Home ফিকহ ও মাসায়েল ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান

ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

কারো কাছে ঋণ থাকলে তা পরিশোধে উদাসীন হওয়া হারাম কাজ। যত দ্রুত পারা যায় ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। কারণ মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘সক্ষম ব্যক্তির ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা তার মানহানি ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ)।

বস্তুত আল্লাহতায়ালা চান মুমিন যেন পাপমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করে। আর এ পরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই যেন তার মৃত্যু হয়। এ জন্য পাপ ও ঋণমুক্ত থাকা অপরিহার্য।

আমরা জানি, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে ৪টি হক সংশ্লিষ্ট। যথা- ১. কাফন-দাফন: একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর ওয়ারিশদের প্রথম কর্তব্য হলো- তার ত্যাজ্যসম্পদ থেকে মধ্যম মানের ব্যয়ে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা। ২. ঋণ পরিশোধ করা: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো- তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা। ৩. অসিয়ত পূরণ করা: মৃত ব্যক্তি কোনো অসিয়ত করে গিয়ে থাকলে এক-তৃতীয়াংশ মাল দিয়ে সে অসিয়ত পূরণ করা। ৪. বণ্টন করা: অবশিষ্ট সম্পদ তার ওয়ারিশদের মধ্যে কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুযায়ী বণ্টন করা।

ঋণ পরিশোধ না করার পরিণতি

ঋণের গোনাহ মারাত্মক। তা বান্দার হক। তাই ঋণদাতা তাকে ক্ষমা না করলে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন না। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের আত্মা তার ঋণের কারণে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকবে অর্থাৎ জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ তার ঋণ পরিশোধ করা না হয়।’ (সুনানে তিরমিযী: ১০৭৮)।

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মসজিদে নববীর সম্মুখে যেখানে জানাযা রাখা হতো, সেখানে বসা ছিলাম। তখন হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাদের মাঝে বসা ছিলেন। আমরা দেখলাম, তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর দৃষ্টি অবনমিত করে কপালে হাত রেখে বললেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হলো। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা এক দিন ও এক রাত চুপ থাকলাম। এ সময়ের মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছুই দেখলাম না।

হাদিস বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বলেন, (দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর) আমি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আরজ করলাম, কী কঠিন বিষয় অবতীর্ণ হয়েছে? হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঋণ সম্পর্কীয় কঠিন বিধান। সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তারপর পুনর্জীবিত হয়ে আবার আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয় তথা তিনবার শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে, আর তার জিম্মায় অনাদায়ী ঋণ থেকে যায়, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ তার সেই ঋণ পরিশোধ না করা হয়। (সুনানে আবু দাউদ- ১৬৩)।

নবী করীম (সা.) জানাযার সময় যে প্রশ্ন করতেন

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, শহীদের সব গোনাহই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। মাফ হবে না শুধু ঋণ। (সহিহ মুসলিম)।

হযরত নবী করিম (সা.) কারও মৃত্যুর সংবাদ শুনলে তার জানাজায় উপস্থিত হতেন। তিনি বলেছেন, এক মুমিনের ওপর আরেক মুমিনের হক হলো ছয়টি। তন্মধ্যে একটি হলো- মৃত ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত হওয়া এবং তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা। মহানবী (সা.) জানাযায় উপস্থিত হয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে প্রশ্ন করতেন, এ ব্যক্তির কোনো ঋণ আছে কি না? যদি প্রত্যুত্তরে বলা হতো আছে, তাহলে তিনি বলতেন তার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য আছে কি না?

যদি বলা হতো আছে, তাহলে ওয়ারিশদের বলতেন তা পরিশোধ করে দাও। অতঃপর জানাযা পড়াতেন। আর যদি বলা হতো পরিশোধ করার মতো সামর্থ্য তার নেই, তখন তিনি বলতেন, এ ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার, আমি নবী ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হিসেবে তা প্রদান করব।

আরও পড়তে পারেন-

অন্যের ঋণের বোঝা হালকা করার ফযীলত

অপর মুমিন ভাইয়ের ঋণের বোঝা দূর করার ফল হলো ক্ষমা। নবী করিম (সা.) বলেন, এক ব্যক্তি মানুষকে ঋণ দিতো। তারপর তা আদায় করার জন্য লোক পাঠাত। সে আদায়কারীকে বলে দিত, অভাবী লোকদের ঋণ মাফ করে দেবে। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ আমাদের মাফ করে দেবেন। এ ব্যক্তি যখন আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌঁছল, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। (বুখারি ও মুসলিম)।

অন্য আরেক হাদিসে হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জানাযার জন্য এক ব্যক্তিকে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আনা হলো। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তির কি কোনো ঋণ আছে? জবাবে বলা হলো, হ্যাঁ আছে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ঋণ শোধ করার মতো সম্পদ কি সে রেখে গেছে? জবাবে বলা হলো, না রেখে যায়নি।

হযরত রাসূলুল্লাহ বললেন, তোমরা এ ব্যক্তির জানাযা পড়ো, আমি পড়ব না। এ অবস্থা দেখে হযরত আলী (রাযি.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ ব্যক্তির ঋণ আদায়ের ভার নিচ্ছি। অতঃপর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জানাযা পড়ান।

অন্য এক বর্ণনানুযায়ী হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে আলী! আল্লাহ তোমাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখুন, সেভাবে তুমি তোমার একজন মুসলিম ভাইকে আগুন থেকে বাঁচালে। যে মুসলিম অপর মুসলিমের ঋণ পরিশোধ করে দেবে, শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। (শরহে সুন্নাহ)।

ঋণ পরিশোধ করার বাসনা

ঋণ পরিশোধ করার নিয়ত থাকলে আল্লাহতায়ালা সাহায্য করেন। নবী করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কারও কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এবং তা আদায় করার নিয়ত রাখে। আল্লাহ তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন অর্থাৎ পরিশোধ করা সহজ করে দেন। আর যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে তা আদায় করার নিয়ত রাখে না। আল্লাহতায়ালা তাকে ধ্বংস করেন। (বুখারী)।

শিক্ষা

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ঋণের ভয়াবহতা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। যাতে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়। মৃত্যুর পর ওয়ারিশগণ সম্পদ বণ্টন করে নিয়ে যাবে। তারা ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণের শাস্তি তাকেই পেতে হবে। বিশেষ করে ব্যক্তিবিশেষ, ব্যাংক বা এনজিও ইত্যাদি থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করা জরুরী।

লেখক: বিশিষ্ট সমাজকর্মী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল বাশার ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা এবং প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ ডটকম।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।