Home ফিকহ ও মাসায়েল সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি ইসলামের গুরুত্ব

সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি ইসলামের গুরুত্ব

।। মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন ।।

বহমানকাল থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীর বুকে যত ধর্মের গোড়াপত্তন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো যত ধর্মের আবির্ভাব হবে তার মধ্যে ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোন্নত এবং সর্বাধিক মানবতাপরায়ণ ও জীবনঘনিষ্ঠ ধর্ম। জীবন ও জগতের খুঁটিনাটি হতে বৃহৎসব বিষয়ের যাবতীয় নিয়মাবলি ও দিকনির্দেশনা এবং সুষ্ঠু সমাধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দিয়েছে ইসলাম।
ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা সামাজিকভাবে ধর্ম-বর্ণ, জাত-গোত্র এবং শ্রেণী-স্তর নির্বিশেষে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে কিভাবে জীবনাযাপন করবে এবং তাদের প্রতি কী আচরণ ও উচ্চারণ প্রদর্শন করবে সে নিয়ে ইসলাম অভূতপূর্ব নির্দেশনা ও আদর্শ উপস্থাপন করেছে। ইসলামে সহাবস্থান ও পারস্পরিক সহিষ্ণুতার শিক্ষা অনুপম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও কালোত্তীর্ণ এবং আপন মহিমায় চিরভাস্বর। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি ও সদ্ব্যবহার এবং মানবতাপূর্ণ উদারপ্রকৃতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে ইসলামের যে অপূর্বশিক্ষা রয়েছে তার দৃষ্টান্ত অন্য কোনো ধর্মে অনুপস্থিত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়ত পরবর্তী জীবনে এ আদর্শের প্রজ্বল নমুনা উপস্থাপন করে গেছেন। তাঁর সুমহান জীবনচরিত ছিল উদারতা-মহানুভবতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, বহুধাবিভক্ত মতাদর্শী ও বহু গোত্র ও শ্রেণীর মাঝে সমঝোতা ও সহষ্ণিুতা সৃষ্টির সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তদরূপ অমুসলিমদের সাথে মেলামেশা-লেনদেন ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রেও তাঁর অবস্থান ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মার্গে। ঐতিহাসিক ‘মদিনা-সনদ’ ইসলামের পরম উদারনীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
অমুসলিমদের সাথে সদাচরণ ও উত্তম ব্যবহারের নির্র্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়ন করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ ও নিষ্ঠাপূর্ণ ব্যবহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ নিষ্ঠাবানদের পছন্দ করেন।’ (সূরা মুমতাহিনা : ৮) কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘আহলে কিতাবদের (অন্যান্য আসমানিধর্মের অনুসারী) সাথে তোমরা কেবল উত্তমভাবে বাদানুবাদ করো।’ (সূরা আনকাবুত : ৪৬)
অন্যান্য ধর্মানুসারীদেরকে কষ্ট দেয়া দূরের কথা গালমন্দ করতেও নিষেধ করেছে কঠোরভাবে ইসলাম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘যারা আল্লাহ বিনে অন্যের উপাসনা করে, তাদের তোমরা অশ্রাব্য কথা বলিও না। যাতে তারা ধৃষ্টতাভাবাপন্ন হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে মন্দ বলে বসে।’ (সূরা আনআম : ১০৮)
মুসলিমসমাজে বসবাসরত অমুসলিমরা যেন নিজেদের সম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে পারে এবং তাদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রু ও স্থাবর-অস্থাবর সব কিছু নিরাপদ থাকে সে ব্যবস্থা ও নিশ্চয়তা ইসলাম পূর্ণাঙ্গভাবে দিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা হচ্ছে- আমানতস্বরূপ।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে তার স্বাধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে তাকে কষ্ট দেয় এবং বলপ্রয়োগ করে তার কোনো কিছু নিয়ে ফেলে, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’
শুধু নিজস্ব চিন্তাধারার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে পাশাপাশি অন্যান্য বুদ্ধিমান ও বিবেকসম্পন্ন জ্ঞানী লোক থেকে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা অর্জন ও তার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং ধৈর্যের সাথে তা শ্রবণ করা এটিও ইসলামের শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু কর্ম-উদাহরণ রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘জ্ঞান-প্রজ্ঞা হলো মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানে পাবে সেখান থেকেই তা লুফে নেবে।’ (তিরমিজি)
পৃথিবীর যেকোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য উত্তম সহাবস্থান এবং পরম সহিষ্ণুতার অনুশীলন ও চর্চা অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে তা সহজে স্পষ্ট হয়ে আসে। আপন জন্মভূমি মক্কাবাসীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও নির্যাতন-অবিচার চরম পর্যায়ে পৌঁছলেও তিনি কিছুতেই অসহিষ্ণুতা কিংবা প্রতিশোধ প্রবণতা দেখাননি। হিজরতের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ও তায়িফ বিজয়ের সময় যে অতুলনীয় ক্ষমার মহৎ আদর্শ স্থাপন করেছেন, তা মানব ইতিহাসে সম্পূর্ণ বিরল। তাঁর আকাশসম উদারতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপম দৃষ্টিভঙ্গি, পারস্পরিক সমঝোতা-সহমর্মিতা ও নিঃস্বার্থ ক্ষমা-মার্জনা এবং সহষ্ণিুতার সুমহান চরিত্র বিশ্ববাসীর দিকনির্দেশনা হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে এবং নিষ্ঠাবান মানবতাবাদীদের আলোর পথ দেখাবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বতোরূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোত্র ও দলমত নির্বিশেষে মানুষের ধর্মীয়-স্বাধীনতা নিশ্চিত করে তাদের আপন চিন্তাধারা ও মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ প্রদান করেছিলেন। কারণ, ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাই ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকা অপরিহার্য ও অত্যাবশক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম মানুষের মতামত প্রকাশের ও প্রচারের অধিকার সংরক্ষণ করেছে অত্যন্ত যতœ ও নিষ্ঠার সাথে। ন্যায়সঙ্গত ও গঠনমূলকভাবে যেকোনো অনৈতিকতা এবং অন্যায়ের সমালোচনা করার সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু শরিয়তবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী অথবা মানবতাবিরোধী কোনো মত প্রকাশ করা সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ, শরিয়তে মানবতা কিংবা নৈতিকতাবিরোধী কোনো কিছুর স্থান রাখেনি ইসলাম। ইসলামের ইতিহাসে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের সহাবস্থান ছিল। উদারতা ও সহিষ্ণুতার কারণেই ইসলাম তাদের সম্মান ও আত্মমর্যাদার সাথে অবস্থানের সুযোগ দিয়েছে।
আজকের প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের আলোকে সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক প্রীতি-শ্রদ্ধাবোধ ও সহানুভূতি-সহিষ্ণুতার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে, তাহলে সামগ্রিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা, সাম্য-মৈত্রী ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি এবং প্রভূত কল্যাণের ফল্গুধারা বয়ে যাবে। #