Home ইসলাম মাহে মুহাররাম: করণীয় ও বর্জনীয়

মাহে মুহাররাম: করণীয় ও বর্জনীয়

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

মাহে মুহাররাম আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত মাস:আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ করেন , অর্থ-“নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তায়ালার কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে থেকে চারটি মাস সম্মানিত , এটাই প্রতিষ্ঠত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন জুলুম করো না।” (সূরা-তাওবা, আয়াত-৩৬)।

উল্লিখিত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে , আরবী মাসের গঠন পদ্ধতি এবং তার নাম করণ এটা কোন মানুষের আবিষ্কৃত নয়, বরং তা সমগ্র জাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আসমান-জমীন সৃষ্টির সময়ই তা নির্ধারণ করেছিলেন। আর তাই তো, শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ সব আহকাম- রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে এই চন্দ্র মাস অর্থাৎ আরবী মাসের উপর করেছেন নির্ভরশীল।

মাহে মুহাররাম বরকতময় এবং সম্মানিত মাস: এই মাস সম্মানিত এবং ফযিলতপূর্ণ মাস যেমনটি তার অভিধানিক অর্থ দ্বারাই বুঝা যায়। কেননা তার অর্থ হল সম্মানিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এজন্যই তো ইসলামের পূর্বে অর্থাৎ আইয়ামে জাহেলিয়াতে এবং সপ্তম হিজরী পর্যন্ত এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নিষিদ্ধ।

যেমনটি উপরোক্ত আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। হযরত মুফতি শফি রা.“منہااربعۃحرم” -এর তাফসীরে উল্যেখ করেন যে, অর্থাৎ ঐ বার মাসের মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত আর তার সম্মান দুটি কারনে, এক- উক্ত মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ, দুই- উক্ত মাস বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এই মাসে ইবাদতের ছাওয়াব বেশি পাওয়া যায়। তন্মধ্যে প্রথম হুকুম তো রহিত হয়ে গেছে কিন্তু দ্বিতীয় হুকুম অর্থাৎ তার তাৎপর্য এবং এ মাসে ইবাদতের গুরুত্ত এখনও বহাল রয়েছে।

এই চার মাসের মধ্যে মুহাররাম হল অন্যতম । আরবী হিজরী সনের প্রথম মাস হল মুহাররাম। এ মাসের তাৎপর্য ও গুরুত্ত শুধুমাত্র শরিয়াতে মুহাম্মাদি সাঃ -এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং পূর্বেকার সমস্ত আম্বিয়া আঃ এর শরিয়তেও এ মাসের গুরুত্ত ও তাৎপর্য ছিল বিদ্ধমান। তার মধ্যে ইবাদতের ছাওয়াবও বেশি হত এবং গুনাহের শাস্তিও হত বেশি এবং এ মাসের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহও ছিল নিষিদ্ধ।

এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮)।

অন্য এক হাদিছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন ,‘ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরায় যেরুপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (সহীহ বুখারী ১/২১৮)।

সৃষ্টির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাসের নাম হল মুহাররাম । যে মাসে মহান আল্লাহ তায়ালা তার কুদরত প্রকাশ করেছেন এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা এই মাসে সংঘঠিত করেছেন। ইসলামী ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ মাস হল মুহাররাম।

একটি ভুলের নিরসন

অনেকে মনে করে এই মাসের ফযীলত এ জন্য যে, হযরত হুসাইন রা. এই মাসে শাহাদাত বরণ করেন। এটা নিছক অজ্ঞতা ও মূর্খতা । কেননা এই মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ইসলামের আগেও ছিল । বরং ইসলামের আগে তার হুরমাত বেশি ছিল কেননা তখন এই মাসে মারামারি , শিকার ইত্যাদি নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু সপ্তম হিজরীর পর তা রহিত হয়ে গেছে।

আশুরার ফযীলত ও ইতিহাস:মাহে মুহাররামের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরার দিন। এই দিনের নাম করণের ব্যাপারে একাধিক মতামত থাকলেও উল্যেখযোগ্য হল যে, তা “عشر”মূলধাতু থেকে নির্গত যার অর্থ হল দশ। সুতরাং আশুরার অর্থ হল দশম। মুহাররাম মাসের মধ্যে আশুরার দিন হল সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ । এই দিনে রোযা রাখার ফযীলত মুহাররামের অন্য দিনের থেকে অনেক বেশি। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-‘ আমি আশাবাদি যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলীম- ১/৩৬৭)।

এক হাদিসে এসেছে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘আশুরার দিনে পূর্বেকার নবীগণ আ. রোযা রাখতেন সুতরাং তোমরাও এ দিনে রোযা রাখ।’ (মুসাননাফে ইবনে আবি শায়বা)।

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে হযরত আলি রা. কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল যে, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন ? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও , তবে মুহাররাম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিযী- ১/১৫৭)।

তবে রোযা রাখার ক্ষেত্রে শুধু ১০ তারিখের রোযা রাখা মাকরুহ। যেমনটি ফেকাহ শাস্ত্রের কিতাব সমূহের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই তার সাথে আগে বা পরে আরেকটি রোযা মিলিয়ে রাখা চাই অর্থাৎ ৯,১০,১১ অথবা ৯,১০ বা ১০,১১তারিখের রোযা রাখা। এ সম্পর্কে হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে, আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ- ১/২৪১)।

উক্ত হাদিস দ্বারা একটি কথা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে মুসলমানের প্রতিটি বিষয় যেন কাফির, মুশরিক, বিধর্মীদের থেকে পৃথক হয় তাদের সাদৃশ্য যেন না হয় এমনকি এবাদতের মধ্যেও। কিন্তু আফসোস! আজ মুসলমান বিধর্মীদের অনুকরণ ও সাদৃশ্যের মধ্যে নিজেদের উন্নতি ও অগ্রগতি খুজে বেড়ায়।

তবে যদি কেউ কোন সমস্যার কারণে শুধুমাত্র ১০ তারিখের রোযা রাখে তাহলে তাও রাখতে পারবে। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমীরি রা. এবং আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রা. আশুরার রোযা সম্পর্কে বলেন, আশুরার রোযার তিন অবস্থা – আফজাল , মাফজোল, আদনা। অর্থাৎ ৯,১০,১১ এই তিন দিন রোযা রাখা আফজাল (সবচেয়ে ভাল) আর ৯,১০ অথবা ১০,১১ তারিখে রোযা রাখা মাফজোল (মধ্যম অবস্থা) আর সবার নিচের অবস্থা হল শুধুমাত্র ১০ তারিখের রোযা রাখা।

এ দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘঠিত করেছেন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন, বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন। (সহীহ বুখারী ১/৪৮১)।

তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে অনেক ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকে। যেমন, এ দিন আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন,এ দিন আল্লাহ তায়ালা লাওহ ও কলম সৃষ্টি করেছেন, এ দিন হযরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, হযরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন , হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস আ. কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয় ইত্যাদি । এসব কথার কোন ভিত্তি নেই ।

ওয়াসআতে রিযিকের মাসআলা:

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে ‘ যে ব্যাক্তি আশুরার দিন নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য সচ্ছলতার (ভাল খাবারের) ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তায়ালা সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।’ অনেক হাদিস বিষারদগণ হাদিসটি জাল বললেও বেশীরভাগ ইমামগণ বলেছেন যে, হাদিসটি জাল নয় যদিও কিনা তা যয়ীফ। সুতরাং কিছু শর্তের সাথে উহার উপর আমল করা যাবে । শর্ত হল- এটাকে এবাদত মনে করে করা যাবে না এবং সেটাকে জরুরী ও আবশ্যকীয় মনে করে করা যাবে না এবং কেও না করলে তাকে গাল-মন্দ করা যাবে না।

শাহাদাতে হুসাইন (রাযি.):

এ দিনে আরেকটি ঘটনা যা বিশেষ ভাবে উল্যেখযোগ্য আর তা হল, শাহাদাতে হুসাইন রা.। নিঃসন্দেহে তা ইতিহাসের নির্মম ও খুবই হৃদয়বিদারক এক করুণ অধ্যায়। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু শাহাদাতে হুসাইন রা. কে উপলক্ষ বানিয়ে বর্তমানে যে সমস্ত বেদআত ও কুপ্রথা সমাজে বিশেষভাবে শিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে মরণব্যাধি রুপে বিস্তার লাভ করেছে তা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। শোক প্রকাশার্থে শরির রক্তাক্ত করা, তাজিয়া ইত্যাদি ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়। হাদিস শরিফে স্পষ্টভাবে উল্যেখ আছে যে, ‘নিশ্চয় চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, হৃদয় ব্যথিত হয় তবে আমরা মুখে এমন কিছু বলিনা যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়। ’ অন্য এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,‘ তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায় কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’

মুহাররাম একটি সম্মানিত মাস, ইবাদতের মাস, বরকতের মাস । এটি কোন অভিশপ্ত বা মানহুস মাস নয় যেমনটি শিয়ারা মনে করে থাকে যার কারনে তারা এ মাসে বিবাহ-শাদি ইত্যাদি কোন খুশির কাজ করে না । ইসলামে এর কোন ভিত্তিই নেই। কারণ যে মাসকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত করেছে তা কিভাবে অভিশপ্ত হতে পারে ? সুতরাং যারা আল্লাহ তায়ালার মনোনিত মাসকে অভিশপ্ত বলে বাস্তবে তারাই হল অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত।

পরিশেষে বলতে চাই, মাহে মুহাররাম অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মাস, ইবাদত ও গাম্ভীর্যতার মাস,কল্যাণ ও মঙ্গলের মাস । সমস্ত বেদআত ও কুসংস্কার থেকে পবিত্র হয়ে ইবাদতে অগ্রগামী হওয়ার মাস । মুহাররাম ও আশুরা আমাদের জন্য এই বার্তা বয়ে আনে যে, আল্লাহর ইবাদতে অন্যের চেয়ে অগ্রগামী হওয়া চাই এবং আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে সদা-সর্বদা জান-মালের কোরবানী দিতে প্রস্তুত থাকা চাই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সর্ব প্রকার শিরিক্, বেদআত ও কুসংস্কার থেকে বেচে থাকার এবং সুন্নাত মুতাবেক যিন্দেগী গড়ার তাওফিক দান করুক। আমীন।

– মুফতি জসীমুদ্দীন, মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির এবং সহযোগী পরিচালক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।