।। আতাউর রহমান খসরু ।।
সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমানত। সন্তানের সঠিক প্রতিপালন ও শিক্ষাদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই আমানত রক্ষা করতে হয়। আর সুশিক্ষাই সন্তানের প্রতি মা-বাবার সবচেয়ে বড় উপহার। ইসলাম শিশুর সুষ্ঠু প্রতিপালন ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে বয়সভিত্তিক শিক্ষাদানের পরামর্শ দিয়েছে।
যেন শিক্ষা শিশুর জন্য বোঝা হয়ে না যায়।
ইসলামে বয়সভিত্তিক শিক্ষার ধারণা : শিশুর শিক্ষা যে বয়সের অনুকূল হওয়া আবশ্যক তার ধারণা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদিস থেকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাজের আদেশ দাও, যখন তাদের বয়স সাত বছর হবে এবং যখন তাদের বয়স ১০ বছর হবে, তখন তাদের নামাজের জন্য প্রহার কোরো এবং তাদের বিছানাও পৃথক করে দাও। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৪)
অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘শিশু যখন ডান ও বামের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে, তখন তাদের নামাজের নির্দেশ দেবে। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৭)
কোন বয়সে কী শেখাব? : কোন বয়সে শিশুকে কী শেখানো হবে সে বিষয়ে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, ‘তোমরা শিশুকে প্রথম সাত বছর অবকাশ দাও এবং পরের সাত বছর তাদের সর্বদা সঙ্গে রাখো (শিক্ষাদানে মনোযোগী হও)। যদি সে এই সময়ের ভেতর কল্যাণ লাভ করতে পারে, তবে ভালো। নতুবা সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে। ’ (আল-কাফি : ৬/৪৬)
আরও পড়তে পারেন-
- কাবলাল জুমা: কিছু নিবেদন
- দারিদ্র বিমোচনে এনজিওদের থেকে কওমি মাদ্রাসার সফলতা বেশি!
- হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব?
- সমাজে পিতা-মাতারা অবহেলিত কেন
- সংঘাতবিক্ষুব্ধ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সুমহান আদর্শ
উল্লিখিত হাদিস ও আলী (রা.)-এর এই বাণীর আলোকে মুসলিম মনীষীরা শিশুর শিক্ষাকালকে তিন ভাগে ভাগ করেন। তা হলো—
ক. শূন্য থেকে সাত বছর : এই বয়সে শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকবে। সাত বছর পর্যন্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবে। শিশুর শারীরিক গঠন যেন দুর্বল না হয় সে জন্য তাকে পুষ্টিকর খাবার, আনন্দমুখর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খেলাধুলার অবকাশ দেবে।
শিশুরা যেহেতু এই বয়সে অনুকরণপ্রিয় হয়, তাই মা-বাবাসহ পরিবারের গুরুজনরা দ্বিনি জীবনযাপন, উত্তম আচরণ ও ভালো কাজের মাধ্যমে শিশুর সুন্দর জীবনে অভ্যস্ত করে তুলবে। তাদের মুখে মুখে ঈমান ও ইসলামের মূল বিষয়গুলো শিক্ষা দান করবে। শিশুশিক্ষার মূল পর্ব যদিও সাত বছর বয়সের পর শুরু হয়, তবু আগামী দিনের জন্য এই সময়টুকু গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘প্রতিটি শিশু ফিতরত তথা সুস্থ প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার মা-বাবা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টানে রূপান্তর করে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬০০)
খ. আট থেকে ১৪ বছর : মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, এটাই শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল সময়। কেননা এই সময় শিশুর বোধ-বুদ্ধি ক্রমেই বিকশিত হতে থাকে। সুতরাং তাকে ইসলামী শরিয়তের ফরজ বা আবশ্যক জ্ঞান ও জীবনের জন্য অপরিহার্য জাগতিক জ্ঞানের পাঠ নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এই সময়েই শিশু তার স্মৃতি সংরক্ষণ শুরু করে, তাই এই বয়সের পাঠদানের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা কাম্য। নতুবা ভুল শিক্ষা শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার যে বিষয়গুলোকে ‘ফাউন্ডেশন’ বা মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, তা ক্রমস্তর অনুসারে এ বিষয়ে পাঠদান করা উত্তম।
কেননা গবেষকরা বলেন, ‘শৈশবের শিক্ষা যেন পাথরে অঙ্কিত নকশা। ’ এ ছাড়া এই বয়সে শিশুর শারীরিক বিকাশের পাশাপাশি মানসিক বিকাশের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। যেন তারা হীনম্মন্যতা, সংকীর্ণতা, আত্মগরিমার মতো মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত না হয়। পাশাপাশি তারা আত্মমর্যাদা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, বড়দের প্রতি মান্যতা নিয়ে বড় হয়। সাত বছরের পর শিশুরা ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে। তাই তাদের ভালো ও মন্দের পার্থক্যগুলো বুঝিয়ে দেওয়া আবশ্যক। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) ওমর ইবনে আবু সালামা (রা.)-কে বলেন, ‘হে বাছা, খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ পড়বে, ডান হাতে খাবে, নিজের দিক থেকে খাবে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৭৬)
শিশুর বয়স ১০ বছর অতিক্রম করলে তার মনে জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশ্ন ও কৌতূহল জন্ম নিতে পারে। তাই এ সময় পরিবারের গুরুজনরা সংযত ও সচেতন আচরণ না করলে এবং তাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন শিশুদের থেকে আড়াল না করলে, শিশুরা ভুল বার্তা পেতে পারে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ বছর হলে শিশুর বিছানা পৃথক করে দিতে বলেছেন।
গ. ১৫-২১ বছর : বেশির ভাগ অঞ্চলের ছেলে ও মেয়েরা এই বয়সে সাবালক হয়ে যায় এবং তাদের ভেতর স্বাধীন ব্যক্তিত্ববোধ তৈরি হয়। তাই এই সময় কঠোর আচরণ করলে সন্তান নিজেকে বিপন্ন মনে করতে পারে। মুসলিম মনীষীরা সাবালক সন্তানের ক্ষেত্রে কঠোর শাসনের পরিবর্তে কোমল উপদেশকে বেশি উপকারী বলেছেন। তারা সন্তানের ব্যক্তিত্ববোধকে মূল্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি ইসলামও মানুষের সাবালকত্বকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে।
কোনো সন্তান যখন সাবালক হয়, তখন ইসলামী শরিয়ত তাকে বহু বিষয়ে স্বাধীনতা প্রদান করে এবং তার ওপর থেকে অভিভাবকদের কর্তৃত্ব খর্ব করে। ফলে সে জীবনসঙ্গী গ্রহণ, নিজ সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়, নিজ উপার্জনে স্বাধীন জীবনযাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা লাভ করে। সন্তান সাবালক হওয়ার পর মা-বাবা ও অভিভাবকদের হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত। নতুবা উভয়ের সম্পর্ক দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে হঠকারী ও কঠোরতা আরোপকারী হিসেবে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ ও কোমল আচরণকারী শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৭৮)
সুশিক্ষা নিশ্চিত করার সুফল : শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সুফল সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তানসন্ততি ঈমানে তাদের অনুগামী হয়, (জান্নাতে) তাদের সঙ্গে মিলিত করব তাদের সন্তানসন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল আমি কিছুমাত্র হ্রাস করব না; প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী। ’ (সুরা তুর, আয়াত : ২১)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ