বর্ষা মওসুম বিদায় হলওে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ কমছে না। সরকারি হিসেব মতে গত ১৫ বছরের মধ্যে ডেঙ্গুতে এবারই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
সরকারি হিসেবে বলা হয়েছে, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ বছর ২৬৭৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৪ জন। এর আগের বছর আক্রান্ত হয়েছিল সাড়ে তিনশর কিছু বেশি রোগী।
এবারে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপের মাত্রা বেশি হওয়ার যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়াটাকে অন্যতম বলে মনে করছেন রোগ বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা জানিয়েছেন, এ বছর ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মধ্যে ডেন-৩তে আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ। এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ। তাছাড়া পরীক্ষা করে দেখা গেছে ডেঙ্গু নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা বেশিরভাগই দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়াটা যেকোনো রোগীর জন্য ভয়াবহ। কেন না, প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের ভয়াবহতা প্রায় ২০০ গুণ বেশি। আক্রান্ত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে।
রাজধানীর বেসরকারী সেন্ট্রাল হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান জানান, গত পাঁচ মাসে এই হাসপাতালে শিশুসহ মোট এক হাজার ৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। মোট ভর্তি রোগীর মধ্যে ৫শ’ ৪২ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ এবং ৫০২ জন শিশু।’
ডা. মতিউর রহমান বলেন, চিকিৎসকদের কাছে একজন রোগীর মৃত্যুও কাম্য নয়। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরও চিকিৎসাধীন সহস্রাধিক রোগীর মধ্যে গত পাঁচ মাসে তিনজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়।
গত ২৫ অক্টোবর রাতে এ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আফরিন হক নামের ১১ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। আফরিনের পরিবারের অভিযোগ চিকিৎসকের অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডা. মতিউর রহমান বলেন, সুচিকিৎসা প্রদানে কারও অবহেলার সুযোগ নেই। শিশুটি খুবই খারাপ অবস্থা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল বল জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক।
পেডিয়েট্রিক ইউনিটের ডা. সুজিত কুমার রায় বলেন, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই আকস্মিভাবে রক্তে প্লাটিলেট আশঙ্কাজনকহারে কমে গিয়ে হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল (মাল্টিঅর্গান ফেইলিউর) হয়ে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করতে চাইছে না।
অধ্যাপক মতিউর রহমান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সুচিকিৎসায় আস্থা অর্জন করলেও মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দায় চিকিৎসকের ওপর চাপিয়ে দেয়া, হাসপাতাল ভাংচুর ও চিকিৎসকদের শারীরিকভাবে হেনস্থা করার ঘটনায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এমনটা চলতে থাকলে অন্যান্য হাসপাতালের মতো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করাতে চিকিৎসকরা ভয় পাবে। সেক্ষেত্রে রোগীদের সুচিকিৎসা ব্যাহত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বরের সাথে গায়ে ব্যথা হয়। তিন-চার দিন পর ভালো হয়ে যেতে পারে জ্বর । তবে এরপর প্লেটিলেট কম হতে থাকে। হঠাৎ মাঝখানে একটি বিরতি দিয়ে আবার জ্বর আসে।
এছাড়া এই জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা করবে। শরীর এমন ব্যথা করবে যেন মনে হবে কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। জ্বর সাধারণত দুই দিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র্যাশ দেখা দেয়।
যদি জ্বর জটিল পর্যায় হয়, তাহলে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়তে পারে, রক্তবমি হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আপার অ্যাবডোমিনে বা ওপরের পেটে পানি চলে আসতে পারে।’
এই জ্বরে যেহেতু পানিশূন্যতা বেশি হয়, তাই প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে। কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘাম হতে পারে। বমি বমি ভাব হতে পারে, খাবারে অরুচি হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের যে লক্ষণ, সেগুলো প্রায় সবই ডেঙ্গু জ্বরে থাকবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সম্প্রতি পত্রিকায় জনসচেতনামূলক এক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু জ্বরে প্রচুর পানি পান করতে হবে। প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দিতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে সন্দেহ হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট এবং পিসিভি পরীক্ষা করাতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর রোগীর প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে। প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গেলে রোগীকে শিরাপথে প্লাটিলেট ট্র্রান্সফিউশন করতে হবে। আর যদি রোগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ থাকে যেমন— রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে কালো রঙের রক্ত যাওয়া, নাক দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হওয়া। সেক্ষেত্রে রোগীকে রক্ত দেওয়া যেতে পারে। ডেঙ্গু হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শে যত্নবান হতে হবে।