Home ধর্মীয় প্রশ্ন-উত্তর মসজিদে হালকায়ে যিকির প্রসঙ্গে শরীয়তের বিধান কি?

মসজিদে হালকায়ে যিকির প্রসঙ্গে শরীয়তের বিধান কি?

প্রশ্ন: উচ্চঃস্বরে যিকর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। একটি মাসিক পত্রিকায় দেখতে পেলাম, মসজিদে হালকায়ে যিকর জায়েয। এর স্বপক্ষে একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে যে, “এমনভাবে যিকর কর যেন লোকে পাগল বলে”। এর ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত জানতে আগ্রহী।

– মুহাম্মদ শাহ নেওয়াজ, কলেজ রোড, শেরপুর।

উত্তর: শরীয়তের বিধান মতে যিকর করা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু এ ইবাদত যথাযথভাবে শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে পালন করতে হবে। আর সেই সীমারেখা হল, যে স্থানে উচ্চঃস্বরে যিকর করার নির্দেশ রয়েছে তথায় উচ্চঃস্বরে যিকর করা (যেমন আযান, ইক্বামত ইত্যাদি), যেখানে নিম্নস্বরে যিকর করার নির্দেশ রয়েছে সেখানে নিম্নস্বরে যিকর করা। এ ব্যাপারে যদিও পরবর্তী যুগের ফুক্বাহায়ে কিরামের মধ্যে ইব্নে হায্ম, ইমাম শা’রানী এবং কিছু সংখ্যক সুফিয়ায়ে কেরাম উচ্চঃস্বরে যিকর করাকে পছন্দ করেছেন কিন্তু শরীয়তের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, যিকর এবং দোয়া নিম্নস্বরে করাই উত্তম।

এ ব্যাপারে চার ইমামের ঐক্যমত ঘোষিত হয়েছে। কাজেই যে ব্যাপারে ইমাম চতুষ্ঠয়ের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতার দাবী রাখে। তবে এই যিকর মসজিদ বা অন্য কোন স্থানে একাকী বা হালকায়ে যিকরের মাধ্যমে উচ্চঃস্বরে জায়েয কি-না, তা জানার আগে যিকর করার পদ্ধতি ও তার হুকুম সম্পর্কে আমাদের জানা আবশ্যক।

স্বাভাবিকভাবে যিকর করার তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। যথা- (১) যিকরে মুফরিত অর্থাৎ অতিমাত্রায় উচ্চঃস্বরে যিকর করা, যা সকল ইমামগণের মতে হারাম। (২) যিকরে মুতাওয়াচ্ছিত অর্থাৎ স্বাভাবিক স্বরে যিকর করা, যা শর্তসাপেক্ষ জায়েয। (৩) যিকরে সিররী অর্থাৎ নিম্নস্বরে যিকর করা, এটি হচ্ছে যিকরের সর্বোত্তম পন্থা।

যিকরে জলী জায়েয হওয়ার শর্তগুলো হল, এত উচ্চঃস্বরে না হওয়া যদ্বারা ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুমে, মুসল্লীর নামাযে ব্যাঘাত ঘটে অথবা রোগীর কষ্ট হয়। আর এই উচ্চঃস্বরে যিকর করার দ্বারা স্বয়ং যিকরকারীর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা বিদ্যমান না থাকা। এসব শর্তসাপেক্ষে যিকরে জলী জায়েয হবে। অন্যথায় জায়েয হবে না।

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেন, উচ্চঃস্বরে যিকর জায়েয হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তসমূহ পালন করতে হবে। যথা- (১) লোক দেখানোর উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। (২) অতিমাত্রায় উচ্চঃস্বরে হতে পারবে না। (৩) এমন ধারণা থাকতে পারবে না যে, উচ্চঃস্বরে যিকর করাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের বিশেষ উপায়। (৪) ঘুমন্ত ও নামাযী ব্যক্তির ঘুম এবং নামাযে ব্যাঘাত ঘটতে পারবে না। (৫) নিম্নস্বরের যিকর-এর উপর উচ্চঃস্বরের যিকরকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। উপরোল্লিখিত শর্তসমূহ পালন সাপেক্ষে উচ্চঃস্বরে যিকর করার অনুমতি শরীয়তে রয়েছে। অন্যথায় অনুমতি নেই।

উল্লেখ্য, কোন পীর সাহেব যদি তার মুরীদদেরকে তা’লীম দেওয়ার উদ্দেশ্যে দু’এক বার উচ্চঃস্বরে হালকায়ে যিকর করেন, তাহলে সেটা তা’লীমের প্রয়োজনীয়তা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আর হালকায়ে যিকর না করার শর্তে শরীয়ত সম্মত হবে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সব সময় হালকায়ে যিকরের আয়োজন করা এবং এ ধারা অব্যাহত রাখা জায়েয হবে না। বর্তমান যমানার মত তা’লীমের নামে সবসময় এত উচ্চ মাত্রায় হালকায়ে যিকর করা যে, জোসের মধ্যে এসে গিয়ে লাফালাফি করতে করতে হুঁশ-জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলা কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না।

প্রশ্নোল্লিখিত হাদীসের অর্থ এই নয় যে, শরীয়তের সীমারেখা উপক্ষো করে মনগড়াভাবে যিকর করতে হবে। বরং শরীয়তের সীমারেখা রক্ষা করে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলার স্মরণে জিহ্বাকে তরুতাজা রাখার কথা বলা হয়েছে। অন্য এক হাদীসে আছে, সর্বোত্তম আমল হল, আল্লাহ তাআলার স্মরণে নিজের জিহ্বাকে তরুতাজা রাখা। আর এই যিকর বা আল্লাহর স্মরণ কীভাবে করতে হবে তা হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং আমাদের দেখিয়ে গেছেন, সেভাবেই করতে হবে, মনগড়াভাবে করলে হবে না। কাজেই প্রতীয়মান হল যে, অন্যান্য স্তরের যিকরকে যিকরই মনে না করা এবং হালকায়ে যিকরের মাধ্যমে লাফালাফি করতে করতে হুঁশ-জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে ফেলা যিকরের সঠিক পন্থা নয়।

সূত্র- জালালাই শরীফ-১/১৩৪ এবং হাশিয়া নং ১১, সূরা বনী ইসরাইল- ১১০, তাফসীরে রূহুল মাআনী- ৫/১৫৪, বুখারী শরীফ-১/৪২০, ২/১০৯৯, মিশকাত শরীফ-১/১৯৮, ২০১, শরহে মুসলিম-২/৩৪৬, আবুদাঊদ শরীফ- ১/১৯৫, বেদায়া ওয়া নেহায়া- ১/২৭০, কাবীরী- ৫৬৬ পৃষ্ঠা, ফাতওয়ায়ে সিরাজিয়্যা-৭২ পৃষ্ঠা, ফাতহুল ক্বাদীর- ২/৪৯, ফাতওয়ায়ে শামী- ৬/৩৭৯, ফাতহুল বারী- ২/২৫৬, ফয়যুল ক্বাদীর শরহে জামিউস্ সগীর- ২/৮৪, সাব্বাতুল ফিকর ফীল জেহের বিয যিকর- ১৬ পৃষ্ঠা।

উত্তর দিয়েছেন- আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন

মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসীর ও সহকারী পরিচালক-
জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।