গত কয়েক মাসের পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে একের পর এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর—স্বামীর হাতে স্ত্রী, বাবার হাতে ছেলে, ভাইয়ের হাতে ভাই, এমনকি সন্তানের হাতেও প্রাণ হারাচ্ছেন মা-বাবা। এগুলো কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজে গভীর একটি সংকটের প্রতিফলন। পারিবারিক সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, এবং এর পেছনে রয়েছে সমাজের নানা স্তরে জমে থাকা ক্ষোভ, লোভ, এবং সম্পর্কের অবক্ষয়।
সহিংসতার পেছনের কারণ
প্রতিদিনের পারিবারিক তিক্ততা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, কিংবা সামান্য মতবিরোধ এখন রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় পরিণত হচ্ছে। জমি-জমা, সম্পত্তি, যৌতুক, মাদকাসক্তি কিংবা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ—এসবই হত্যাকাণ্ডের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন জাগে—কেন মানুষ এত সহজেই রাগে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? কেন পরিবার, যা একসময় ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল, আজ তা ভয়ের জায়গায় পরিণত হচ্ছে?
এর পেছনে রয়েছে আমাদের দুর্বল হয়ে পড়া পারিবারিক কাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, আর্থিক চাপ, মানসিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি নৈতিক অবক্ষয়। সামাজিক মাধ্যম আমাদের মধ্যে সংযোগ বাড়ালেও সম্পর্কের গভীরতা কমিয়ে দিয়েছে। সুস্থ বিনোদন ও খোলামেলা সংলাপের অভাবও সম্পর্কের টানাপোড়েনে ভূমিকা রাখছে।
পরিসংখ্যানের ভয়াবহ চিত্র
‘কালের কণ্ঠ’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে সংঘটিত মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশেরও বেশি ঘটছে পারিবারিক কলহের জেরে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই সারা দেশে ১১৩ জন নারী তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন স্বামীর হাতে এবং ২২ জন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, বাকি ১৮ জন নিহত হয়েছেন নিজ পরিবারের অন্য সদস্যদের হাতে।
এই পরিসংখ্যান শুধু দুঃখজনক নয়, চরমভাবে উদ্বেগজনকও। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি কোথাও ভয়াবহভাবে ফাটল ধরেছে।
সমাধানের পথ কী?
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। আমাদের সামাজিকভাবে জাগতে হবে। পরিবারকে শক্তিশালী করতে হবে সুস্থ সংস্কৃতি ও খোলামেলা সংলাপের মাধ্যমে। মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু সেটি যেন কখনও সহিংসতায় রূপ না নেয়, সে বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষা ও সহনশীলতার বীজ বপন করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে—রাগ, অপমান কিংবা বিরোধ মেটানোর পথ কখনোই সহিংসতা হতে পারে না। পাশাপাশি, রাষ্ট্রকেও নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ—দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, ভিকটিমদের সুরক্ষা দেওয়া এবং গণসচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করা জরুরি।
পরিবার বাঁচলে সমাজ বাঁচবে
পারিবারিক সহিংসতা শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি সমাজের মেরুদণ্ডে আঘাত। পরিবার যদি অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তাহলে ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য ভেঙে পড়ে এবং সমাজও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাই পারিবারিক দ্বন্দ্বকে সহিংসতায় পরিণত না করে, সমঝোতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে—ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে একসঙ্গে।
আমাদের ভাবতে হবে—কীভাবে আমরা সম্পর্কগুলো নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারি, কীভাবে ক্ষোভের স্থানে স্থাপন করব সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। কারণ, একটি মানবিক বাংলাদেশের বীজ রোপণ হয় একটি সুস্থ, নিরাপদ ও সহনশীল পরিবারে।