Home ওপিনিয়ন পাকিস্তান কি আরেকটি একাত্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে

পাকিস্তান কি আরেকটি একাত্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে

।। হামিদ মীর ।।

আমার আশাবাদ নিয়ে অনেক বন্ধু বিরক্ত হয়ে গেছেন। আগে তারা প্রশ্ন করতেন। এখন আর প্রশ্ন করেন না। ঘৃণার আক্রমণ আর সন্দেহের ঝড় কিছু বন্ধুকে এক কাল্পনিক ফলে পৌঁছে দিয়েছে। ১ এপ্রিল বন্ধু ড. ইকবাল আমাকে খুঁজে বের করেন এবং শুধু একটি কথা বলে ফিরে যান। তিনি বলেন, পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে। আমরা আরো একটি ঢাকা পতনের (বি.দ্র. পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুকুতে ঢাকা বা ঢাকা পতন বলে থাকে- অনুবাদক) দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে থাকলাম, আজকের পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানের মধ্যে মিলটা কোথায়? ঢাকা পতন ছিল এক সেনা অভিযানের ফল। কিন্তু আজ তো কোনো সেনা অভিযান চলছে না। পাকিস্তানে তো জেনারেল ইয়াহিয়া নয়, শাহবাজ শরিফের শাসন চলছে। তাহলে আমরা কোন ধরনের পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?

১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান একে অপরের মুখোমুখি ছিল। আর ২০২৩ সালে শাহবাজ শরিফ ও ইমরান খান একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। উভয়ের সম্পর্ক পাঞ্জাবের সাথে। জাতি উমরা ও জামান পার্ক কি একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, নাকি পাঞ্জাবের সামনে পাঞ্জাব এসে দাঁড়িয়েছে? ১৯৭১ সালে আমরা বাঙালিদের গাদ্দার ও রাষ্ট্রশত্রæ আখ্যায়িত করেছিলাম। আজ একজন আরেকজনের প্রাণ নিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এ বাস্তবতা কিভাবে অস্বীকার করা যায় যে, পাকিস্তান গঠনের পর থেকে ৭৫ বছর ধরে বাঙালি, বেলুচ, পাখতুন ও সিন্ধিদের গাদ্দার আখ্যায়িত করে যাওয়া হচ্ছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নওয়াব নওরোজ খান জারাকজাই, বাচাখান, আলতাফ হোসাইন ও বেনজীর ভুট্টোসহ বহু রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইংরেজদের তৈরি আইন ২৪-এ ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের আদালতের মানবাধিকারের কথা স্মরণে আসে না।

জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে জাভেদ হাশেমী ও আখতার মিঙ্গালের বিরুদ্ধে ২৪-এ ধারায় মামলা লিপিবদ্ধ হলে আমরা দাবি উত্থাপন শুরু করেছিলাম, এ কালাকানুন বাতিল করা হোক। কেননা কায়েদে আজমও এ আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। ইমরান খানের শাসনামলে এ কালাকানুনের আওতায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২০২০ সালে রেজা রব্বানি সিনেটে এ আইন বাতিলের বিল উত্থাপন করেন। ইমরান খানের সরকার বিলের বিরোধিতা করে। তবে বিল অনুমোদন করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বিল পাস করেনি।

শাহবাজ শরিফ ক্ষমতায় এলে আরো একবার রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ওই ঔপনিবেশিক আইনের ব্যবহার শুরু হয়। এবার ২৪-এ ধারার বেশি ব্যবহার হয়েছে মধ্য পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে। যখন পাঞ্জাবকে গাদ্দার বলা শুরু করে দিলো, তখন লাহোর হাইকোর্ট অনুভব করলেন, ২৪-এ আইন পাকিস্তানের অস্তিত্ববিরোধী। সুতরাং এ আইনকে নামসর্বস্ব ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ প্রকাশ করেছে তেহরিকে ইনসাফের লোকেরা। ২৪-এ ধারা বিলুপ্তি নিরাশার অন্ধকারে আশার আলো। কিন্তু এ আলো ওই সময় প্রকাশ হলো, যখন ক্ষমতার যুদ্ধে জাতি উমরা ও জামান পার্কবাসী পরস্পরের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত। কারো কাছে ভালো লাগুক বা না লাগুক, সত্য কথা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের লড়াইয়েও পাঞ্জাবের মোকাবেলায় পাঞ্জাবকে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

সর্বপ্রথম বয়কটের প্রস্তাব দেন লন্ডনে অবস্থানরত নওয়াজ শরিফ। তিনি চিফ জাস্টিস উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। নওয়াজ শরিফ ও বান্দিয়াল উভয়ে পাঞ্জাবের মানুষ। নওয়াজ শরিফের দলের ধারণা মতে বিচারপতি বান্দিয়াল ও তার সাথের বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা মূলত ইমরান খানের সমর্থক। অথচ এ বিচারপতিরা গত বছর সেই রায় দিয়েছিলেন, যার ফলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা আন্দোলনের পথ সুগম হয়। মোটকথা, বিচারপতি বান্দিয়াল ও তার সঙ্গী দুই বিচারপতির বেঞ্চ বেশ বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। শুরুতে এটি ৯ সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ ছিল। কিন্তু সঙ্কুচিত হয়ে এটি তিনে এসে দাঁড়ায়। বিচারপতি এজাজুল হাসান প্রথম বেঞ্চ থেকে আলাদা হন। এরপর দ্বিতীয়বার বেঞ্চে যুক্ত হন। তার যুক্ত হওয়া এ বেঞ্চের মর্যাদা খারাপভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিসের মুখোমুখি হওয়া গণতন্ত্রের জন্য বিপদ বাড়িয়ে দেবে।

১৯৯৭ সালে সরকার ও সুপ্রিম কোর্ট মুখোমুখি হওয়ার সময় নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০২৩ সালে এ অপ্রীতিকর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সময় শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী। তবে বিচারপতিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ শাহবাজ শরিফ নন। এ দ্বন্দ্ব ২০১৯ সালে ওই সময় সৃষ্টি হয়, যখন ইমরান খানের সরকার বিচারপতি কাজী ফায়েজ ঈসার বিরুদ্ধে একটি রেফারেন্স প্রেসিডেন্ট আরিফ আলাভীর কাছে পাঠায়। ওই রেফারেন্সের পেছনে ছিলেন জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া। মিথ্যার ওপর আল্লাহর লানত।

জেনারেল বাজওয়া, কাশেফ আব্বাসি, মুহাম্মদ মালেক ও নাদিম মালেক আমার সামনে বিচারপতি কাজী ফায়েজ ঈসার বিরুদ্ধে আলোচনা করলে আমি তাদের সতর্ক করে বলি, কাজী ফায়েজ ঈসার বিরুদ্ধে মামলা গঠন করে আপনারা ইমরান খানের সরকারকে জটিল অবস্থায় ফেলবেন। কিন্তু জেনারেল বাজওয়া বেশ আত্মম্ভরিতার সাথে আমার অভিমত প্রত্যাখ্যান করেন। তখনো রেফারেন্স দায়ের হয়নি, কিন্তু আমি বিচারপতি কাজী ফায়েজ ঈসার বিরুদ্ধে গঠিত ষড়যন্ত্র নিয়ে দৈনিক জংয়ে কলাম লিখে ফেলি। ওই কলাম প্রকাশের পর ইমরান খান আমাকে ডেকে পাঠান এবং আশ্বাস দেন, তিনি বিচারপতি কাজী ফায়েজ ঈসার বিরুদ্ধে কোনো রেফারেন্স পাঠাবেন না। কিন্তু কয়েক দিন পর তিনি বাজওয়ার সামনে অস্ত্র ফেলে দেন এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে যান।

ওই ষড়যন্ত্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। যা আজ এক সঙ্কটে রূপ নিয়েছে। বিচারপতিরা একে অন্যের সাথে বসতে প্রস্তুত নন। আর তাদের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ বপনকারী বাজওয়ার কৃতিত্ব দেখুন, তিনি নওয়াজ শরিফের পিছে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। এ কাহিনীটিও বেশ মনোরম যে, বাজওয়া কার সহায়তায় নওয়াজ শরিফের পিছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আসল বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতকে ধ্বংস হওয়া থেকে সম্পূর্ণ বাঁচানো। শাহবাজ শরিফের দাবি, পাঞ্জাব ও খায়বার পাখতুনখাওয়াতে নির্বাচনের ব্যাপারে চিফ জাস্টিস ফুল কোর্ট গঠন করবেন। ফুল কোর্টের ব্যাপারে ইমরান খানের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু চিফ জাস্টিস ফুল কোর্ট গঠনে রাজি নন। কেন্দ্রীয় সরকার একটি আইনের মাধ্যমে চিফ জাস্টিসের ক্ষমতা সীমিত করে দেয়, যার ওপর তিনি খুশি নন। কিন্তু চিফ জাস্টিসকে নিজের প্রতিষ্ঠান রক্ষায় নিজের অহমিকা কোরবানি করতে হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহর পক্ষ থেকে চিফ জাস্টিস ও তার দুই সঙ্গী বিচারপতির বিরুদ্ধে রেফারেন্সের হুমকি বিবেকসম্মত হয়নি। এ সময় হুমকি নয়; বরং সমঝোতা ও কৌশলের প্রয়োজন। যদি কেউ এ ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে থাকেন যে, উমর আতা বান্দিয়ালের স্থানে কাজী ফায়েজ ঈসা চিফ জাস্টিস হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাবে, তাহলে এ বিভ্রান্তি যেন তিনি অন্তর থেকে বের করে দেন। কাজী ফায়েজ ঈসা সংবিধানের মৌলিক চাহিদাগুলোর বিষয়ে কোনো সমঝোতা করবেন না।

আজ পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে, সংবিধানকেও বাঁচাতে হবে। আল্লাহ না করুক, সংবিধান ভেঙে পড়ার পর আমরা ঢাকা পতনের চেয়েও বড় ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে পারি।

[পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩ এপ্রিল, ২০২৩ হতে]

ভাষান্তর- ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ইমেইল- ahmadimtiajdr@gmail.com

– হামিদ মীর, পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।