Home ওপিনিয়ন শূন্য বিবেক নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ: কোনটাই উপকারী নয়

শূন্য বিবেক নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ: কোনটাই উপকারী নয়

।। কাজী হামদুল্লাহ ।।

সময়টা যখন আবেগের, তখন বিবেকের বলপ্রয়োগ করতে কষ্টটা একটু বেশিই হয়। এই কষ্ট হতে পারে দু’দিক থেকে। প্রথমত মানুষ আবেগে অন্ধ হয়ে বিবেকের বক্তাকে হেনস্থার চেষ্টা করে। তার পেছনে বাঁশ দেয়া শুরু করে। অপরদিকে নিজের আবেগও বিবেকের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই অধিকাংশ মানুষ এ সময় বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে দেয় নীরবে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেগুলো বলতে গেলে হয়তো আমাকেও বাঁশ দেয়ার চেষ্টা করবে অতিউৎসাহী আবেগপ্রবণ মানুষগুলো।

আবেগ থাকতে নেই, তা আমি বলছি না। আবেগ ছাড়া কিছুই হবে না। আবেগ না থাকলে আজকের পৃথিবী এতো উন্নত হতো না। বিজ্ঞানের এতো এতো আবিষ্কার আমরা পেতাম না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে আবিষ্কারকের আবেগ ৮০% ভূমিকা রেখেছে।

বিমান আবিষ্কার করেছিলেন উইলবার রাইট এবং অরভিল রাইট। তাঁরা দু’ভাই ছিলেন। বাবার কিনে দেয়া খেলনা দেখে তাঁদের ভেতরের আবেগ তাঁদেরকে আকাশে ওড়ার প্রেরণা যোগায়। তাঁরা স্বপ্ন দেখতে থাকে, ‘আমরা আকাশে উড়বো’।

বর্তমানে আকাশে ওড়াটা স্বাভাবিক বিষয় হলেও উনিশ শতকের আগে তা ছিলো কল্পনাতীত। ১৮৬৭ এবং ১৮৭১ খৃস্টাব্দে জন্ম নেয়া এ দু’ভাইয়ের কিশোর আবেগ থেকেই মূলত বিমানের আবিষ্কার। কিন্তু তাঁদের জীবন ঘাঁটতে গেলে পাওয়া যায় বিবেকের প্রতি অকৃত্রিম এবং উপমাহীন শ্রদ্ধা। কারণ ইতিহাস বলে যে, উইলবার রাইট আর অরভিল রাইটের আকাশে ওড়ার ইচ্ছে জেগেছিলো ছোটবেলায়, যখন তাঁদের খেলার বয়স। বাবা তাঁদেরকে আকাশে ভেসে বেড়ানোর কাল্পনিক ধারণা থেকে তৎকালীন সময়ের তৈরি একটা খেলনা কিনে দেন। আবেগভরা মনে তখন কী যে ইচ্ছে ছিলো সেরকম একটা যন্ত্র বানিয়ে সেটা নিয়ে আকাশে ওড়ার! কিন্তু সম্ভব হয়নি।

এরপর তাঁদের জীবন থেকে চলে গেছে দীর্ঘ একটা সময়। ততোদিনে অনেক রকমের কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তথ্য বলে যে, তাঁরা যতো কাজেই জড়িয়েছিলো, সব ছিলো আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা অর্জনের জন্য। প্রিন্টিং ব্যবসা, পত্রিকা প্রকাশ ও বাইসাইকেলের কারখানাসহ অনেক কিছুই তাঁরা করেছিলেন। সর্বশেষ সাইকেল কারখানায় তাঁরা আর্থিক সফলতা পেতে শুরু করেন। এর মধ্যে একটা পর্যায়ে দু’ভাই শুরু করেন ছোটবেলার আবেগতাড়িত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাধনায়। ফলে সর্বশেষ ১৯০৮ সালে অত্যন্ত সফলতার সাথে তাঁরা আকাশে বিমান ওড়াতে সক্ষম হন।

বিমান আবিষ্কারের ইতিহাস শোনানো আমার উদ্দেশ্য নয়। বলছিলাম, আবেগের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে বিবেকের ঘাড় ভেঙে আবেগ কখনও সফলতা পায় না। তাঁরা দু’ভাই যদি ছোটবেলা থেকেই বিমান তৈরিতে লেগে যেতো, আর্থিক স্বচ্ছলতার দিকে না তাকাতো, তাহলে হয়তো পৃথিবীতে বিমানের আবিষ্কার হতো কিনা, সন্দেহ। হলেও পৃথিবী পিছিয়ে থাকতো আরো অনেকগুলো বছর। আধুনিক যোগাযোগের স্বর্ণযুগ থেকে মানুষ পিছিয়ে পড়তো আরও কিছুদিন। আবেগ থাকবে এবং আবেগ লাগবে। তবে তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে বিবেকের হাতে। আবেগ আশ্রিত বিবেক নয়, বরং বিবেক নিয়ন্ত্রিত আবেগের মহাশক্তিতেই পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু কেন যে আমরা সে কথা ভুলে যাই বারবার! বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমরা নিজেদেরকে আবেগাশ্রিত মানুষ বলেই প্রমাণ করছি প্রতিনিয়ত। কেউ একজন লিখেছে, ‘জাফর ইকবাল স্যার অসুস্থ’। আমরা সেটাকে প্রচার করেছি, ‘জাফর ইকবাল স্যার গুরুতর অসু্স্থ’। এটা কোন কথা হলো! হয়তো বেচারার সর্দি লেগেছে, অথবা সামান্য জ্বর এসেছে, সেটাকে আবেগের বশে ‘গুরুতর অসু্স্থ’ লেখার কোন মানে হয়?

গত রোযায় দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা আহমদ শফী সাহেব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। কীভাবে যেন একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো যে, তিনি মারা গেছেন। হাজার হাজার মানুষ সেটা নিজ দায়িত্বে অন্যের কাছে পৌঁছাতে নেমে পড়লেন। বিশেষ করে আশ্চর্য হবার মতো বিষয় হলো, তাঁর একান্ত অনুসারীদেরও অনেকে ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে পোস্ট করেছিলো। এতো আবেগ আমাদের!

সম্প্রতি একটি ঘটনার প্রেক্ষিতেই মূলত আজকেই এই কথাগুলো বলা। কয়েকদিন আগে সিলেটে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপরে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। আটরশি পীরের মুরিদরা এ হামলা করে। তাতে একজন নিহতসহ আহত হয় অনেকেই। নিহত মুযযাম্মিল নামের মাদরাসা-ছাত্রের ব্যাপারে ‘নিহত’ নয় বরং ‘শহীদ’ শব্দই আমরা ব্যবহার করবো। কেন; সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে অতিরঞ্জন করে আমরা কী কারণে বলবো যে তিনজন শহীদ হয়েছেন?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে, ‘জৈন্তাপুরের ঘটনায় তিনজন শহীদ’। আরও অবাক করা বিষয় হলো, তিনজনের ছবিও জুড়ে দেয়া হয়েছে সেসব পোস্টে। কী আবেগ আমাদের! কতো কাণ্ডজ্ঞানহীন আমরা! অথচ পরেরদিনই বেরিয়ে এলো ভিন্ন কথা, অন্য তথ্য। আগের দিন শহীদ হওয়া (?) একজনের কাছ থেকে সরেজমিন তথ্যসংগ্রহের ভিডিওও দেখতে হয়েছে আমাদেরকে। এই হলো আমাদের আবেগের অবস্থা। আমরা এভাবেই বিবেককে জবাই করে আবেগে উদ্বেলিত হচ্ছি একের পর এক। কেন, বিবেক খাঁটিয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করাটা কী তাজিংডংয়ে আরোহনের মতো কিছু ছিলো? নাকি এ তথ্যের জন্য সিন্ধু জয় করা লাগতো?

কিচ্ছু না, শুধু একটু বিবেকের প্রয়োজন ছিলো। আবেগটাকে বিবেকের দ্বারস্থ করা দরকার ছিলো। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যে শর্তগুলো ছিলো, সাহাবায়ে কেরামের আবেগ তা মানতেই পারছিলো না। তাঁরা বারবার সন্ধি প্রত্যাখ্যানের কথা বলছিলেন রাসূল (সা.)কে। বিবেকের শ্রেষ্ঠ আদালত আমাদের নবীজি সা. তখন শান্তভাবে আবেগকে পাশকাটিয়ে সন্ধি করে নিলেন। বিবেক-পরিচালিত সিদ্ধান্তের ফলাফল তাৎক্ষণিক পাওয়া না গেলেও মক্কা বিজয়ের পর তা স্পষ্ট হয়েছে। ইতিহাস লেখা হয়েছে বিবেকের এই নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা নিয়ে।

এখন সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আমাদের হাতে; আবেগ না বিবেক। নাকি উভয়ের সমন্বয়ে সমৃদ্ধি পাবে পৃথিবী, সুন্দর-সুগঠিত হবে দেশ-জাতি এবং দেশের সর্বস্তরের জনতা।

লেখকঃ শিক্ষানবিশ- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসা।