Home স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা জালিয়াত ডাক্তার: আছে চেনার উপায়?

জালিয়াত ডাক্তার: আছে চেনার উপায়?

।। রিন্টু আনোয়ার ।।

দেশের কর্মসংস্থান, শিক্ষাব্যবস্থা ও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে নানা রকম অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ৭ চিকিৎসকসহ চক্রের ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তারা বলছে, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পুলিশের মতে, পাঁচজন বিএনপি ও একজন জামায়াতের রাজনীতির সাথে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন।

চাঞ্চল্যকর আরো নানা ঘটনার মতো ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও হয়তো এক দিন আমরা ভুলে যাবো। মনে করিয়ে দিলেও ক্ষেপে যাবো। বলব- ‘না, এমন কিছু ঘটেনি তো’। এ ভুলোব্যারাম আমাদের আছে। মেডিক্যাল সায়েন্সে এ রোগটির নাম ডিমেনশিয়া। এ রোগের মূল কারণ সাম্প্রতিক জীবনের স্ট্রেস। ঘটনার ঘনঘটা এত বেশি, সব মনে রাখা বড় কঠিন। ঘটনাচক্রে পুলিশের বিশেষ বিভাগ সিআইডি না জানালে আমাদের জানা হতো না, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে। এ বিষয়ক সংবাদটির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে ১৬ বছরে চিকিৎসক হয়েছেন হাজারে হাজার। বেশ নামেদামে ডাক্তারি করছেন তারা। তাদের নামের সাথে এমবিবিএসসহ আরো কত ডিগ্রি। একজন রোগী বা রোগীর স্বজনের জায়গা থেকে ভাবলে কেমন লাগে? অসুখ-বিসুখে কার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে আমাদের? কী চিকিৎসা আমাদের দিচ্ছে তারা?

বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিসিএস পরীক্ষায় পর্যন্ত প্রশ্ন আউট বা জালিয়াতির খবরের সাথে আমরা পরিচিত। তা কখনো বিচ্ছিন্ন, কখনো টানাও চলেছে। প্রশ্ন জালিয়াত চক্রের কারো কারো মাঝে মধ্যে ধরা পড়ার খবরও সামনে আসে। এসব ঘটনা আবার আমরা ভুলেও যাই। নিত্য কত ঘটনা আমাদের সামনে! এক ঘটনা আমাদের আরেক ঘটনা ভুলিয়ে দেয়। এবারের ঘটনাটি একটু ভিন্ন মাত্রার। এ কুকাণ্ডের কেউ অশিক্ষিত নয়, গরিব-নাখান্দাও নয়। এরা শিক্ষিত, মেধাবী। একটি মামলার সূত্র ধরে ধরা পড়ে ঘটনাটি। তাও আবার সিআইডি ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে না জানালে এমন জানাজানি হতো না।

২০২০ সালের ২০ জুলাই মিরপুর মডেল থানায় করা মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, সম্প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ সক্রিয় সদস্য প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। গত ৩০ জুলাই ২০২৩ থেকে ৯ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডির সাইবার টিম। গ্রেফতারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন। গ্রেফতারকৃতরা হলেন— ফেইম কোচিং সেন্টারের সাথে জড়িত ও প্রধান অভিযুক্ত ডা: ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা: সোহেলী জামান (৪০), প্রাইমেট কোচিং সেন্টারের মালিক ডা: মো: আবু রায়হান, থ্রি-ডক্টরস কোচিং সেন্টারের ডা: জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক ডা: মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮), জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটর) চিকিৎসক ডা: জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), গ্রেফতারকৃত জসীমের বড় ভাই জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), ই-হক কোচিং সেন্টারের মালিক আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩), ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্রের জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫), টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)।

তাদের মধ্যে সোহেলী ও রনি সরকারি চিকিৎসক। রয়েছেন প্রশ্নফাঁসকারীদের নিকটাত্মীয় ও চিকিৎসক দম্পতিও। গ্রেফতার ১২ জনের মধ্যে দম্পতি ডা: ময়েজ ও ডা: সোহেলী এবং ডা: জনি ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেননি। আটজন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন যাতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকে পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যশখ্যাতিতে আছেন। তাদেরকে কি চেনা সম্ভব? গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেয়া বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং অ্যাডমিট কার্ডও উদ্ধার করা হয়েছে। এই চক্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে।

আরও পড়তে পারেন-

এ দিকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের নেপথ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার নাম নীতিশ চন্দ্র সরকার। বর্তমানে তিনি অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটি বা এলপিআরে রয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগে কর্মরত। এস এম আনিস নামে তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। নীতিশ চন্দ্রকেও নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ। যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে।

খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের জেরে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সুযোগ নিয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে। তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ? বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বলছে, প্রমাণ পাওয়া গেলে বাতিল হবে এসব শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব। টাস্কফোর্স গঠন করে বিচারের দাবিও উঠেছে। এ ব্যাপারে সিআইডি প্রতিদিনই পাচ্ছে নতুন নতুন সব তথ্য। তবে ভর্তি পরীক্ষা জালিয়াতি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে। অভিনব কায়দায় একটি চক্র দেশের বাইরের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করার খোঁজ পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এসএসসি, এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীদের কেউ বাইরের কোনো দেশের নয়। সবাই এ দেশেরই সন্তান। বছরের পর বছর তাদের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন। সিআইডির পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরে ১০ বার ফাঁস হয়েছে এই প্রশ্নপত্র। বছরভেদে ১০-২০ লাখ টাকার বিনিময়ে একজন পরীক্ষার্থীকে এসব প্রশ্ন দেয়া হতো। এভাবে অন্তত চার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন যাদের বড় অংশ ইতোমধ্যে পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক হয়েছেন। কোচিং সেন্টারের আড়ালে চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এই অপকর্মে জড়িয়েছেন। এভাবে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন শতকোটি টাকা।

সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের ১৫-২০ জন চিকিৎসকসহ অন্তত ৬০ জনের নাম রয়েছে। মূলত কোচিং ব্যবসাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে প্রশ্নফাঁসকারীরা। সিআইডির অনুসন্ধানে প্রশ্নফাঁসে ছয়টি কোচিং সেন্টারের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। সেগুলো হলো- ফেইম, প্রাইমেট, থ্রি-ডক্টরস, মেডিকো, ইউনিভার্সেল এবং ই-হক। সিআইডি জানিয়েছে, এর মধ্যে মেডিকোকে এখনো তারা সন্দেহের আওতায় রেখেছে। এই কোচিং সেন্টারটির সারা দেশের ১৮টি ব্রাঞ্চে ৮-১০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকারি মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাওয়া প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এক হাজার ৬০০ তাদের কোচিং থেকে ভর্তি হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চারজন এর আগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। যত শিক্ষিত, উচ্চবিত্তেরই হোক, আইনগতভাবে তাদের পরিচয় প্রতারক-অপরাধী। যথাআইনে তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারই কাম্য।

কিন্তু এরই মধ্যে এ ঘটনায় রাজনীতি টেনে আনা হয়েছে। সিআইডি থেকে জানানো হয়েছে, ‘গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপি ও ১ জন জামায়াতের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় যুক্ত ছিলেন।’ এটি খুব জরুরি তথ্য? উদ্দেশ্যও কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল না? অপরাধী শনাক্তের পর রাজনৈতিক পরিচয় আসছে কেন? এত বছর এরা জঘন্য অপরাধ করে গেল। সংশ্লিষ্টরা কেউ কিছু টেরও পেল না। জামায়াত-শিবির, বিএনপি কোন জায়গায় দাঁড়াতে পারে না। না দাঁড়াতে পেরেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলো? সুদীর্ঘ সময় আওয়ামী রেজিমের কেউ জানলই না? এ ধরনের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা যায় না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ই-মেইল- rintu108@gmail.com

[বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা উম্মাহ২৪ডটকম-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।