী মাসঊদ ইবনে উমাইরীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয়ে দ্বিতীয় স্বামী আবু রহম ইবনে উজ্জার মৃত্যুর পর তিনি নবী কারীম (সা.)এর পতœী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর খেদমতে উৎসর্গ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করার প্রেক্ষিতে ‘সরিফ’ নামক স্থানে দয়ার নবী (সা.)এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পাদিত হয়। হযরত আব্বাস (রাযি.) উক্ত বিবাহ পড়ান।

দীর্ঘদিন পর তিনি একই স্থানে ইন্তিকাল করেন এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং লাশ কবরস্থ করেন। তাঁর ইন্তিকালের সন সম্বন্ধে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে তিনি হিজরী ৫১ সনে ‘সরিফ’ নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন।

হযরত সাফিয়্যাহ (রাযি.)
তাঁর প্রকৃত নাম যাইনাব, পিতার নাম হুওয়াই ইবনে আখ্তাব, মাতা বনু কুরাইযা গোত্রের সর্দারের কন্যা। তাঁর পিতা বনু নযীর গোত্রের প্রধান তথা খাইবার অধিপতি ছিলেন। যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে মদীনায় পৌঁছে পরবর্তীতে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর স্ত্রী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। যুদ্ধলব্ধ মালের দলপতির জন্য রক্ষিত সর্বোৎকৃষ্ট অংশকে ‘সাফিয়্যাহ’ বলা হয়। এই সুবাদেই তাঁকে সাফিয়্যাহ নামে ডাকা হত।

তাঁর প্রথম স্বামীর নাম সালাম ইবনে মাশকামুল কাবশী। প্রথম স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হয়ে কানানা ইবনে আবুল হাফীফ-এর সাথে দ্বিতীয় বিবাহ হয়। কানানা খাইবার যুদ্ধে নিহত হয়। একজন সর্দারের কন্যা হওয়ার সুবাদে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে মুক্ত করে দেন। তাঁর নিজের অভিপ্রায়ের প্রেক্ষিতে খাইবার থেকে ফেরার পথে ‘সাহবা’ নামক স্থানে দয়ার নবী (সা.)এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পাদিত হয় এবং সঙ্গে রক্ষিত খাদ্য সামগ্রী দিয়েই ওলীমা অনুষ্ঠান করা হয়।

হযরত নবী কারীম (সা.) তাঁকে বিশেষ মুহাব্বত করতেন। সর্বক্ষেত্রেই তাঁর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রতি তিনি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। তিনি হিজরী ৫০ সনে মদীনায় ইন্তিকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকীতে দাফন হন।

হযরত মারিয়া ক্বিবতিয়া (রাযি.)
হযরত মারিয়া ক্বিবতিয়া (রাযি.) সম্পর্কে সাধারণ সীরাত গ্রন্থে তেমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে তিনি ‘আলিয়া’ নামক স্থানে বসবাস করতেন এরূপ বর্ণনা রয়েছে। হিজরী ৮ম সনে তাঁরই গর্ভে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সন্তান হযরত ইবরাহীম (রাযি.) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ইবরাহীম (রাযি.) মতান্তরে দু’বছর বয়সের পূর্বেই ইন্তিকাল করেন। নবী কারীম (সা.) স্বয়ং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের জানাযার নামায পড়ান এবং জান্নাতুল বাকীতে হযরত উসমান ইবনে মাযঊন (রাযি.)এর কবরের পাশেই সমাহিত করেন। হযরত ইবরাহীম (রাযি.)এর ইন্তিকালের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মুবারক চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রুধারা নেমে আসে। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, জবাবে সাহাবীদেরকে বলেন, এটা পিতৃস্নেহ অশ্রুর ধারায় বিগলিত হয়ে নেমে এসেছে।

কোন কোন বর্ণনায় নবী কারীম (সা.)এর বিবিগণের সংখ্যা ৯ জন বর্ণিত হয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে তাঁর সম্মানিতা স্ত্রীগণের সংখ্যা ১১ জন। তবে হযরত যাইনাব বিনতে খুযাইমা (রাযি.) এবং মারিয়া ক্বিবতিয়া (রাযি.)এর বর্ণনা খুবই স্বল্প পাওয়া যায়। যেহেতু তাঁরা উভয়ে খুব স্বল্প সময় নবী কারীম (সা.)এর একান্ত সান্নিধ্যে ছিলেন। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.)এর স্ত্রীগণের সংখ্যা ৯ জন বলা হয়।

কোন কোন বর্ণনা মতে হযরত মারিয়া ক্বিবতিয়া (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ক্রীতদাসী ছিলেন বলে উল্লেখ আছে। তবে তিনি তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন- এ সুবাদে বিশেষ মর্যাদার অধিকারীনী হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

হযরত নবী কারীম (সা.)এর সম্মানিতা স্ত্রীগণের মধ্যে একমাত্র হযরত আয়েশা (রাযি.)ই কুমারী ছিলেন। অন্যান্য স্ত্রীগণের সবাই ২য়, ৩য় অথবা ৪র্থ স্বামী হিসেবেই তাঁর সান্নিধ্য প্রাপ্ত হন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর প্রত্যেকটি বিবাহের নেপথ্যে বিশেষ বিশেষ কারণ নিহিত ছিল। কারো ঈমানের দৃঢ়তার জন্য, কারো কষ্ট লাঘবের জন্য, কারো মার্যাদা রক্ষার জন্য এবং কারো ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ থাকার জন্য বিবাহগুলো অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর সবগুলো বিবাহই পূতপবিত্র। এ ব্যাপার বিরূপ মন্তব্যকারীরা অভিশপ্ত এবং লা’নতপ্রাপ্ত। রহমতে দুআলম (সা.)এর সব কাজই আল্লাহ তাআলা কর্তৃক অনুমোদিত। তাই এ ব্যাপারে বান্দার মন্তব্যের কোন অধিকারই থাকতে পারে না।

লেখক: ফারেগে দারুল উলূম দেওবন্দ এবং উস্তাদুল ফিক্বহ ওয়াল হাদীস ও সহযোগী শিক্ষাসচিব- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।