Home গল্প-উপন্যাস গল্প: “সিয়ামের কান্না”

গল্প: “সিয়ামের কান্না”

সিয়ামের কান্না
গল্প: সিয়ামের কান্না

।। কাজী হামদুল্লাহ্ ।।

প্রচণ্ড কুয়াশায় চারদিক সাদা হয়ে আছে। দুই হাত দূরের কিছুও দেখা যায় না, পরিস্থিতি এমন। এরই মধ্যে হঠাৎ ঝুপ করে পানিতে কি যেন একটা আওয়াজ হলো। চকিতে ফিরে পাড়ের দিকে একটু এগিয়ে গেলো সে।

প্রথম দেখাতেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কী ভয়ানক ব্যাপার! এতোটুকু ছেলে! এই ভোর সকালে পানিতে কেন?

বরফ-শীতল নাফ-নদীর পানি থেকে উঠে এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। তবুও কাঁপুনীর জন্য কথাই বলতে পারছে না ছেলেটি। কে সে, কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কী নাম; এসব জানতে মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে ছমির ভাইয়ের। ছেলেটিকে দেখতে মনে হচ্ছে দশ-বারো বছর বয়স হবে। কিন্তু এই এলাকায় তাকে কেউ কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।

বাহিরে কাজ সেরে বেলা ১২টায় বাড়ি ফেরে ছমির ভাই। দেখে ছোট্ট নিষ্পাপ মুখটি আরামের বিছানায় লুটিয়ে আছে। আলতো করে পিঠে হাত রাখতেই চমকে ওঠে ছেলেটি! হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে এক অজানা কারণে। চিৎকার করে ডাকতে থাকে আম্মু,  ছোট আপু ও শফিক ভাইয়া নামে কাউকে। আব্বু-আপু আর ভাইয়াকে ডেকে ওঠে বুকের সকল শক্তি দিয়ে। এরই মধ্যে চট করে লাফিয়ে নামতে চায় বিছানা থেকে। কিন্তু ছমির ভাইয়ের বাহুতে আটকা পড়ে ব্যর্থ হয়। চিৎকার শুনে ছুটে আসে এই ছোট্ট বাড়িতে ছমির ভাইয়ের একমাত্র সঙ্গী তার স্ত্রী। দু’জন মিলে প্রায় আঘ ঘণ্টার চেষ্টায় তাকে থামাতে সক্ষম হয়। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে তার পরিচয় ও প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ।

দশ বছরের ছোট্ট শিশুটির উপর ঘটে যাওয়া নির্মম ট্রাজেডির কথাগুলো শুনে অজান্তেই দু’জনের চোখে অশ্রু চলে আসে। নিজেদের সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

তার নাম সিয়াম। বাড়ি আরাকানের একটি ছোট্ট গ্রামে। গত চার দিন আগে বৌদ্ধরা তাদের গ্রামে হঠাৎ হামলা করে। যাকে যেখানে পায়, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা শুরু করে। ছোট-বড়, শিশু-বৃদ্ধ; কোন বাছবিচার করে না তারা। যুবতীদেরকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে। এরপর জবাই করে তাদের স্তন কেটে নিয়ে তামাশা করে। সারাদিনই এভাবে রক্ত-লাশের খেলা চলে। এলাকার কোন শ্রেণীর মানুষই তাদের এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায় না। ওর বড় বোনকেও বাড়ির উঠানে ধর্ষণের পর স্তন কেটে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িতে বাবা আর বড় ভাইয়া ছিলো। চোখের সামনে আপনজনের এমন দুঃসহনীয় কিয়ামত তারা মানতে পারেননি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শয়তানদের উপর প্রতিবাদের ক্রোধে। জীবনের শেষ শক্তি পর্যন্ত প্রতিবাদের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ না, অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে তারাও লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। বাড়ির উঠানটি তখন মুসলমানের তাজা খুনে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। বাড়িওয়ালা স্বয়ং নিজের উঠানে পড়ে থাকেন বেওয়ারিশের মতো।

আম্মু, তারা দুইভাই আর বোনসহ গিয়েছিলো পাশের গ্রামে নানুবাড়িতে। সেখানে থাকায় রক্ষা হলেও তারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের সব চে’ আপন এবং প্রিয় মানুষগুলোকে। হারিয়েছে তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রাণের ভিটা-বাড়িটাও। তাই রাতের আঁধারেই তারা পা বাড়ায় অজানার পথে। দুইদিন সাগরে ভেসে ভেসে তারা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মরতে মরতেই তারা বেঁচে ছিলো। সামনে নির্ঘাত মৃত্যুর হাতছানী দেখে তড়পাতে থাকে তাদের মা। স্বামী এবং দুই সন্তানের শাহাদাতের পরে ছোট তিনটি সন্তানকে হারানোর অজানা আতঙ্ক কাজ করছিলো তার মনে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তে আসার সাহস পাচ্ছিলো না।

তৃতীয় দিন আর ধৈর্য ধরতে পারে না তাদের মা। ছোট নৌকাটি নিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে নাফ নদীর বাংলাদেশ তীরে চলে আসে। মায়ামমতার হাজারো চুমু এঁকে দেয় সন্তানদের কপালে। পুরোপুরি মালিকের হাওয়ালা করে নামিয়ে দেয় সন্তানদের। ভিন্ন ভিন্ন দু’টি স্থানে সিয়াম আর তার বোনকে নামিয়ে দেয়। সামনে অন্য কোথাও নামাবে তার ভাইকেও। আশা শুধু এতোটুকুই যে, হয়তো এই মুসলিম দেশের কেউ না কেউ তার ছোট ছোট বাচ্চাদের একটু আশ্রয় দেবে। মায়ের কোল খালি হলেও যেন পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেঁচে থাকে কলিজার টুকরা সন্তানগুলো, এটাই আশা।

দীর্ঘ ইতিবৃত্তের এই সারাংশ বলে আবারও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সিয়াম। সে জানতে চায়, তার ভাইবোনরা কোথায় আছে। বেঁচে আছে, না শাহাদাতের কোলে লুটিয়ে পড়েছে? তার মা আদৌ কি কোথাও আশ্রয় পাবে, না অসভ্যতার পদদলনে ক্ষত-বিক্ষত হবে? নাকি তার মৃতদেহটি নিয়ে অকুল দরিয়ায় ভাসতে থাকবে ছোট্ট ভাঙা নৌকাটি?

[ এই বিভাগে লেখা পাঠানোর জন্য editor@ummah24.com ইমেইল ব্যবহার করুন ]