Home শীর্ষ সংবাদ ৬ এপ্রিলের লং মার্চ: চেতনা জাগানিয়া ইতিহাস!

৬ এপ্রিলের লং মার্চ: চেতনা জাগানিয়া ইতিহাস!

।। তারেকুল ইসলাম ।।

বিগত ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিলে শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে শাপলা চত্বরমুখী এক লং মার্চের সফল আয়োজন করেছিল হেফাজতে ইসলাম। এই লং মার্চ ছিল ইসলামবিরোধী আপত্তিকর ব্লগিং-এর বিরুদ্ধে এবং যেসব ইসলামবিদ্বেষী মুক্তমনা ব্লগাররা আল্লাহ, ইসলাম ও রাসূল স.-এর শানে জঘন্য অশ্লীল ভাষায় কটূক্তি ও বিষোদ্গার করেছিল, তাদের বিচারের দাবিতে। লাখ লাখ রাসূলপ্রেমিক তৌহিদি জনতা সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

আজকে সেইদিনের কথা স্মরণ করলে আমাদের মতো ইসলামপ্রিয় ও রাসূলপ্রেমিকদের মন আবারো বিপ্লবী হয়ে ওঠে। রাসূলের শান-মান-মর্যাদা রক্ষায় লং মার্চের মতো আরো একশ’টি ইতিহাস রচনা করার তীব্র ইচ্ছা জাগে। আবারো গণজোয়ারের তোড়ে ইসলামবিদ্বেষী বাতিল-নাস্তিক-মুরতাদদের খোদাদ্রোহী অহংকার, দম্ভ ও মিথ্যাচার ভাসিয়ে বিলীন করে দেওয়ার হিম্মত গর্জে ওঠে অন্তরে।

সেদিন হেফাজতে ইসলাম প্রমাণ করে দিয়েছিল, প্রকৃত রাসূলপ্রেমিক কারা। এবং কারা রাসূলের মান-মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে আপসহীনভাবে আত্মনিবেদিত।

একইসাথে হেফাজত জনগণের শত্রুদেরও চিনিয়ে দিয়েছিল। ইসলামের শত্রুদেরও চিনিয়েছিল, যারা কিনা সেকুলারিজম ও প্রগতিশীলতার মুখোশধারী নিপাট ইসলামবিদ্বেষী তাগুত-শয়তান। হেফাজতের আবির্ভাবের ফলে আজ এরা বাংলাদেশের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতার প্রকাশ্য শত্রুতে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত ধর্মপ্রাণ জনগণ বুঝে গেছে আজকের এই শত্রু-মিত্রের রাজনৈতিক মেরুকরণ।

নিঃসন্দেহে এই শত্রু-মিত্রের প্রভেদজ্ঞান বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরামকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা করবে। কারণ দূরদর্শী রাজনৈতিক কর্মপন্থা প্রণয়নের পূর্বশর্তই হলো, সর্বাগ্রে রাজনৈতিক ও আদর্শিক শত্রু-মিত্র নির্ধারণ।

হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জামায়াতে ইসলামী ধরনের প্রচলিত ধারার ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নয়। আমরা সবাই জানি, জনপ্রিয় এই সংগঠনের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই এবং এটি নির্বাচন ও ক্ষমতামুখী রাজনীতি চর্চায় নিজেকে জড়াবে না। তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চায় ইচ্ছুক নয়। আবার লাগামহীন অবাধ রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষায় পাল্টা গণক্ষমতা তৈরিতেও ভূমিকা রাখে হেফাজত।

উত্থানপর্ব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দলটি বাংলাদেশের জনগণের ঈমান-আক্বিদা সংরক্ষণের স্বার্থে এবং ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধে কার্যকর আন্দোলনমুখী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আদর্শিক ও সাংগঠনিক জায়গায় এগুলোই হচ্ছে হেফাজতের মৌলিক কর্মসূচী ও অবস্থান।

৫ মে’র শহিদি চেতনা এখনো হেফাজত ক্বলবে লালন করে। রাসূলের অপমানের বিচারের দাবিতে বুকে ও রক্তে ঈমানের আগুন জ্বালিয়ে এবং রাষ্ট্রশক্তির জিঘাংসা ও রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে ইতিহাসের স্মরণকালের বৃহৎ গণ-আন্দোলনে রাজপথ কাঁপানোর অমর কাব্যিক নাম হেফাজতে ইসলাম। শুধু রাসূলের অপমান সইতে পারেনি বলে হেফাজতের অসংখ্য কর্মী ও সমর্থক রাস্তায় বুক পেতে পুলিশের নিষ্ঠুর গুলিতে আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে, শহিদ হয়েছে।

হেফাজত ঘুমিয়ে নেই, যদিও ঘুমন্ত সিংহের ধারেকাছে যেতেও ভয় লাগে! সময়ের তাগিদ পূরণ করেছিল হেফাজত। ইসলামবিদ্বেষী ও ফ্যাসিবাদের কারখানা শাহবাগ মুভমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল হেফাজতের পাল্টা গণ-আন্দোলন। শাহবাগ আজ ইতিহাসের বাতিল আবর্জনা। পরিত্যক্ত কসাইখানা। সম্প্রতি জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনয়নের মতো ইস্যুতে হেফাজতের কাছে শাহবাগী চেতনাধারীরা বেদম পরাজিত হয়েছে, এই পরাজয়ের হতাশা তারা নিজেরাই প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছে। কে বলেছে হেফাজত ঘুমিয়েছে?

হেফাজতের জুলুমবিরোধী গণলড়াইয়ের চেতনা আজও বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় প্রতিটি তরুণের রক্তে ও মর্মে বিপ্লবের ডঙ্কা-নিনাদ তোলে।  মজলুম যতই প্রান্তিক হোক, যতই অসহায় হোক, একবার যদি মজলুমরা সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ায়, তবে কট্টর ফ্যাসিবাদী ও অবাধ ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রশক্তিও যে চরম আতঙ্কিত ও অসহায় বোধ করে, তা আবারো প্রমাণ করেছিল হেফাজত।

সিংহ ঘুমিয়েছে, এমনটি ভাবলে নিশ্চয়ই ভুল হবে। মনে রাখুন, ঘুমন্ত সিংহের তপ্ত প্রশ্বাসের বাতাসে তার সামনের ধুলোবালিও উড়ে সরে যায়।

বিগত ২০১৩ সালেই দেশব্যাপী চেতনার বাতিঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল হেফাজত, আর চূড়ান্ত ইতিহাস গড়ার দায়িত্ব দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সমগ্র উলামায়ে কেরাম, ইসলামপন্থী ও বৃহত্তর তৌহিদি জনতার। তাদের সবার সম্মিলিত লড়াই-ই পারে আজকের বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ ও দুঃশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে, মজলুমের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে এবং সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটির পুনঃস্থাপন করতে।

লেখক- রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকার কলামিস্ট।