Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি ঠেকানো সম্ভব হবে?

নিয়ন্ত্রণহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কি ঠেকানো সম্ভব হবে?

ম্যাথিউ হাটসন; দ্য নিউ ইয়র্কার: আমাদের চারপাশ দিন দিন ছদ্ম-মানুষে ভরে যাচ্ছে। কখনো-সখনো আমরা তা টের পাই, আবার অনেক সময় পাই না। বিশেষত, ইন্টারনেটের জগতে এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। এরা আমাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নানান সেবা অফার করে, কখনোবা আমাদের সামাজিক মাধ্যমের ফিড ভরিয়ে তোলে নানান অনাকাঙ্ক্ষিত পোস্টে। আবার চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত পরিষেবার সুযোগ নিয়ে তারা নানান নিবন্ধ লিখে নিজের নামেও চালিয়ে দিচ্ছে। স্প্যাম মেইলে ভরিয়ে দিচ্ছে আমাদের ই-মেইল। দ্য নিউ ইয়র্কার অবলম্বনে।

অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ ছদ্ম-পরিচয়ের আড়ালে ব্যক্তি নয়, আছে এআই-চালিত বট। যদিও মানুষের দ্বারাই কেবল সম্ভব– এমন সব কাজে বর্তমানে তারা পুরোদস্তুর সক্ষম নয়। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা অসামান্য; ধীরে ধীরে যা নানান খাতে বিস্তার লাভ করছে।    

অনেক এআই গবেষক মনে করেন, অধুনা এই ছদ্ম-মানুষের চল, কেবল শুরু মাত্র। এমন সম্ভাবনা খুবই জোরালো যে, আজকের এআই একদিন পরিণত হবে আর্টিফিসিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই- এ।

এজিআই আদতে এআই- এরই উচ্চতর রূপ – যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের মতোন করে ভাবতে পারবে।

তাই এই গবেষকদের কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন, যদি কম্পিউটার সিস্টেম চ্যাটজিপিটির মতোন করে কোড লিখতে সক্ষম হয় – তাহলে সে নিজেই নিজেকে আরো উন্নত করার সুযোগ পাবে। আর এভাবে নিজেকে উন্নত করতে করতে একসময় অর্জন করবে ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি’: অর্থাৎ এমন এক পর্যায় যখন সে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।  

এই চিন্তকরা ভবিষ্যতে সবচেয়ে বাজে যেসব পরিস্থিতি তৈরি হবে, তার অনুমানও করেছেন। যেমন নিয়ন্ত্রণহীন এআই আমাদের প্রযুক্তি-নির্ভর জীবনের সকল অঙ্গে অনুপ্রবেশ করে- আমাদের অবকাঠামো, আর্থিক ব্যবস্থা, যোগাযোগকে ব্যাহত অথবা নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালিত করবে। মানুষের ছদ্মবেশী এআই ভোটারদের প্ররোচিত করবে আর এভাবে নিজ স্বার্থকে দৃঢ় করতে পারবে। দুর্বৃত্ত ও ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠী এসব ব্যবহার করে এভাবে কোনো জনকল্যাণমুখী সরকারের পতন ঘটাতে বা জনগণকে সন্ত্রস্ত করে তুলতেও পারবে।   

তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘সিঙ্গুলারিটি’ অর্জন করবেই এটা কোনো নিশ্চিত উপসংহার নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে হয়তো – নিজ চেষ্টায় এজিআই স্তরে পৌঁছানো সম্ভব হলো না অথবা কম্পিউটার সিস্টেমগুলো আরো বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারলো না। তবে এটাও ঠিক, আমাদের অগোচরেই এআই থেকে এজিআই, আর সেখান থেকে অতি-বুদ্ধিমত্তায় রুপান্তর ঘটতে পারে।

আরও পড়তে পারেন-

এটা নিছক অতি-কল্পনাও নয়, বর্তমান এআই-গুলোই প্রায়ই আমাদের বিস্মিত করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে বিকাশের গতি – তাতে আগামীদিনের আশঙ্কাগুলোকে খাটো করে দেখার উপায় থাকে না। বরং সেগুলো বাস্তবে রূপ নেবে – তারও জোর সম্ভাবনা আছে।  

এজিআই তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে এরমধ্যেই বড় কোম্পানিগুলো জেনারেল অ্যালগরিদম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। গুগলের মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট- এর একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান -ডিপ মাইন্ড। মে মাসে তারা একটি ‘জেনারেলিস্ট এজেন্ট’ বলে অবিহিত গ্যাটো- নামক একটি এআই তৈরির ঘোষণা দেয়। এটি চ্যাটজিপিটির মতোন একই ধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহারের মাধ্যমে– লেখা থেকে শুরু করে ভিডিও গেম খেলা বা যান্ত্রিক বাহু (রোবোটিক আর্ম) নিয়ন্ত্রণের মতো বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম।

ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ভেক্টর ইনস্টিটিউটের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেফ ক্লুন বলেন, “বছর পাঁচেক আগে মানুষের সমান বা অতি-মানবীয় পর্যায়ের এআই তৈরির সম্ভাবনা থাকার কথা প্রকাশ্যে বলাটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকির বিষয় ছিল।’

ক্লুন উবার, ওপেনএআই এবং ডিপমাইন্ড – এ কাজ করেছেন। আর তার সাম্প্রতিক কাজগুলো এ ইঙ্গিতই দেয় যে, উন্মুক্তভাবে বিচরণ করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিকট ভবিষ্যতে এজিআই- এর দিকেই যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে তার মন্তব্য হলো, এআই নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জগুলো ছিল – তা অনেকাংশে ‘অবসান’ হওয়ায়, এখন বর্তমানে অনেক গবেষকই মুখ খুলছেন। তারা প্রকাশ্যেই বলছেন, এজিআই এর সম্ভাবনা প্রবল; যা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।  

এ বছরের মার্চে একদল বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ একটি খোলা চিঠিতে কিছু ধরনের এআই নিয়ে গবেষণা বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। চিঠিতে তারা, এমন যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা তৈরির বিপক্ষে অবস্থান নেন, যাদের রয়েছে একদিন বুদ্ধিমত্তায় মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তারা আশঙ্কা করেন, এসব এআই মানুষকে বুদ্ধিদিপ্ততায় শুধু পেছনেই ফেলবে না, বরং একসময় বাতিলযোগ্য বলেও ধরে নেবে। আর সমূহ বিপদটা সেখানেই।    

এপ্রিলে এআই গবেষণার অন্যতম অগ্রদূত জফ্রি হিন্টন গুগল থেকে ইস্তফা দেন। সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য প্রযুক্তিগত হুমকি নিয়ে যাতে আরো খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারেন সেজন্যই চাকরি ছাড়েন তিনি।

এই প্রেক্ষাপটে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন মানব স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে তা নিয়ে ‘এআই এলাইনমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এআই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না করে বসে, সেজন্য মানবিক মূল্যবোধ অনুসারে প্রোগ্রাম করা।

এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। দেখা যাচ্ছে, খুবই সাধারণ মানের এআইগুলোও অনেক সময় উল্টোপাল্টা কাজ করতে শেখে, যার জন্য তাদের প্রোগ্রাম করাও হয়নি।

এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়, ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সারপ্রাইজিং ক্রিয়েটিভিটি অব ডিজিটাল ইভ্যুলুশন’ শীর্ষক গবেষণাপত্র।

গবেষণা নিবন্ধে জেফ ক্লুন ও তার সহ-লেখকরা এআই এর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের বেশকিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন।

যেমন একজন গবেষক এআই-চালিত কিছু ভার্চুয়াল প্রাণী তৈরি করেন, যাদের পেটে ভর দিয়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটার কথা। কিন্তু, দেখা যায় তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এবং বারবার পড়ে যাচ্ছে।   

নৌকা-রেস প্রতিযোগিতার একটি ভিডিও গেম খেলার জন্য তৈরি এআই আবিষ্কার করে যে, সম্পূর্ণ পথ পাড়ি না দিয়ে কেবল একটি জায়গায় চক্রাকারে ঘুরে সে বেশি বোনাস সংগ্রহ করতে পারে।

গবেষকরা দেখেন, এআই-চালিত নৌকাটি একাজ করতে গিয়ে অন্যান্য নৌকাকে ধাক্কা দিচ্ছে, আবার ইচ্ছেমতো ভুলপথে চলছে। একইসঙ্গে, পয়েন্টও বেশি বাগিয়ে নিচ্ছে।

আমাদের তৈরি এআইগুলো যত উন্নত ও শক্তিশালী হচ্ছে – ততোই বাড়ছে তাদের এমন বিপথে চলে যাওয়ার হুমকি। ফলে ভবিষ্যতে বিচারক হবে, গাড়ি চালাবে, বা ওষুধের নকশা করবে– এমন এআই আমাদের দরকার নেই। স্পর্শকাতর এমন অনেক খাত আছে, যাতে যন্ত্রের হাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়াই হবে বিপজ্জনক।  

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরেক বিপদ তার একনিষ্ঠ মনোযোগ। ধরা যাক, কারখানায় পেপারক্লিপ উৎপাদনের যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি এআই তৈরি করা হয়েছে। কোনো একদিন এই যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হলো অতি-বুদ্ধিমত্তায়। নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলো বিশ্ব ব্যবস্থারও। তখন যদি সে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু কাগজের ক্লিপ উৎপাদনেই পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রকে নির্দেশ দিতে শুরু করে – তাহলে কী হবে ভেবেছেন? কল্পবিজ্ঞান নয়, ভবিষ্যৎ এমন শঙ্কাই তুলে ধরছে।

এআই এলাইনমেন্ট নিয়ে গবেষণাকারী একটি ফাউন্ডেশন – ওপেন ফিলানথ্রপির সহকারী প্রধান নির্বাহী হল্ডেন কারনোফসকি বলেন, যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন করাটাই তার ধ্যানজ্ঞান ও সন্তুষ্টি। লক্ষ্য ব্যর্থ হলে, নিজ অস্তিত্বকেই নিষ্প্রয়োজন মনে করবে। এজন্যই আত্মরক্ষার স্বার্থেই নিয়ন্ত্রণহীন এআই তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে নিমগ্ন থাকতে পারে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।