Home ফিকহ ও মাসায়েল ইসলামে দুর্নীতি দমনের মৌলিকপন্থাঃ একটি পর্যালোচনা

ইসলামে দুর্নীতি দমনের মৌলিকপন্থাঃ একটি পর্যালোচনা

।। হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ ।।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রে দুর্নীতি যখন স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে, ঘুষ যখন স্পিডমানি, অথবা পার্সেন্টিজমানি, নীতি নৈতিকতা সততা, হালাল-হারামের পার্থক্যকরণ যখন প্রায় অচিন্তনীয়, তখন দূর্নীতি দমনের মূলনীতি অথবা ইসলামের দুর্নীতি দমনের মৌলিকপন্থা নিয়ে আলোচনা কারো কারো কাছে বাহুল্যপনা মনে হতে পারে। তারপরও বিবেকের তাড়নায় দুর্নীতি বিষয়ে কলম চালাচালি না করে গত্যন্তর নেই। মানবীয় সমাজের উন্নতি সাধনে ইসলামের শরনাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো পথও নেই।

কেননা, একমাত্র ইসলামই বাস্তববাদী, যুগোপযোগি জীবনপদ্ধতি প্রনয়ন করেছে। মানবীয় সমাজটা যেন মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ ও উন্নত থাকে, অমানবীয় লোভকাতুরে ও সীমাহীন অর্থ লালসায় আপদমস্তক জর্জরিত হয়ে না পড়ে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে ইসলাম। এ প্রসংগে রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন: তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই শ্রেষ্ট, যে সৎ ও সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে অধিক খোদাভীরু।

উল্লেখ্য, যে ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) অধিক খোদাভীরু এবং সৎচরিত্রবান হয়, সে কখনও দুর্নীতি পরায়ন হতে পারে না। কেননা কোনো সৎচরিত্রবান ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় ধনসম্পদের পাহাড় গড়ার অভিলাষী হতে পারে না। তদ্রুপ কোনো খোদাভীরু ব্যক্তি অন্যের অধিকার হরণ করে দুর্নীতি পরায়নতার পরিচয় দিতে পারে না। এরা অবলীলায় সুনীতি ও সততা পরিত্যাগ করতে পারে না। পারে না বিবেকহীন হয়ে, পরকালের পরিনতি ভুলে গিয়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ক্ষমতার অপব্যবহার, সুযোগের অসৎ ব্যবহার পেশি শক্তি প্রয়োগ কিংবা প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে মনুষ্যত্ব বিষর্জন দিতে।

দুর্নীতির সংজ্ঞাঃ দু:+নীতি=দুর্নীতি। এ-হলো দুর্নীতির শাব্দিক বিশ্লেষণ। যা সু-নীতি নয়, তা-ই মূলতঃ দুর্নীতি। পারিভাষিক অর্থে দুর্নীতি হলো: অবৈধপন্থার ব্যবহার। অবৈধ পদ্ধতি কিংবা কৌশল অবলম্বন করে বিশেষ স্বার্থ উদ্ধার কিংবা অন্যের স্বার্থ-অধিকার হরণ। অথবা কোনো নাগরিক বা রাষ্ট্রের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে স্বেচ্চাচারিতার পরিচয় দিয়ে নাগরিক বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করা।

ইসলামের দৃষ্টিতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সুদ, ঘুষ, জুয়া তথা যেকোনো হারামপন্থা অবলম্বন, ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির ব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতারনা, আইনের অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও গোষ্টিগত স্বার্থ হাসিল এবং দেশ, জাতি ও সাধারণ নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ হরণ করাই দূর্নীতি। কুরআন ও হাদীসে এক কথায় সর্বপ্রকার দুর্নীতিকে অবৈধ বা বাতিল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

দূর্নীতি দমনে ইসলামের মূলনীতি বা মৌলিকপন্থা

মূলত: ইসলাম হলো ত্যাগ ও সংযমের ধর্ম। ভোগ-বিলাসের ইসলামে কোনো স্থান নেই। ইসলামে আখেরাতের জীবনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবনও নিরেট ভোগের জন্য নয়, বরং চিরস্থায়ী, চিরশান্তির পরকালীন জীবনের পাথেয় যোগাড় করার জন্যই এই পার্থিব জীবনের সময়টুকু বরাদ্দ করা হয়েছে।

এখানে স্রষ্টার বাতলানো নৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন নির্দেশনা তথা জৈবিক জীবন নির্বাহের পথনির্দেশ অনুসরণ করার মাঝেই সকল মানুষের উন্নতি, সফলতা ও নাজাত নিহিত। এই চেতনায়ই ইসলাম গড়ে তুলতে চায় প্রত্যেক মুমিনকে। ইসলাম বলে, এই ধুলির ধরা ক্ষণস্থায়ী, কেবল প্রয়োজন পুরণের জন্য। আর আখেরাত হলো সকল স্বাদ-আহলাদ পুরণের জন্য চিরস্থায়ী সুখউদ্যান, সুতরাং জাগতিক জীবন হালাল জীবিকার দ্বারা যত বেশি সংক্ষিপ্ত পরিসরে সংযমের সাথে যাপিত হবে। আখেরাতের জীবনে আসবে তত বেশি প্রশস্ততা।

এই মূলর্শনের আলো অকেই ইসলাম জাগতিক জীবনের সৌন্দর্য্য ও কলংকের মাপকাঠি নির্দ্ধারণ করেছে। নির্ধারণ করেছে পবিত্র ও হালাল জীবিকার মাপকাঠি, সেই সাথে নির্দিষ্ট করেছে হারাম জীবিকা তথা দুর্নীতি নিরুৎসাহিত (দমন) করার মূলনীতি বা রূপরেখা। সেই সব মূলনীতি বা মৌলিকপন্থাসমূহকে আমরা নিম্নরূপে উল্লেখ করতে পারি। যথা-

১.  মানব জাতি ও অন্যান্য সৃষ্টির পার্থক্য জ্ঞান জাগ্রত করা। ২. আল্লাহর ভয় বা আখেরাতের পরিনাম চিন্তা মানব মনে উজ্জ্বল করা। ৩. হালাল-হারাম বা পবিত্র-অপবিত্রের পার্থক্য সুস্পষ্ট করা। ৪. দুর্নীতি পরায়নতার দুনিয়াবী শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছতা ও কঠোর নিরপেক্ষতা ও জবাবদেহীতা আবশ্যকীয় করা। ৫. সততা ও তাকওয়ার জীবন যাপনের পুরস্কারের ঘোষণা প্রচার করা ও দূর্নীতির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা। ৬. কেবল আইন প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল না হয়ে সামাজিকভাবেও সময়-উপযোগি পন্থা অবলম্বণ করা।

(১) মানব জাতি এবং অন্যান্য মাখলূক যে সম-পর্যায়ের নয়, বরং মানুষকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ বিবেচনা শক্তি ও মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে বিষয় উল্লেখ করে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) নিশ্চয়ই আমি (বনি আদম) মানবজাতিকে সকল সৃষ্টির উপরে মর্যাদা দান এবং অন্যান্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সূরা বনী ইসরাঈল-৭০)।

(খ) তারা কি কুরআনে বর্ণিত বিষয়াদী নিয়ে চিন্তা ফিকির করে না! নাকি তাদের অন্তর (বিবেক) তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মদ-২৪)।

(গ) বহু সংখ্যক জ্বিন ও মানুষকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। যারা অন্তর থাকতেও তা দ্বারা সত্য-সুন্দরকে উপলব্ধি করে না, যাদের চোখ আছে অথচ তা দ্বারা সঠিক কিছু দেখেনা, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দ্বারা সত্য নির্দেশনা শুনতে পায়না। এ ধরণের জ্বিন ও ইনছান চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তার চেয়েও অধিক পথহারা। এরা প্রচন্ড উদাশীন। (সূরা আ’রাফ-১৭৯)।

(২) ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট হলো, অপরাধপ্রবনতা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করতে আল্লাহর ভয় বা আখেরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করা। এই ইহজগতই শেষ কথা নয়, এখানেও যাচ্ছেতা করে কোনোভাবেই পার পাওয়া যাবে না এখানে মানুষের চর্মচোখকে ফাকি দেয়া গেলেও আখেরাতে আল্লাহর দরবারে সবকর্মকান্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। সেখানে কোনো বিষয়ে অন্যায়, দুর্নীতি, অসদাচরণ ব্যক্তি বা জাতির হক আত্মসাৎ প্রমাণিত হলে তার যথাযথ জবাবদেহী করতে হবে এবং পরিনামে জাহান্নামের বীভৎস আজাবের সম্মুখিন হতে হবে। যা থেকে বাচার কোনো উপায় থাকবে না। এ প্রসংগে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) হে রাসূল! আপনি তাদেরকে (অপরাধীদেরকে) বলে দিন, আমার প্রতিপালক গোপন ও প্রকাশ্য অশ্লিলতা (অপরাধ) পাপাচার, দুর্নীতি, সীমালংঘন, খোদাদ্রোহীতা, ভিত্তিহীন মন্তব্য, অংশিবাদ হারাম করেছেন। প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে নির্দিষ্ট সময় কাল। সে নির্দিষ্টকাল এসে গেলে তোমরা তাকে মুহুর্তকাল বিলম্বিত বা তরান্বিত করতে সক্ষম হবে না। (সূরা আ’রাফ: ২২-২৩) (খ) আর যারা অপরাধে লিপ্ত হবে তাদের বাসস্থান হবে অগ্নিময় জাহান্নাম। জাহান্নামবাসীরা যখনই সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবে তখনি তাদের তাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে। তদুপরি তাদের বলা হবে: আস্বাদন করো সেই আগুনের শাস্তি যাকে তোমরা মিথ্যা বলে এড়িয়ে যেতে। (সূরা সেজদা-২৫) (গ) হে মূমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। আর আল্লাহর বিধানের প্রতি অনুগত না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)।

(ঘ) হে মানব জাতি! সেদিনকার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করো, যেদিন মানুষ তার আপন ভাইকে এড়িয়ে চলবে, জন্মদাত্রী মাকে ভুলে যাবে, পলায়ন করবে নিজ স্ত্রী এবং সন্তানকে রেখে। সেদিন প্রত্যেকেই থাকবে নিজ নিজ কর্মকান্ডের জবাবদেহিতার চিন্তায় বিভোর। সেদিন কিছু লোকের চেহারা হবে উজ্জ্বল আনন্দময়। আর কিছু সংখ্যক লোকের মুখম-ল হবে কালিমাময়। লাঞ্ছনা তাদের বেষ্টন করে নেবে। (সূরা আবাসা- ৩৩-৪৮)।

রাসূলে কারীম সা. ঘোষণা করেছেন: ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহিতা উভয়ই হবে জাহান্নামী। (তিরমিজী, আবূদাউদ)।

(ঙ) (হে সম্বোধিত ব্যক্তি) যখন তোমরা তিনজন গোপনে কিছু করো, তখন সেখানে উপস্থিত থাকেন চতুর্থ আরেকজন (আল্লাহ তা‘আলা)। যখন তোমরা পাঁচজন গোপনে শলা-পরামর্শ করো, সেখানে ষষ্টজন থাকেন। অথবা এর চেয়ে কম বা বেশি সংখ্যক, সব অবস্থায় তিনি তোমাদের সাথে থাকেন। অত:পর তিনি (আল্লাহ তা‘আলা) কিয়ামত দিবসে তোমাদের সেসব বিষয়ের ফয়সালা করবেন যা তোমরা করতে। (সূরা মুজাদালা-৬)

(চ) কোনো চোখ সেই মহান সত্তাকে (এই পৃথিবীতে) দেখতে পায় না, কিন্তু তিনি সকল চোখওয়ালাকে অবলোকন (পর্যবেক্ষণ) করেন। তিনি সর্বোচ্চ সুক্ষ্মদর্শী ও সবিশেষ অবহিত। (তাকে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই)।

(ছ) রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন: শুনে রাখো, যারা আল্লাহর মাল রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য এর বিনিময় হবে জাহান্নামের আগুন। (বুখারী শরীফ)।

(জ) তিনি আরো ইরশাদ করেছেন, কোনো মুসলিম শাসক যদি দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং ঐ অবস্থায় মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করবেন। জান্নাত হারাম করে দেবেন। (বুখারী, মুসলিম)।

(ঝ) রাসূল সা. প্রত্যেক দায়িত্বশীলের জবাবদেহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইরশাদ করেছেন: শোনো! তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেক দায়িত্বশীলকেই জিজ্ঞাসিত হতে হবে! (মুসলিম)।

(৩) দুর্নীতি দমন বা সর্বপ্রকার অপরাধ দমনের মূলনীতি হিসাবে ইসলাম হালাল হারাম তথা পবিত্র-অপবিত্র এর পার্থক্য সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছে। বৈধ এবং অবৈধ এর প্রভেদ পরিস্কার করেছে। যা স্রষ্টার দৃষ্টিতে পবিত্র তা হালাল ও বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আর যা অপবিত্র তা হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সাথে হালালের কল্যাণ ও উপকারিতা এবং হারামের অপকারিতা ও ক্ষতি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।

একথাও পরিস্কার করা হয়েছে যে, হারামের কোনো উপকারিতা বা উন্নতি বাহ্যত দৃষ্টিগোচর হলেও মূলতঃ তা ক্ষতিকর ও ধংসাত্মক। এর বিপরিতে কোনো কোনো হালালের বিধান কষ্টকর এবং বাহ্যত লোকসানজনক মনে হলেও তা স্থায়ী কল্যাণ, উন্নতি ও নাজাতের গ্যারান্টিবহ। এসব বিষয়ে কুরআনে কারীমে এবং হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) হে মূমিনগণ! তোমরা কেউ কারো ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে (বাতিল পন্থায়) গ্রাস করো না। তবে তোমরা পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করো তা বৈধ। আর তোমরা কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি দয়াবান। বস্তুতঃ তোমাদের মধ্যে কেউ সীমালংঘন কিংবা জুলুমের বশবর্তি হয়ে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ে প্রবৃত্ত হলে তাকে খুব শীঘ্রই আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ বিষয়। (সূরা আন নিছা- ২৯)।

(খ) আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসা বানিজ্যকে হালাল করেছেন। আর সুদ আদান প্রদানকে হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন। (সূরা আলে ইমরান- ২৭৫)।

(গ) আল্লাহ তা‘আলা পরিণামে সূদকে ধ্বংশ করে দেন আর আল্লাহর রাস্তার হালাল দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা দীনকে অস্বীকার কারী পাপাচারী ব্যক্তিকে অপছন্দ করেন। (সূরা আলে ইমরান- ২৭৬)।

(গ) হে মূমিনগণ! তোমরা পবিত্র জিনিষ থেকে পানাহার করো। যা আমি তোমাদেরকে রিযিক হিসাবে দান করেছি। আর আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্তিতে তার কৃতজ্ঞতা আদায় করো। যদি তোমরা কেবল তারই অনুগত হয়ে থাকো! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন মৃত জীব জানোয়ার, (যা জবাই করা অবস্থায় হালাল) প্রবাহমান রক্ত, শুকরের গোশত, এবং ঐসব কিছু যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। (সূরা বাকারা)।

(ঘ) হে মূমিনগণ! তোমরা আল্লাহর হালালকৃত জিনিষকে হারাম বানিওনা, আর আল্লাহর (নাফরমানীতে) সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সীমালংঘনকারীকে ভালোবাসেন না। (সূরা মায়িদা)।

(ঙ) রাসূলে কারীম (সা.) ঘোষণা করেছেন- সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীগণ কিয়ামতের ময়দানে নবী, সিদ্দীক এবং শহীদদের সঙ্গী হবে। এর বিপরীতে অসৎ ও ভেজালদানকারী ব্যবসায়ীরা অপরাধী ফাসেক হিসেবে আখেরাতে উত্থিত হবে এবং জবাবদেহীর সম্মুখিন হবে। (হাকিম, তিরমিযী)।

(চ) তোমাদের কারো জন্য ঐ সম্পদ হালাল নয় (বরং হারাম) যা মালিকের সন্তুষ্টি-সম্মতি ছাড়া নেয়া হয়েছে।

(ছ) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো এবং সুদের বাকী থেকে যাওয়া অংশ পরিত্যাগ করো। যদি তোমরা মূমিন হও। যারা আল্লাহর এই নির্দেশ (হারাম সুদ পরিত্যাগের আদেশ) বাস্তবায়ন করবে না, তারা আল্লাহ এবং তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। (সূরা আলে ইমরান- ২৭৮)।

(জ) হে মূমিনগণ! পৃথিবীতে তোমাদের জন্য যা পবিত্র এবং হালাল তা গ্রহণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক (হারাম পন্থার) অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। (সূরা বাকারা- ১৬৮)।

(ঝ) হে মূমিনগণ! তোমরা কেউ কারো ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করতে যেওনা। এবং জনগণের মালের অংশবিশেষ অসৎ উদ্দেশ্যে (জেনে শুনে) কোনো শাসকের হাতে তুলে দিও না। এরূপ করলে তোমরা অপরাধী হবে। (সূরা বাকারা- ১৮৮)।

(ঞ) নিশ্চয়ই যারা এতিম-অসহায়দের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে (আত্মসাৎ করে) গ্রাস করে, তারা মূলত: তাদের পেটে আগুন ভরে নেয়। খুব শীঘ্রই তারা পেট ভর্তি আগুন নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সূরা নিছা- ১০)।

(চ) সেইসব মুত্তাকীদের জন্য খুব শীঘ্র আমি (উত্তমজাযা দান করবো) রহমত দান করবো যারা যাকাত প্রদান করে, এবং আমার নির্দশনাবলী বিশ্বাস করে। যারা অনুগত হয় উম্মি নবীর, যার সম্পর্কে তাওরাত ও ইঞ্জীলে উল্লেখ রয়েছে। যিনি সৎকাজে নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিবৃত্ত করেন। আর যা কিছু পবিত্র তা তিনি হালাল বলে ঘোষণা দেন, এবং যা কিছু নোংরা-অপবিত্র তাকে তিনি হারাম বলে সাব্যস্ত করেন। (সূরা আরাফ- ১৫৭-১৫৮)।

(ছ) হে মূমিনগণ, নিশ্চয়ই মাদকদ্রব্য, জুয়া, মুর্তিপূজার বেদী, লটারীর শর ইত্যাদি নাপাক, ঘৃন্য বস্তু এবং শয়তানী কাজ। এসব তোমারদের জন্য হারাম। সুতরাং তোমরা এসব পরিহার কর। শয়তান এসব কূকর্ম দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায়। তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। তোমরা এসব থেকে নিবৃত্ত থাকো। (সূরা মায়িদা- ৯০-৯১)।

(৪) দুর্নীতি দমনে আল্লাহর ভয়, আখেরাতের শাস্তি সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি ইসলাম দুনিয়াবী শাস্তি প্রদানে স্বচ্ছ আইন এবং তা বিলম্বহীন ও নিরপেক্ষভাবে কার্যকর করার বিধান প্রণয়ন করেছে। না; ইসলাম কোনো দুর্নীতিবাজ কিংবা খুনী ও অপরাধীর শাস্তি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রাখেনি। যাতে অপরাধীরা এই সুযোগে বেচে যেতে সক্ষম না হয়। দূর্নীতি তথা, চুরি, ডাকাতী, আত্মসাত প্রমাণিত হলেই পক্ষপাতহীনভাবে তার শাস্তি কার্যকর করার আদেশ দিয়েছে ইসলাম। চুরি, ডাকাতি, ফিৎনাফ্যাসাদের শাস্তি প্রসংগে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) পুরুষ চোর অথবা মহিলা চোরের চুরি করা প্রমাণিত হলেই তাদের হাত (কব্জি পর্যন্ত) কেটে দাও। এ হলো তাদের কৃতকর্মের শাস্তি। আর আল্লাহ তাআলা সর্বোচ্চ পরাক্রমশালী।

(খ) রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমার কন্যা ফাতেমা চুরি করলেও আমি তার হাত কেটে দিতে দিধা করব না।

(গ) ইরশাদে বারী তাআলা: নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, (ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরন করে), অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের শাস্তি হলো, কতল করা, শুলিতে চড়ানো, অথবা তাদের হাত ও পা (একটি অপরটির বিপরীত হিসেবে) কেটে দেয়া। অথবা তাদেরকে এলাকা থেকে নির্বাসিত করা। এ হলো তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ও লাঞ্ছনা। এ ছাড়া আখেরাতে রয়েছে তাদের জন্য মহা শাস্তি।

(গ) হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী মাদক দ্রব্যের সেবন প্রমানিত হলে তার শাস্তি হলো ৮০ দোররা মারা। (হাদীস)।

(ঘ) ব্যভিচার, ব্যভিচারের অপবাদ ইত্যাদির শাস্তি অবস্থা ভেদে ভিন্ন রকম হলেও প্রমানিত হওয়ার পর তার শাস্তি যথাযথভাবে কার্যকর করার বিধান দিয়েছে ইসলাম।

যেমন কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ব্যভিচারী মহিলা এবং ব্যভিচারী পুরুষ যদি তারা অবিবাহিত হয় এবং চারজন চাক্ষুষ দর্শক পুরুষের সাক্ষি দ্বারা ব্যভিচার প্রমাণিত হয় তবে তাদের এই অপকর্মের শাস্তি হলো ১০০ দোররা। আর যদি তারা বিবাহিত হয় তবে তাদের পাথর মেরে হত্যা করা হবে। (সূরা নূর- ২, ইবনে কাসীর)।

এর বিপরীতে কেউ কারো প্রতি ব্যাভিচারের অপবাদ দিয়ে যথাযথ সাক্ষী প্রমান উপস্থিত করতে না পারলে তাকে ৮০ দোররা মারা হবে এবং সে পরবর্তিতে সাক্ষ্য দেয়ার অযোগ্য বলে প্রমাণিত হবে। ইরশাদ হয়েছে, যারা কোনো সৎ পুরুষ বা সতী সাধ্বি নারীদের ব্যভিচারের অপবাদ দেয় অতঃপর চারজন পুরুষ সাক্ষি উপস্থিত করতে পারে না, তাদের ৮০ দোররা মারো। অত:পর কখনও তাদের সাক্ষ গ্রহণ করবে না। (নূর- ৪)।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- যে প্রতারনার (ধোকার) আশ্রয় নেয় সে আমার উম্মত নয়। (তারজন্য) মুসলিম বিচারক যথানিয়মে শাস্তির ব্যবস্থা করবে। উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা ইসলামের জাগতিক শাস্তির বিধান প্রমানিত হয়। যা দুর্নীতি ও অপবাদ দমনের অন্যতম মূলনীতি।

(৫) সততা ও হালাল জীবন যাপনের ইহকালীন ও পরকালীন পুরস্কারের ঘোষণার মাধ্যমেও ইসলাম দুর্নীতি দমনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব বিষয়ে ইতিপূর্বে যেসব কুরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে তা এখানেও প্রযোজ্য। এ প্রসংগে আরো প্রমাণ হলো- কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সৎ আমল করে (অসৎ কর্মকা- থেকে বেচে থাকে) তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম পুরস্কার।

(খ) যারা গভীর বিশ্বাসের সাথে বলে, আমাদের প্রতিপালক হলেন একমাত্র আল্লাহ, অত:পর এই বিশ্বাস অনুযায়ী আমলে সুদৃঢ় থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং দুনিয়া আখেরাতে তারা হবে না চিন্তাগ্রস্থ। (সূরা আহকাফ- ১৩)

(গ) রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, হারাম মাল দ্বারা যে শরীর গঠিত হয়, তা জাহান্নামে জ্বলবে।

(৬) নাগরিক সচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেও দূর্নীতি দমনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসলাম। যেমন হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-

(ক) তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় (পাপাচার দুর্নীতি) হতে দেখে সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দ্বারা রুখে দেয়। তা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দ্বারা তা প্রতিহত করে। আর তাও না পারলে সে যেন ঐ অপকর্মকে হৃদয় দ্বারা ঘৃণা করে। (আবূ দাউদ, তারগীব)।

(খ) কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিৎ, যারা মানুষকে কল্যানের দিকে ধাবিত করবে (সততার প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে)। সৎকাজে প্রবৃত্ত করবে, এবং অসৎ কাজ থেকে নিবৃত্ত করবে। আর এরাই হলো সফলকাম মুমিন। (সূরা আলে ইমরান- ১০৪)।

(গ) তোমরা কল্যাণ-কাজে এবং খোদাভীরুতার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করো। কিন্তু পাপকাজ এবং সীমালংঘনমূলক অপকর্মে কেউ কারো সহযোগিতা করবে না। (সূরা মায়িদা- ২)।

(ঘ) কপট বিশ্বাসী পাপাচারী নর ও নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তারাই কেবল একে অপরকে অন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং ন্যায় ও কল্যাণ কাজে বাধা সৃষ্টি করে। নিশ্চয়ই এরা পাপাচারী অপরাধী। (সূরা তাওবাহ- ৬৭)।

(ঙ) লোকমান আ. তার পূত্রকে বললেন, বৎস হে! তুমি নামাজ কায়েম কর। সৎকাজে আদেশ করো এবং অসৎ অপরাধমূলক কাজে বাধা দাও। নিশ্চয়ই এ হলো সাহসিকতার পরিচয়। (সূরা লোকমান)

উপসংহার-

এ পর্যন্ত উল্লেখ করা নাতিদীর্ঘ আলোচনার উপসংহারে এসে যে বিষয়টি বিশেষভাবে তুলে ধরা জরুরী মনে করছি তা হলো আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের দুর্নীতি কী করে বন্ধ হবে? অথবা বাংলাদেশ কেন দুর্নীতিমুক্ত হচ্ছে না? দুর্নীতিমুক্ত হবার পথ ও পন্থা কী? এর খুব সংক্ষেপ জবাব হলো, পক্ষপাতমুক্ত আইনের শাসন, এবং ন্যায় বিচারের প্রচন্ড অভাব এই দেশটাকে দুর্নীতিমুক্ত হতে দিচ্ছে না। আমাদের এই দেশে সঠিক সাক্ষদানকারী নিরাপদ নয়। যারা আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রন করবেন তারাই আইন ভংগকারী।

তারা প্রচুর সংখ্যায় দূর্নীতি, হত্যা, ঘুষ বানিজ্য, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, ইত্যাদির সাথে সম্পৃক্ত। বিচার ব্যবস্থা প্রশ্নাতীত স্বাধীন নয়, দুর্নীতি দমনে মুক্ত বিচার ব্যবস্থা কার্যকর করা তথা বিলম্বহীনভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ন্যায়ানুগ বিচার কার্যকর করা এখানে জটিলতা মুক্ত নয়। মানবরচিত তথা মান্ধাতা আমলের বৃটিশ আইন এখনও ধরে রাখা বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিক হতে দিচ্ছে না। এই সব কিছুর সমাধান দিয়েছে ইসলাম: ইরশাদ হয়েছে: “আল্লাহ তাআলা তোমোদের নির্দেশ দিচ্ছেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে, সকলের সাথে সদাচারণ করতে। আত্মীয় স্বজনের অধিকার প্রদান করতে। আর তিনি তোমাদের নিষেধ করেছেন অশ্লীলতা প্রদর্শন, অসৎকার্য, এবং সীমালংঘন করতে। তোমরা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করো। (সূরা নাহল- ৯০-৯১)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “হে মূমিনগণ ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এবং সত্য সাক্ষ্য প্রদানে তোমরা অবিচল থাকবে। যদিও সে সাক্ষ্য তোমার নিজের বিরুদ্ধে যায়, অথবা তোমার পিতা-মাতা এবং আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। হে মূমিনগণ, কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমারদেরকে সুবিচার বর্জন করতে প্ররোচিত না করে! বরং সর্বাবস্থায় তোমরা ন্যায় বিচার করবে। এই ন্যায় বিচার অধিক খোদাভীরুতার পরিচায়ক। (সূরা- নিছা ও সূরা মায়িদা)

সত্যিই, দূর্নীতি মুক্ত দেশ গড়তে ইসলাম নির্দেশিত দিক দর্শন ও পন্থার কোনো বিকল্প নেই। এখন প্রশ্ন একটাই, আমরা সে পথে হাটবো কি?

লেখকঃ বিশিষ্ট আলেমে-দ্বীন, গ্রন্থকার, সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, সম্পাদক- কাফেলা সাহিত্য মজলিশ, উপদেষ্টা সম্পাদক- মাসিক আল-জান্নাত।