Home ইসলাম মু’মিন জীবনে তাওবার গুরুত্ব অপরিসীম

মু’মিন জীবনে তাওবার গুরুত্ব অপরিসীম

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে জ্ঞান ও বাকশক্তি সম্পন্ন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অধিকারী মানবগোষ্ঠীর সংখ্যা সাতশত কোটিরও ঊর্ধ্বে। এই মানব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী এবং গোত্রে বিভক্ত। স্থান ও কালের ভিন্নতায় বিচিত্র সব মন-মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠে এর প্রতিটি সদস্য।

এ বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই যে একত্ববাদে বিশ্বাসী নয়- তা সর্বজন বিদিত। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে একত্ববাদে বিশ্বাসী তাওহীদপন্থী জনতার সংখ্যা প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটির উপরে। এ বিশাল মুসলিম জনতার প্রতিটি সদস্যই যে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন নামায আদায়ে যত্নবান নয়, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আবার যারা নিয়মিত সালাত আদায় করে থাকেন তাদের প্রত্যেকেই যে পরহেযগার, বেগুনাহ্ নয়- তাও জোর দিয়ে বলা যায়। প্রতিটি মুসলমানের প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ থেকে নিয়ে নিদ্রা গমন পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জানা-অজানায় কবীরা ও সগীরা গুনাহ্ কিভাবে যেন সংঘটিত হয়েই যায়। এ ফিতনা-ফাসাদের যামানায় শত চেষ্টা করেও যেন পাপমুক্ত থাকা যাচ্ছে না, পাপ হয়েই যাচ্ছে।

বলা বাহুল্য, পাপ হয়ে যাচ্ছে বলেই কি করে যেতে হবে? গুনাহ্ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার, নাজাত পাওয়ার কোন পন্থা কি আমাদেরকে অবলম্বন করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে। কারণ, পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- হে রাসূল! আপনি বলুন (আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন) হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা (গুনাহ্ ও অপরাধ করে) নিজ নফসের উপর অত্যাচার-অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহ্ তাআলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তাআলা তোমাদের সমস্ত গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু। (সূরা যুমার- ৫৩ আয়াত)।

আল্লাহ্ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন, হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্ তাআলার কাছে তাওবা কর, তাওবায়ে নাসূহা অর্থাৎ খালেস তাওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। (সূরা তাহরীম- ২৮ আয়াত)।

আর এ তাওবা সম্পর্কে হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- প্রতিটি আদম সন্তান কম বেশী পাপাচারে লিপ্ত হয়। তাদের মাঝে উত্তম সেই যে অনুতপ্ত হয়, তাওবা করে। (মিশকাত- ১/২০৪ পৃষ্ঠা)।

অন্য হাদীসে আছে, হযরত আলী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা মুহাব্বত করেন ঐ সব মু’মিন বান্দাদেরকে যারা গুনাহ্ করে কিন্তু সাথে সাথে তাওবা করে। (মিশকাত- ১/২০৫ পৃষ্ঠা)।

অন্য আরেক হাদীসে আছে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহর শপথ, আমি প্রতিদিন সত্তর বারেরও অধিক তাওবা করে থাকি এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। (মিশ্কাত- ১/২০৩ পৃষ্ঠা)।

হযরত ইব্নে ইয়াসার মুযালী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর এবং গুনাহ্ মাফ চাও। আমি এক দিনে একশত বার ইস্তিগফার করে থাকি। (মিশকাত- ১/২০৩ পৃষ্ঠা)।

উপরোক্ত হাদীস ও আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, প্রতিটি আদম সন্তান কম বেশী গুনাহ্ করে থাকে। তাই বলে পাপকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আবার অতীতে অসংখ্য গুনাহ্ হয়ে গেছে বলে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হলেও চলবে না। গুনাহ্ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে, আর তার একমাত্র পথ হচ্ছে, তাওবা অর্থাৎ কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত, দুঃখিত ও অনুতপ্ত হওয়া। অন্তরে অনুশোচনা সৃষ্টির মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার নামই তাওবা। কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে গুনাহ্ মাফ হওয়ার ও আযাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে তাওবার গুরুত্ব অপরিসীম। উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক গুনাহ্ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব।

আর খাঁটি তাওবার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে যা নিম্নে উল্লেখ করা হল-

* সকল গুনাহ্ থেকে তাওবা করতে হবে।

* তাওবা করার ব্যাপারে সকল প্রকার সন্দেহ-সংকোচ ও ইতস্ততঃভাব থেকে মুক্ত হতে হবে।

* তাওবা বহাল রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে।

আর এ তাওবা সম্পর্কে হযরত সানাউল্লাহ্ পানিপথী (রাহ্.) তাফ্সীরে মাযহারীতে লিখেন, হযরত আলী (রাযি.)কে প্রশ্ন করা হল, তাওবা কি? তিনি উত্তরে বললেন- ছয়টি বিষয়ের সমাবেশের নামই তাওবা।

(১) অতীতের মন্দ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

(২) যে সব ফরয ওয়াজিব কর্ম তরক করা হয়েছে, সেগুলোর ক্বাযা করে নেওয়া।

(৩) কারো ধন-সম্পদ ইত্যাদি অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে থাকলে তা প্রত্যার্পণ করা।

(৪) কাউকে হাতে অথবা মুখে কষ্ট দিয়ে থাকলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।

(৫) ভবিষ্যতে সেই গুনাহের কাছেও না যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।

(৬) এবং নিজেকে যেমন আল্লাহর নাফরমানী করতে দেখেছিল তেমনি আল্লাহর আনুগত্য করতে দেখা। (বাংলা মাআরিফুল কুরআন- ৫৬২ পৃষ্ঠা)।

আর তাওবার জন্য একটি দোয়া হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যাকে “সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার” বলা হয় সেটি নিুরূপ।

হযরত শাদ্দাদ ইব্নে আউস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হল- “আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানী ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু আঊযুবিকা মিন শাররি মা-সানা’তু আবূউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা ওয়া আবূউ বিযাম্বী ফাগফির লী ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয্ যুনূবা ইল্লা আন্তা।” (মিশকাত- ২০৪ পৃষ্ঠা)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে দিবসে এই কালিমা পাঠ করবে অতঃপর সে দিন সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বে মৃত্যু বরণ করে, সে ব্যক্তি বেহেশ্তী হবে। অনুরূপ যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে রাত্রে এই কালিমাসমহ পাঠ করবে অতঃপর প্রত্যুষের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করে, তাহলে বেহেশ্তী হবে।

আর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মা’সূম-নিষ্পাপ, তিনি যখন (মর্যাদা বৃদ্ধির আশায়) দৈনিক একশত বার তাওবা করতেন, তখন আমাদের মত পাপিদের দৈনিক কত বার তাওবা করা দরকার তা সহজে অনুমেয়।

অন্য আরেক হাদীসে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- তোমাদের পূর্ববর্তী কালে একটি লোক নিরানব্বই জন লোককে হত্যা করে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের সন্ধান করলে তাকে একজন সংসার ত্যাগী দরবেশের কথা বলা হল। সে ঐ দরবেশ ব্যক্তির নিকট গমন করে বল্ল যে, আমার তাওবার কোন উপায় আছে কি? উত্তর দিল নেই। তখন সে ঐ দরবেশকেও হত্যা করে একশত পূর্ণ করল। তারপর অন্য এক শ্রেষ্ঠ আলেমের নিকট গিয়ে বল্ল যে, আমি একশত লোককে হত্যা করেছি, এখন আমার তাওবার কোন উপায় আছে কি?

উত্তর দিল, হ্যাঁ আছে। তুমি অমুক জায়গায় চলে যাও। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক আছে তারা আল্লাহর ইবাদত করছে। তুমি তাদের সাথে গিয়ে ইবাদত কর। লোকটি নির্দিষ্ট জায়গার দিকে চলতে থাকল। অর্ধেক পথ চলার পর সে মৃত্যুমুখে পতিত হল। সে তার সিনাকে ঐ গ্রামের দিকে এগিয়ে দিল এখন তার রূহ্ কোথায় নেওয়া হবে এ নিয়ে রহ্মত এবং আযাবের ফেরেশ্তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিল।

অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা সেই নির্দিষ্ট ভূমির উদ্দেশ্যে ওহী প্রেরণ করলেন, তুমি ঐ ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে যাও এবং পশ্চাতভূমিকে বল্লেন, তুমি ঐ ব্যক্তি থেকে দূরবর্তী হয়ে যাও। অতঃপর দেখা গেল, ঐ নির্দিষ্ট ভূমি ঐ ব্যক্তির নিকটবর্তী হয়ে গেছে। তারপর রহ্মতের ফেরেশ্তারা ঐ ব্যক্তির রূহ্ নিয়ে গেল। আল্লাহ্ তার সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দিলেন। (মিশকাত- ১/২০৩ পৃষ্ঠা)।

পবিত্র কুরআন-হাদীসের আলোকে উক্ত আলোচনায় আমরা বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ্ তাওবাকারীর উপর কতটুকু খুশী হন এবং গুনাহ্সমহ কীভাবে মাফ করে দেন। আল্লাহ বান্দার উপর কত মেহেরবান। তার বান্দার গুনাহ্ মাফ করার জন্য শুধু উসীলা তালাশ করেন। ক্ষমাপ্রার্থী বান্দাকে ক্ষমা করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত গুনাহ্ হোক বা না হোক সর্বদাই আল্লাহর দরবারে তাওবা করতে থাকা। তবেই আমরা আল্লাহর অফূরন্ত রহমত প্রাপ্ত হব।

লেখকঃ মুহাদ্দিস জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী এবং অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ মেইল- muftijakir9822@gmail.com