Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘দ্বীনি দায়িত্ব পালনে কি কি প্রতিবন্ধকতা আসে এবং উত্তরণের উপায়’

‘দ্বীনি দায়িত্ব পালনে কি কি প্রতিবন্ধকতা আসে এবং উত্তরণের উপায়’

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী: গত ১৮ জিলহজ ১৪৪১ হিজরি, রোববার সকাল ৯টায় জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী’র সভাপতিত্বে মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

করোনা পরিস্থিতির কারণে ঈদুল আযহার পর দরস আরম্ভ করা সম্ভব না হলেও মাদরাসায় উস্তাদগণের উপস্থিতি এবং যে অল্প সংখ্যক ছাত্র ক্যাম্পাসে ছিল, তাদেরকে তালিম-তরবিয়ত আওতায় আনার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। এতে শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা ও হিদায়াতী বয়ান রাখেন।

বয়ানে তিনি মূলত: তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন- (১) দ্বীনী দায়িত্ব পালনে কী কী প্রতিবন্ধকতা আসে এবং তা থেকে মুক্তির উপায় কী। (২) নিজেকে গড়ি । নিজে না গড়ে ছাত্র গড়া সম্ভব হয় না। (৩) ইলমে নাফের জন্য চারটি ছিফত দরকার। এই ছিফত আমরা শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে তৈরি করি।

বৈঠকে উপস্থিত হয়ে আল্লামা কাসেমী প্রথমে আসাতেযায়ে কেরামের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস পর মাদরাসার একজন প্রিয় উস্তাদের প্রথম সাক্ষাৎ পেয়ে খাসভাবে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এরপর বলেন, দায়িত্ব আদায়ের জন্য জিম্মাদারির গুরুত্ব উপলব্ধি করা জরুরি। খোঁজখবর নেওয়ারও অনেক গুরুত্ব। এই এহসাস না থাকার কারণে দীর্ঘ সময়ে একবারও সাক্ষাতের প্রয়োজন মনে করেননি, ফোনেও খোঁজখবর জানাননি। এটা প্রতিষ্ঠানিক সম্পর্কের বিষয়ে দায়িত্ববোধহীনতার লক্ষণ। এরপর হযরত দিক-নির্দেশনা ও হিদায়াতী বয়ান শুরু করেন।

বয়ানের শুরুতে হামদ-সানা’র পর তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা নবী আলাইহিস সালামকে জিম্মাদারির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইরশাদ করেন-

يَاأَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ

দ্বীনী দায়িত্ব পালনে দুটি বাঁধা আসে। এক- লোভ লালসা। দুই- জুলুম-সিতাম। দ্বীনের দুশমনেরা প্রথমে লোভ-লালসার টোপ দেয়। এতে কাজ না হলে মামলা-হামলা, গুম-খুন ইত্যাদির পথ বেছে নেয়। এভাবে দ্বীনী কাজ করতে গিয়ে মুমিনকে শহীদও হতে হয়। দাওয়াতের কাজে নবী আলাইহিস সালামকেও লোভ-লালসার টোপ দেওয়া হয়েছিলো। জুলুম করা হয়েছিলো। এমনকি হত্যারও চেষ্টা করেছিলো। এই জন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ

তেমনি দ্বীনের কাজ করার জন্য আল্লাহ পাকের সত্ত্বার উপর উঁচু পর্যায়ের তাওয়াক্কুল-ভরসা ও মাইয়্যতে এলাহী থাকতে হয়। অন্তরে দৃঢ়ভাবে এই মানসিকতা পোষণ করতে হবে যে, “পুরো দুনিয়া আমার বিরুদ্ধে চলে যাক, কিচ্ছু আসে যায় না, যদি আমার মাওলা আমার সাথে থাকে। মাওলা পাকের হুকুম আমার সাথে থাকে। মাওলা যদি খুশি থাকে”।

আরও পড়তে পারেন-

এই ধরণের মজবুত একীন থাকতে হয়। এই ধরণের তাআল্লুক মাআল্লাহ থাকতে হয়।
মুসা আলাইহিস সালাম কওমকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে। পিছনে তাকিয়ে দেখলেন- ফেরাউনের বাহিনী ধেয়ে আসছে। নিরুপায় অবস্থা। ভীষণ ভয়াবহ ব্যাপার। লোকজন বলতে লাগলো,
إِنَّا لَمُدْرَكُونَ

আজ আর নিস্তার নেই। আমরা নিশ্চিত ধরা পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু ঐ মহাবিপদেও মুসা আলাইহিস সালামের ঈমান, আল্লাহর উপর ভরসা ও আল্লাহর ওয়াদার উপর একীন কী পরিমাণ ছিলো তা কোরআনে হাকীমে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেছেন এই ভাবে-
كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي অর্থাৎ- অসম্ভব! আমার সাথে আমার মাওলা আছেন।

একে বলে মাইয়্যতে এলাহী। এটা ছিলো মুসা আলাইহিস সালামের বড় পুঁজি। গারে সওরে কাফেরদের পা দেখা যাচ্ছে। আবু বকর (রাযি.) বিচলিত হয়ে পড়লেন। কী উপায়! কী উপায়!

لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

হাদীসে এসেছে, নবী আলাইহিস সালাম বলেন- ما ظنك باثنين الله ثالثهما

আলমে ইসলামীতে আজ এর বড় অভাব। অর্থ-সম্পদের অভাব নেই। পৃথিবীর মূল ভূখণ্ড মুসলমানদের হাতে। সম্পদে ভরপুর আমাদের পদতল। কিন্তু আমরা আমাদের সম্পদ উদ্ধার করতে পারছি না। উল্টো মার খাচ্ছি। কিন্তু কেন? এর বড় কারণ, আমাদের ভিতর ঈমানের ঘাটতি, তাওয়াক্কুলের ঘাটতি, একিনের ঘাটতি। তাকওয়ার ঘাটতি। আমাদের নামাযের ঠিক নেই। ইবাদতে মন নেই। কোরআন-সুন্নাহর উপর একিন নেই।

আমাদের মার খাওয়া মূল কারণ, গায়রুল্লাহর কাছে ঝুঁকে পড়া। কেউ আমেরিকার দিকে, কেউ রাশিয়া, কেউ ফ্রান্স, কেউ চীন, আর কেউ ভারত। কিন্তু আল্লাহর দিকে, কোরআন সুন্নাহ’র দিকে, নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকে আসছি না। আল্লাহর সাহায্য আসবে ঈমানের উপর, একিনের উপর, তাওয়াক্কুলে উপর। এগুলো সামনে রেখে আমরা যদি দ্বীনী-দুনিয়াবি কাজ করি, তবে আমাদের বিজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ।

(১) وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا

(২) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

সবচে বড় শক্তি আল্লাহ তাআলার জাত-সত্ত্বার উপর ভরসার শক্তি। এটা থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভয় দূর হয়ে যাবে। তাই আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের দেখানো পথই সমাধানের পথ। মুসলিম বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান ইনাবাত ইলাল্লাহ। মুসলমানি বহাল রেখে অন্য পথে আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান আসতে পারে না। অন্য পথ ধরলে আমাদের মুসলমানিও নিরাপদ থাকবে না, সমাধানও আসবে না।

সুতরাং, আমরা মাইয়্যতে এলাহীর শক্তি অর্জনের চেষ্টা করি। নিজেকে গড়ি। নিজে গড়া ছাড়া ছাত্র গড়া সম্ভব নয়। নিজে গড়লে ছাত্ররা আপনাকে দেখেই শিখবে। তেমন কোনো বয়ান-বক্তৃতার দরকার হবে না। আমরা নামাজ ঠিক করি। আমার নামাজে গাফলত থাকলে ছাত্রের নামাজ কখনো ঠিক হবে না। আমার ভিতর মোতালা ও কুতুববীনির অভ্যাস না থাকলে ছাত্রদের দিয়ে আমিও মোতালা করাতে পারবো না। গল্পগুজবে সময় নষ্ট না করে কিতাবভিত্তিক ও ফনভিত্তিক মোতালায় মনোযোগী হই। সকল সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহ পাকের দিকে রুজু করি।

মুফতি মাহমুদ গাঙ্গুহী (রাহ.) বলতেন, কল্যাণাকর ইলমের জন্য চারটি গুণ থাকা জরুরী।
(এক) ফাহমে সহীহ তথা সঠিক বুঝশক্তি। যথার্থ বোঝার যোগ্যতা। ত্রুটিপূর্ণ বুঝ বা উল্টা বুঝ সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে থাকে। মেধা কম হলে যেমন ইলমে নাফের কাংক্ষিত স্তরে পোঁছা যায় না, তেমনি উল্টা বুঝ, বক্রমেযাজ, উলটা বুঝ, এটাই ইলমে নাফে তথা কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনে অনেক বড় বাধা তৈরি করে।

পবিত্র কুরআনে হাকীমে এসেছে-

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

যাদের অন্তরে বক্রস্বভাব রয়ে গেছে, তারা কাজ ফাহমি ও বক্রস্বভাব দূর করার জন্য আকলে সালীমের অধিকারী আকাবির ও আসলাফের সোহবত, তাদের সীরাত, মালফূজাত ও রাসায়েল অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ‘আপবীতি’ অনন্য গ্রন্থ। সবাই নিজের খরচে ‘আপবীতি’ সংগ্রহ করে নিয়মিত অধ্যায়ন করুন।

(দুই) ইলমে নাফে হাসিলের জন্য দ্বিতীয়ত: দরকার ‘একিনে মোহকাম’। অর্থাৎ কোরআন-সুন্নাহ এবং আল্লাহ তাআলার ওয়াদা ও হুঁশিয়ারীর এর উপর পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে। এই আসমানি ইলমের প্রতি অগাধ আযমত ও বিশ্বাস দিলে বদ্ধমূল থাকতে হবে। এই ইলমই যে মানুষের দুনিয়া-আখেরাতের কামিয়াবি, সফলতা-সম্মান ও সমস্যা সমাধানের মূল হাতিয়ার, এই একিন অন্তরে গেঁথে নিতে হবে।

(তিন) ইলমে নাফে হাসিলের জন্য তৃতীয়ত দরকার আযমে কওয়ি। দৃঢ় সংকল্প। আমাকে শিখতে হবে, জাতির দায়িত্বভার নিতে হবে, নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, আমাকে পারতে হবে, ইলম আমল আখলাকে পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। এই সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা অন্তরে থাকতে হবে।

(চার) ইলমে নাফে হাসিলের জন্য চতুর্থত দরকার মোজাহাদায়ে কাহেরা। শরির-নফস ও শাহওয়াতের চাহিদাকে পরাস্ত ও দলিতমথিত করে নিরবিচ্ছিন মেহনত মোজাহাদায় নিয়োজিত হতে হবে।

অনুলিখনে- মাওলানা হাবীবুর রহমান কাসেমী

মুহাদ্দিস ও নায়েবে নাযেমে তালিমাত- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।