বর্তমান বিশ্বে ১১বছর বয়সী শিশুদের ৯১ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অতএব বলা যায় শিশুদের স্মার্টফোন ব্যবহার প্রায় সার্বজনীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহার না করাতে শিশুদের কি অনেক কিছু হাত ছাড়া হয়ে যায়? নাকি এর ফলে তারা অনেক সুবিধা ভোগ করে?
আপনার শিশু সন্তানকে স্মার্টফোন দেবেন নাকি যতসম্ভব যেকোনো ডিভাইস থেকে দূরে রাখবেন- এ এক আধুনিক উভয়সংকট!
অনেক বাবা-মার কাছে স্মার্টফোন যেন একটি প্যান্ডোরার বক্স। খুলে দিলেই বেরিয়ে পড়বে সব মন্দ কিছু! প্যান্ডোরার বক্স থেকে যেমন পৃথিবীর সকল অনিষ্ট বেরিয়ে পড়ে, তেমনি সন্তানদের স্মার্টফোন দেওয়া মানে যেন তাদের সুন্দর জীবন নষ্ট করে দেওয়া। শিশুদের মুঠোফোন ও সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারের প্রভাব সম্পর্কে শত শত সংবাদ শিরোনাম দেখে এমন দুশ্চিন্তায় না পড়ে উপায় নেই বাবা-মায়েদের।
এমনকি সেলিব্রেটিরাও এই সমস্যার বাইরে নন। বিখ্যাত মার্কিন গায়িকা ম্যাডোনা তার সন্তানদের হাতে ১৩ বছর বয়সে মুঠোফোন দিয়ে পরবর্তীতে বেশ অনুশোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন এই কাজ আর তিনি করবেন না।
অন্যদিকে, আপনি হয়তো এটাও ভাবেন যে মুঠোফোন ব্যবহার একেবারেই অপরিহার্য। কারণ ম্যাসেজিং থেকে শুরু করে ভিডিও কলে কথা বলা, পারিবারিক ছবি তোলা, ই-মেইল, অনলাইন শপিংসহ অনেক কাজ করা এখন আর স্মার্টফোন ছাড়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আপনার সন্তানদের অন্যান্য সহপাঠীরা এবং বন্ধুরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। এতে আবার আপনার সন্তানদের অনেক সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে না তো?
সামাজিক মাধ্যম ও স্মার্টফোন শিশু ও কিশোর কিশোরীদের দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে প্রভাবিত করে- এখনো এ প্রশ্নের সঠিক জবাব নেই। তবে কখন একজন শিশুকে স্মার্টফোন দেওয়া যাবে এবং দেওয়ার পরে আপনার করণীয় কী হবে- এ সম্পর্কে যে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা উচিত সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত।
যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা অফকম-এর তথ্যমতে, দেশটিতে ১১বছর বয়সী শিশুদের ৯১ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে, নয় থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু আছে এমন বাবা-মায়ের মধ্যে ৩৭ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের সন্তানরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে।
১৯টি ইউরোপীয় দেশে নয় থেকে ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশু দৈনিক ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে।
আবার, ৯০ শতাংশেরও অধিক কিশোর-কিশোরী (যারা কৈশরের শেষ পর্যায়ে) ফোন ব্যবহার করেন। তথ্যটি জানান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যান্ডিস অডগার্স।
সাধারণত আমরা- এমনকি কিশোর কিশোরীরাও বিশ্বাস করে যে ফোনের ব্যবহার তাদের ভালো থাকা কিংবা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। কিন্তু গবেষণাতে তার প্রমাণ মিলছে না।
যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ এমি অর্বেন বলেন, ‘স্মার্টফোনের ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের ওপর কীরূপ প্রভাব ফেলবে তা নির্ভর করছে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ওপর। একমাত্র তাদের নিকটস্থ, ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন তারা কতটুকু প্রভাবিত হচ্ছে।’
কতিপয় কিশোর-কিশোরীর জন্য নেতিবাচক প্রভাব বেশি হলেও, অনেকের কাছে ফোন হয়তো লাইফলাইনসম হয়ে উঠতে পারে। এই যেমন, বিশেষভাবে সক্ষম কোনো এক কিশোরের কাছে ফোন হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর একটি উপায় অথবা ফোন হতে পারে যে কারোর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার একটি তাৎক্ষণিক উৎস।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অভ ইকোনোমিক্স-এ সামাজিক মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক সোনিয়া লিভিংস্টোন বলেন, ‘চিন্তা করুন আপনি একজন কিশোর যার মনে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। অথবা আপনার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ফোন হাতে থাকলে তৎক্ষণাৎ আপনি এসব বিষয়ে গুরত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিতে পারবেন।’
অনেক সময় শিশুদের ঘরের বাইরে খেলাধূলা না করার জন্য দায়ী করা হয় স্মার্টফোন ব্যবহারকে। কিন্তু ডেনমার্কের একটা গবেষণায় দেখা গেছে, ফোনে গান শোনা, মা-বাবা ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি শিশুদের বাইরের জগতের অভিজ্ঞতা আরও বাড়িয়ে দেয়। এতে তারা অপরিচিত কোনো পরিস্থিতি সামলে ওঠার দক্ষতা অর্জন করে। ফলে মা-বাবারাও তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও নিশ্চিন্ত হন যা শিশুদের চলাফেরার স্বাধীনতা দেয়।
তবে ঘনিষ্ঠদের সাথে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার যে আসক্তি তার কিছু অপকারিতাও রয়েছে। এ ব্যাপারে সোনিয়া লিভিংস্টোন বলেন, ‘অবিরত যোগাযোগ রাখা মানসিকভাবে অনেকের কাছে একটা বাধ্যবাধকতা হয়ে উঠতে পারে। অনলাইন না থাকলে বা যোগাযোগ না থাকলে চলমান বিশ্ব থেকে দূরে সরে চাচ্ছি- এরকম একটা মানসিক চাপ তারা হয়তো অনুভব করতে পারে।
অর্বেন এবং তার সহকর্মীদের পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী এবং ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোররা পরবর্তী জীবনে কম সন্তুষ্ট থাকেন।
কী করা উচিত বাবা-মা’দের?
পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বাবা-মা’দের উচিত তাদের সন্তানদের বয়সকে বিবেচনায় রাখা। তাদের মনে রাখা উচিত যে, কিশোর বয়সে সন্তানরা একটি বিকাশজনিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি তারা অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের ব্রেইন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয় যা তাদের অনুভুতি এবং আচরণে প্রভাব ফেলে। যেমন, এসময় তারা সামাজিক সম্পর্ক, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতি বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হতে পারে।
অর্বেন বলেন, ‘কিশোরকাল বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় তারা তাদের বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, নিজেদের ব্যাপারে অন্যরা কী ভাবছে সেটি নিয়ে তারা বেশি আগ্রহী হয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যেভাবে কেবল এক ক্লিকেই প্রতিক্রিয়া জানানো বা পাওয়া যায় কিংবা কারো সাথে যোগাযোগ করা যায়- এই ব্যাপারটি অনেকের কাছে মানসিক চাপের মনে হতে পারে।’
‘ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক, কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে থাকেন। এই ভিন্নতা হতে পারে তাদের ব্যক্তিগত জীবন একে অপরের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে, বা তারা বিকাশের ভিন্ন পর্যায়ে আছে বলে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে ভিন্নতার ফলে,’ সংযোজন করেন অর্বেন।
সন্তানদের হাতে কখন ফোন তুলে দেওয়া উচিত- এ প্রশ্নের ‘একমাত্র উত্তর’ গবেষণা এখনো দিতে পারে নি। একজনের জীবন এবং অভিজ্ঞতা আরেকজনের মতো নয়। মানুষের মাঝে এই স্বাতন্ত্র্যের কারণে এর উত্তরও হয় ভিন্ন ভিন্ন।
হাতে ফোন তুলে দেওয়া নিজের সন্তানের জন্য এবং পরিবারের জন্য ঠিক হবে কি না- এ প্রশ্নটা করা উচিত বলে মনে করেন অডগার্স।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মায়েরা শুধু ছোট সন্তানদের মোবাইল ফোন দেন যাতে তাদের সারাদিন যোগাযোগ রাখতে পারেন এবং স্কুল থেকে তাদের পিকআপ করতে পারেন।
অস্ট্রিয়ার ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনা-র যোগাযোগ গবেষক অ্যানজা স্টেভিকের মতে, ‘সন্তানরা তাদের নিজস্ব ডিভাইস ব্যবহার করার মতো দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে কি না- এই প্রশ্নটাই বাবা-মা’দের করা উচিত।’
সন্তানদের ফোন ব্যবহারের অনুমতি দিতে মা-বাবারা নিজেরাই মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত- এ ব্যাপারটিও এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। কারণ তা না হলে বাবা-মায়েরা অনেক সময় মনে করেন সন্তানদের ফোন ব্যবহারের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। যার ফলে সন্তান এবং মা-বাবা দুইয়ের মাঝে ফোনকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাটি হতে পারে।
আরও পড়তে পারেন-
- কাবলাল জুমা: কিছু নিবেদন
- দারিদ্র বিমোচনে এনজিওদের থেকে কওমি মাদ্রাসার সফলতা বেশি!
- হজ্ব-ওমরায় গেলে আমরা সেখান থেকে কী নিয়ে ফিরব?
- সমাজে পিতা-মাতারা অবহেলিত কেন
- সংঘাতবিক্ষুব্ধ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সুমহান আদর্শ
এটা মনে রাখতে হবে যে, স্মার্টফোন ব্যবহার করা মানেই প্রত্যেকটা গেইম কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করতে হবে – এমনটা নয়। তাই সন্তানরা কী কী অ্যাপ ব্যবহার করছে তার দিকে একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
বাবা-মা’দেরও মাঝেমধ্যে সন্তানদের সাথে বসে ফোন ব্যবহার করা উচিত। যেমন, একসাথে গেইম খেলা বা কোনো ভিডিও কিংবা যেকোনো কন্টেন্ট দেখা ইত্যাদি। এতে সন্তানরা কী ধরনের কন্টেন্ট দেখে তারা তারও একটা ধারণা পাবেন।
অফলাইনে বাবা-মা’রা সন্তানদের যেভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি সুস্থ যোগাযোগের মাধ্যমে অনলাইনেও নজর রাখতে পরামর্শ দেন অডগার্স।
বাচ্চারা কুটিলতা পছন্দ করে না। বাবা-মা’রা যখন তাদের কিছু করতে বারণ করেন অথচ তারা নিজেরাই সেটা করেন- এ ব্যাপারগুলো বাচ্চারা একেবারেই পছন্দ করেনা। যেমন, খাবার খাওয়ার সময় ফোন ব্যবহার করা যাবে না, ফোন নিয়ে ঘুমানো যাবে না- পরিবারে সন্তানদের জন্য এমন অনেক নিয়ম বেঁধে দেন বাবা-মা’রা। অথচ দেখা যায় তারা নিজেরাই এসব নিয়ম ভঙ্গ করে বসেন- যা একেবারেই ঠিক নয়।
সাধারণত বাবা-মাদের ফোন ব্যবহার দেখেই শিশুরা শেখে। শিশুদের এই অনুকরণপ্রিয়তাকে তারা সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে পারেন। তাদের এমন একটা অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যা দেখে সন্তানরাও শিখবে এবং উপকৃত হবে।
সন্তানকে কোন বয়সে স্মার্টফোন কিনে দেওয়া উচিত- এটা প্রত্যেক মা-বাবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। অনেকে মনে করেন কিনে না দেওয়াটাই হবে সঠিক। তবে সন্তানরা যেন স্মার্টফোনের অভাবে কোনো কিছুতে পিছিয়ে না পড়ে তা বাবা-মা’রা একটু সৃজনশীল হলেই নিশ্চিত করতে পারেন।
লিভিংস্টোন বলেন, ‘আত্মবিশ্বাসী এবং তুলনামূলকভাবে সামাজিক শিশুরা সহজেই কারো সাথে বা কোনো দলে মিশে যেতে পারে। তাছাড়া সাধারণত স্কুলেই যেহেতু শিশুদের সামাজিক জীবন, সেখানে তাদের বন্ধুদের সাথে এমনিতেই প্রতিদিন দেখা হয়।’
বলা হয় স্মার্টফনের দৌলতে চলমান বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করলে অনেক তথ্য বা চারপাশের খবরাখবর পাচ্ছিনা, এতে বন্ধুবান্ধবদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি- অনেকের মনে এই ভয়টি কাজ করে। ‘মিস আউট’ হওয়ার এই ভয়টি অনেকটা অন্তহীন। আর কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মিস আউট হওয়ার এ বিষয়টি প্রভাব ফেলে অনেক বেশি।
সূত্র: বিবিসি ।
উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ