Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা আল্লাহর আমানত

রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা আল্লাহর আমানত

- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।

বিশ্বময় আজ বেজে উঠেছে অশান্তি ও নৈরাজ্যের দামামা; দেখা দিয়েছে সন্ত্রাস ও অস্থিতিশীলতার অশনিসঙ্কেত; ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে আজ নিরাপত্তাহীনতার প্লাবন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আদর্শিক নেতৃত্বের অভাবহেতু হানাহানি। বস্তুবাদী শিক্ষা ও ভোগবাদী সভ্যতার প্রভাবে নৈতিকতাবোধ পরাভূত। দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচরিতায় মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। আল্লাহর আরশ কাঁপছে বিপন্ন ও অধিকারহারা মানুষের করুণ আহাজারিতে। কেন এমনটি হলো? এর কারণ খুঁজতে হবে। সমাধান পেতে হবে। বাদশাহের শাসনের নামে ফিরআউনি শাসন, পোপের শাসনের নামে নিপীড়নমূলক শাসন, জনগণের শাসনের নামে বহুদলীয় স্বৈরশাসন, সামরিক শাসনের নামে ফ্যাসিবাদী শাসন এবং বিশ্ববাসীকে হতাশা, অশ্বস্তি ও ধ্বংসের প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় করেছে। মানুষের গড়া এসব আইনের শাসনের আরো কত বিচিত্র নাম রয়েছে। এ সব শাসন হচ্ছে আল্লাহর আইনের শাসনের বিকল্প পদ্ধতি। মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব সৃষ্টির ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশল।

প্রখ্যাত ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ: বলেন, রাষ্ট্রীয় যত পদ ও মর্যাদা রয়েছে, সেসবই আল্লাহর আমানত। যাদের হাতে নিয়োগ ও বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সেসব কর্মকর্তা ও অফিসাররা হলেন সে পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোনো পদ এমন কাউকে অর্পণ করা জায়েজ নয়, যে তার যোগ্য নয়; বরং প্রতিটি পদের জন্য নিজের ক্ষমতা ও সাধ্যানুযায়ী যোগ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান করা কর্তব্য। যোগ্যতা ও পরিপূর্ণ শর্ত মোতাবেক কোনো লোক পাওয়া না গেলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে যোগ্যতা, আমানতদারি ও সততার দিক দিয়ে সবচেয়ে অগ্রবর্তী ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কাজেই যাদের হাতে দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের গচ্ছিত এ আমানতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অর্থাৎ সরকারি পদসমূহে সেসব লোককেই নিয়োগ করতে হবে যাদেরকে সর্বাধিক যোগ্য বলে মনে হয়। কেউ কোনো প্রকার স্বজনপ্রীতি করে একান্ত বন্ধুত্ব কিংবা সম্পর্কের কারণে কোনো পদে নিয়োগ দেয়; তবে তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হবে। না তার ফরজ ইবাদত কবুল হবে, আর না নফল। এমনকি সে জাহান্নামে প্রবিষ্ট হবে। (নুরুদ্দীন হাইসামী, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ, পৃষ্ঠা-৩২৫)

আল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে শাসন পরিচালনা করেন না। তিনি তাঁর প্রতিনিধির (খলিফা) মাধ্যমে তার আইন কার্যকরী করেন। আল্লাহর আইন সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করতে গেলেই বাধা আসে অনিবার্যভাবে। মানুষের গড়া আইনের অনুসারীরাই এ বাধার সৃষ্টি করে। কুরআনের পরিভাষায় এদের তাগুত বলা হয়েছে। তাগুত হচ্ছে আল্লাহর প্রতিপক্ষ। ইবনে কাসির বলেন-

‘মানুষের অবয়বে শয়তানকে বলা হয় তাগুত, যার কাছে মানুষ সমস্যার সমাধানের জন্য যায় এবং সে হয় তাদের শাসক-বিচারক। (ইবনে কাসির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১৬)

পবিত্র কুরআনের আট স্থানে তাগুতকে উৎখাত করে আল্লাহর আইনের শাসন চালু করার তাগিদ এসেছে অত্যন্ত জোরোলো ভাষায়। ‘যে তাগুতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনল সে মজবুত রশি ধারণ করল; যা কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়।’ (সূরা বাকারা-২৫৬)।

পৃথিবীতে দু’টি শক্তিই বিদ্যমান। এক আল্লাহর শক্তি, অপরটি তাগুতি শক্তি। আল্লাহর আইনের অনুসারীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে যুগে যুগে তাগুতি শক্তি পরাজিত হয়েছে শোচনীয়ভাবে।

‘ঈমানদাররা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। আর যারা আল্লাহর আইনের বিরোধীরা সংগ্রাম করে তাগুতের পথে। অতএব শয়তানের অনুসারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। নিঃসন্দেহে শয়তানের কৌশল অত্যন্ত দুর্বল।’ (সূরা আন নিসা-৭৬)।

এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. বলেন, ‘এতে পরিষ্কারভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করাই মুখ্যত মুমিনদের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টার লক্ষ্য। কারণ, আল্লাহই পুরো সৃষ্টির মালিক। তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান নির্ভেজাল ও ন্যায়ভিত্তিক। তা ছাড়া ন্যায় ও কল্যাণভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই যথার্থ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিশ্বশান্তির জন্যও পুরো বিশ্বে এমন সংবিধানের প্রচলন অপরিহার্য, যাকে আল্লাহর আইন বা সংবিধান বলা হয়।

সুতরাং পরিপূর্ণ কোনো মুমিন ব্যক্তি যখন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তার সামনে এ উদ্দেশ্যই বিদ্যমান থাকে। এর বিপরীতে কাফিরদের বাসনায় থাকে কুফরের প্রচলন, কুফরের বিজয় এবং পৈশাচিক শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা; যাতে করে বিশ্বময় কুফরি ও শিরক বিস্তার লাভ করতে পারে। আর কুফরি ও শিরক যেহেতু শয়তানের পথ, সুতরাং কাফিররা শয়তানের কাজের সাহায্যকারী।

অতএব মুসলমানদের শয়তানের বন্ধুবর্গ অর্থাৎ কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে কোনো রকম দ্বিধা করা উচিত নয়। তার কারণ, তাদের সাহায্যকারী হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। পক্ষান্তরে শয়তানের কলা-কৌশল কাফিরদের কোনোই মঙ্গল সাধন করবে না। (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত, মদিনা, পৃষ্ঠা-২৬৫)।

যুগে যুগে এ পৃথিবীতে যারাই আল্লাহর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার আন্দোলন চালিয়েছেন, সবাইকে তাগুতি শক্তির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছে। কালে কালে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়ে মহান আল্লাহ এ শিক্ষা দিয়েছেন।

‘তাগুতি ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য প্রতিটি জাতির কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি।’ (সূরা নাহল-৩৬)।

দুনিয়ায় যারা মনগড়া আইন দিয়ে শাসন চালায়, তারা ওই বড় ইবলিসের অনুজ অথবা প্রতিনিধি। শয়তানি রাজনীতি ও তাগুতি পদ্ধতির মূলনীতি হচ্ছে-

আল্লাহর আইনের মোকাবিলায় নিজের আইন প্রতিষ্ঠা করা, নিজেকে আইনের উৎস হিসেবে ঘোষণা করা, নিজেকে সবার চেয়ে বড় ভাবা, মুসলমানদের বিরোধিতায় কাফিরদের সহায়তা করা, শরিয়তের মোকাবেলায় নিজের বুদ্ধির প্রাধান্য দিয়ে জাতীয়তা, বংশ ও বর্ণপূজার আহ্বান করা, ধোঁকা দেয়া, নেতৃত্বের লিপ্সা জাগ্রত করা ও মিথ্যাকে সত্যের আবরণে উপস্থাপন করা, মানবতাকে ধ্বংস করা, সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে জনগণকে ফিরিয়ে আনা, পর্দাহীনতা ও নগ্নতার প্রচার-প্রসার, সর্বোপরি দ্বীনের ধ্বংস সাধন করা। ইমাম রাগিব ইস্পাহানি মন্তব্য করেছেন, ‘মানুষ, জিন, পশুর মধ্যে যারা অবাধ্য ও সীমা লঙ্ঘনকারী তাদেরকে শয়তান বলা হয়।’ (মোফরাদাত, পৃষ্ঠা-২৬২)।

আল্লাহ যখন কারো মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধনের ইচ্ছা করেন তখন তাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও পদমর্যাদা দান করে থাকেন। তিনি যদি স্বৈরশাসন কায়েম করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হন তাহলে তার পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যারা একবার রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ও ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন তারা এটিকে আজীবন ধরে রাখার জন্য নানা চানক্যকৌশল অবলম্বনে দ্বিধা করেন না। ইতিহাসে এর নজির ভূরিভূরি। ক্ষমতার মসনদে থাকলে কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করেন না।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।