Home লাইফ স্টাইল সবার দেনা মিটিয়েছেন, নিজেকে পেমেন্ট করেছেন কি?

সবার দেনা মিটিয়েছেন, নিজেকে পেমেন্ট করেছেন কি?

।। সাইফুল হোসেন ।।

আপনারা যারা পরিবারের কর্তা বা আপনি যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে এই পরামর্শ আপনার জন্য। আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য যেমন আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আর্থিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াও আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপনার আর্থিক স্বাস্থ্য যদি ভালো না হয় তাহলে আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও তার বিরূপ প্রভাব পড়বে।

‘নিজেকে আগে পেমেন্ট করুন’ কথাটা ইদানিং আমরা শুনি, কিন্তু এটা বলতে আসলে কী বুঝি- সে ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষই অস্পষ্ট ধারণা রাখি। আমরা অনেকেই ‘নিজেকে পেমেন্ট করা’ বলতে বুঝি যে, আমরা নিজে খুব ভালোভাবে চলবো, রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভাল খাবার খাবো বা আরো এরকম অন্য কিছু করবো এবং নিজেকে তুষ্ট করবো।

আমি এক রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে সারাদিনে কয়টা সিগারেট খায়। উত্তরে সে বলেছিল দশ-পনেরটা হবে। তাঁর কথা হচ্ছে সিগারেট না খেলে সে শক্তি পাবে কোত্থেকে? তাঁর প্রায় ষাট থেকে পঁয়ষট্টি বছর বয়স হবে। সে ভাবে, সিগারেট খাওয়া হচ্ছে তাঁর নিজেকে পেমেন্ট করা।

আবার অনেকে ‘নিজেকে পেমেন্ট করা’ বলতে বা নিজেকে পুরস্কৃত করা বলতে বোঝেন, মদ খাওয়া, জুয়া খেলা বা নিজেকে অন্যান্য অনৈতিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলাকে, যে কাজ তাঁকে ক্ষণিক আনন্দ দেয়।

নিজেকে পুরস্কৃত করা কি আসলেই তাই? আমরা এখানে নিজেকে পুরস্কৃত করা বলতে ‘নিজেকে আগে পেমেন্ট করা’কে বোঝাচ্ছি। আপনি যে আয় করছেন, সেই মোট আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ, সেটা হতে পারে দশ শতাংশ, বিশ শতাংশ, ত্রিশ শতাংশ বা চল্লিশ শতাংশ- আপনি আগে একপাশে সরিয়ে রাখবেন এবং বাকি যে টাকাটা আপনার হাতে থাকবে সেই টাকা দিয়ে আপনি আপনার সংসারের সমুদয় খরচ করবেন।

কিন্তু সাধারণভাবে ব্যাপারটা ঘটে অন্যরকম। আমরা যখন বেতন পাই বা আমরা যখন আমাদের মাসিক আয়টা হাতে পাই তখন বাসা ভাড়া দেই, সব ইউটিলিটিস পরিশোধ করি, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ দেই, স্ত্রী বা স্বামীর হাত খরচ দেই, বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠাই, কিন্তু যেটা করি না সেটা হচ্ছে নিজেদেরকে পেমেন্ট করি না বা নিজের আর্থিক স্বাস্থ্য গঠনের দিকে আমরা খেয়াল করি না। অথচ এটাই হচ্ছে সবচাইতে জরুরি। আয় হাতে আসার পর প্রথম নিজেকে পেমেন্ট করে অন্যসব খরচ করা উচিত। কারণ আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ আপনার নিজের আর্থিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া।

আমার এক বন্ধু আছে যে প্রতিদিন প্রায় তিনশো টাকার সিগারেট খায়। তাঁর ইনকাম চল্লিশ থেকে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার টাকা হবে। তিনশ’ টাকার যদি সে প্রতিদিন সিগারেট খায়, তাহলে তার মাসে প্রায় নয় হাজার টাকার মত খরচ হয়ে যায় সিগারেটের পেছনে। এটা একটা ব্যাড মানি হ্যাবিট বা বাজে খরচের অভ্যাস। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, কেন তুমি এটা করো? তাঁর উত্তর হচ্ছে, ‘আসলে নিজের জন্যতো কিছুই করি না, এই সিগারেটটাই শুধু খাই’। এটা সত্যি কথা সে নিজের জন্য কিছু করে না, সিগারেটটাই খায়। কিন্তু এই সিগারেট তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যদি সে এটাকে বাদ দিয়ে সেই টাকাটা সঞ্চয় করতে পারত তাহলে আমার বন্ধুর বছরে অনেক টাকা সঞ্চয় থাকত। কিন্তু তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে আমি জেনেছি যে, তাঁর এক পয়সাও সঞ্চয় নেই বরং অনেক ঋণ আছে।

আমার বন্ধু কুঅভ্যাসের কারণে সঞ্চয় থেকে দূরে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তাঁর সাথে এই বিষয়ে কথা বলার পর সে বলছে, ‘আমি এইভাবে কখনো চিন্তা করিনি বা আমাকে কেউ কখনো বলেনি’। আমি তাঁকে বললাম, তুমি হয়তো একবারে এই অভ্যাস থেকে বের হতে পারবে না কিন্তু চেষ্টা করতে পার।

আসলে সে যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে, এখন যে এক প্যাকেট সিগারেট সে খায় সেটা প্রথমে সে অর্ধেকে নিয়ে আসতে পারে। আস্তে আস্তে সে সিগারেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। তাহলে এই যে টাকাটা সে নষ্ট করছিল, এই টাকাটা সে যদি সঞ্চয় করে তাহলে দেখা যাবে রিটায়ারমেন্টের সময় তাঁর হাতে অনেক টাকা জমে যাবে।

আমরা আসলে নিজের দিকে নজর দিতে সবসময় ভুলে যাই। আর যারা পরিবারের কর্তা তাঁদের এত প্রেসার থাকে চারিপাশ থেকে যে নিজেদের দিকে খেয়াল করার মতো সময়ও তাঁদের থাকে না। আমি মনে করি,পরিবারের যে সদস্যই আপনি হন না কেন, যিনি আয় করছেন তিনি তাঁর জন্য কিছু করছেন কিনা, নিজেকে সে কোনো পেমেন্ট করছেন কিনা সেটা ভালভাবে দেখা দরকার।

অনেক পার্সোনাল ফাইন্যান্স এক্সপার্ট এ কথাও বলেছেন যে, আপনি যেমন ধার করে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করেন, ধার করে ইলেকট্রিক বিল কখনো কখনো পরিশোধ করেন, ঠিক ওইরকম যদি কোন বিপদ আসে কোন মাসে তাহলে আপনি ধার করে হলেও নিজেকে আগে পেমেন্ট করুন।

আরও পড়তে পারেন-

আমি মনে করি যে, প্রতি মাসে এই টাকা আপনার হাতে আসার পরেই আপনি নিজের জন্য একটা অংশ সরিয়ে রাখবেন। এটা মূলত ভাল মানি হ্যাবিট। এটা থেকে দূরে সরা যাবে না। কোনো মাসে যদি না পারা যায়, ধার করে হলেও এটা করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি এটা কীভাবে করবেন? ব্যাংকে আপনি একটা স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন দিয়ে রাখতে পারেন। আপনার যে ব্যাংকে বেতনের টাকা জমা হয়, সেই ব্যাংকে চিঠি দিয়ে বলে রাখবেন যে প্রতিমাসে যেন আপনার অন্য আর একটা অ্যাকাউন্টে (নতুন অ্যাকাউন্ট খুলবেন প্রয়োজন হলে) একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠিয়ে দেয় এবং আপনি ভুলেও ওই টাকায় হাত দেবেন না। ওটাই আপনার নিজেকে পেমেন্ট মনে রাখবেন। প্রতি মাসে আপনার স্যালারির দশ ভাগ, বিশ ভাগ বা তিরিশ ভাগ আপনি যা মনস্থ করেন, তাই আপনার বয়স অনুপাতে আপনি ঠিক করবেন। যদি আপনার বয়স কম থাকে তাহলে হয়তো আপনি দশ শতাংশ, বা বিশ শতাংশ সঞ্চয় করতে পারেন। বয়স যদি বেশি হয়ে যায় এটা ত্রিশ শতাংশের উপরে, এমনকি পঞ্চাশ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

আবার বলছি, আপনি যে টাকাটা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেবেন সেই টাকাটা আপনি খরচ করবেন না। আমরা প্রায়ই যেটা করি সেটা হচ্ছে, যেহেতু রিজার্ভ ফান্ড অনেকে গঠন করি না, যে টাকাই আমরা সঞ্চয় করি প্রয়োজন হলে সেটাই খরচ করে ফেলি। আমার কথা হচ্ছে, যে টাকাটা আপনি এভাবে নিজেকে পেমেন্ট করছেন, সঞ্চয় গড়ে তুলছেন সেই টাকাটা যত দরকারই হোক, খরচ করবেন না। কারণ এই টাকায় হাত দিলে দেখবেন কয়দিন হয়ত ভালো কাটবে কিন্তু আপনার সঞ্চয় চলে যাবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।