Home লাইফ স্টাইল প্রসঙ্গঃ নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

প্রসঙ্গঃ নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

অলংকরণ। - উম্মাহ।

।। ডা. তানজিনা রহমান ।।

প্যারেন্ট হিসেবে নার্সিসিস্টের (আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধিতে আক্রান্ত অভিবাকদের) আচরণ তার সন্তানের সাথে কেমন হয়?

প্যারেন্ট হিসাবে সন্তানকে গাইড করবার যে দায়িত্ব, নার্করা প্রায়ই তার অপব্যাবহার করে। তারা সন্তানের উপর অত্যাধিক কন্ট্রোলিং এবং পসেসিভ হবার কারণে সন্তানের জীবনের প্রধান ডিসিশন মেকার হয়ে উঠতে চায়।

তারা সন্তানকে আলাদা পার্সোনালিটি নয়, বরং নিজের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবেই দেখে এবং এদের মাত্রাতিরিক্ত পসেসিভনেস এবং কন্ট্রোলিং টেন্ডেন্সি সন্তানের মননশীলতাকে নিস্ক্রিয় করে দেয়।

নার্সিসিস্টরা কি তাদের সন্তানদের ভালবাসে?

নার্ক, সাইকোপ্যাথ, সোশিওপ্যাথদের কখনো সেন্স অফ এম্প্যাথি থাকে না। তাদের কখনোই এই সেন্স ডেভেলপ করে না বা করবে না। সেজন্য এরা কখনো কাউকেই ভালবাসতে পারে না। যখন এদের সন্তান হয়, এই অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে না।
সাম্প্রতিক গবেষণা এটি নিশ্চিত করেছে যে, নার্সিসিস্ট প্যারেন্ট কাওকেই সত্যিকার অর্থে ভালবাসতে পারে না, এমনকি তার সন্তানদেরও নয়।

তারা কখনোই নিজেদের প্রয়োজন বা চাহিদার বাইরে অন্য কাওকে প্রাধান্য দিতে পারে না। যার ফলে তারা সন্তানদেরও কখনো উল্টো ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।

চিকিৎসা: নার্সিসিসজম রোগে আক্রান্তের কোন চিকিৎসা নেই। এটা কোন থেরাপির মাধ্যমেই সারানো যায় না। অনেকে Talk therapy”-র কথা বলে। কিন্তু এতে তেমন কোন ফল হয় না, বরং তাদের ভাল করার চেষ্টা বেশ বিপদজনক। কারণ, এতে করে তারা আরো পরিষ্কার ধারণা পায়- কী করে তাদের ভিক্টিমকে এবিউজ বা অপদস্থ করা যাবে।

কাজেই সোজা কথায় বলতে গেলে “নার্ক থেকে দূরে থাকাই এর চিকিৎসা”।

নার্কদের শিকারগুলো সবসময় একেবারেই তাদের বিপরীত গুণসম্পন্ন অর্থাৎ নম্র, ভদ্র, নরম দিলের মানুষরা হয়ে থাকে। এ কারণে তারা নার্সিসিস্টের প্রতিটি অন্যায়ে তার প্রতিই দুঃখবোধ করেন!

‘বোঝে না, বুঝালে বুঝবে’ এই কথা ভেবে তাকে বোঝাতে বোঝাতে, সেল্ফ ডিফেন্স করতে করতে আর নিজে অ্যাবিউজ বা অপদস্থ হতে হতে নিজের অমূল্য সময়গুলো অপচয় করে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন, “রাহমান’ এর বান্দা তারাই- যারা নম্রভাবে চলাফেরা করে পৃথিবীতে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ লোকেরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে- সালাম।”

কাজেই মূর্খদের ‘সালাম’ বলে সরে যান! ইসলামিক্যালি এটাই তাদের সাথে করণীয়।

আপনি যতক্ষণ তাদের বুঝাতে থাকবেন, বুঝবেন যে আপনি তাই করছেন যা নার্সিসিস্টরা চায়। তাদের সাথে করতে হবে তারা যা চায় তার উল্টোটা।

অতএব, যতো জঘন্য কথাই সে বলুক রিএক্ট করবেন না। এতে তার জন্য আরো সহজ হয় নিজেকে ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করা। এভাবেই সে আপনার ইমোশোন কন্ট্রোল করে!
যেদিন আপনি তাদের সমস্ত কার্যক্রম থেকে নিজেকে মানসিকভাবে সরিয়ে নেবেন, সেদিন থেকে আপনি যেমন নিজে ভালো থাকবেন, তেমনি নার্কের কাছে হবেন অকেজো, বোরড, ধূসর পাথর বিশেষ। সাইকোলজির ভাষায় এটাকে বলে গ্রে রক মেথড!

যে চাহিদা মতো আচরণ করে না, নার্সিসিস্ট তার প্রতি আর ইন্টারেস্টেড হয় না। ফলে সে নতুন সাপ্লাইয়ের দিকে মুভ করে, আর তাকে ডিসকার্ড করে!

নার্কদের শাটডাউন করার কিছু পদ্ধতি যা আধুনিক প্রফেশনালসরা আপ্লাই করতে বলেন। যেমন-

স্টে অ্যাওয়ে-
সে অ্যাটেনশন সীকের জন্য যাই করুক না কেন, যতদূর সম্ভব তার সাথে সরাসরি কন্টাক্ট লিমিট করতে হবে। এমনকি অন্য মানুষের থেকেও তার কথা বা কাজের তথ্য রিসিভ করা যাবে না! এমনভাবে তাকে ইগনোর করতে হবে, যেন ভিক্টিমের জীবনে তার কোন অস্তিত্ব বা গুরুত্বই নেই!

‘The only way to win with a toxic person not to play. Leave their “playground” অর্থাৎ- ‘একজন ক্ষতিকর ব্যক্তির সাথে না খেলতে যাওয়াটাই জয়ের একমাত্র উপায়। তাদের জন্য ‘মাঠ’ ছেড়ে দিন।

গ্রে রক মেথড-
ফ্যামিলি মেম্বারস, ক্লাস মেইট যাদের কাছ থেকে দূরে থাকা সম্ভব না, তখন এই অপশন। আনরেসপন্সিভ, আনইন্টারেস্টেড ওয়েতে যোগাযোগ করা। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা না বলা, পার্সোনাল কোন ইনফরমেশন শেয়ার না করা (ভালো কিংবা মন্দ), সব ধরনের বাউন্ডারী সেট করা! স্রেফ দায়িত্বটুকু করে যাওয়া।

নো সেল্ফ ডিফেন্স। কারণ, আপনাকে উত্তেজিত করার জন্যই ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ব্লেইম দেয়া হয়! এমনকি ফ্লাইং মাংকি বা স্মেয়ার ক্যাম্পেইনের ব্যাপারেও আপনি যা করবেন, তা হলো ‘নাথিং’ বা উপেক্ষা করে যাওয়া।

আপনাকে প্রাকটিস করতে হবে কীভাবে যত রকম অপমানকে পার্সোনালি না নিয়ে ইগনোর করে প্লেগ্রাউন্ড থেকে বের হতে হয়।

পরিস্থিতির আলোকে মাঝে মাঝে থার্ড পার্টির কাছে সত্যটা তুলে ধরার প্রয়োজন হলে তা করতে হবে।

স্টে অ্যাওয়ে+গ্রে রক মেথড; কম্বিনেশন এপ্লাই করা যেতে পারে! স্টে অ্যাওয়ে ফ্রুটফুল হয় না- যদি না কেউ ইমোশোনালি ডিজএঙ্গেইজড হয়।

বাউন্ডারী সেটিংস-
নার্সিসিস্ট বাউন্ডারী ক্রস করতে ভালবাসে!এরা বেশ নোসী হয়। অন্যের জীবন, ব্যক্তিগত ব্যাপার, আর্থিক ব্যাপার; সবকিছুতেই নাক গলানো তারা নিজেদের অধিকার ভাবে। আপনি জাস্ট ডোর ক্লোজ করে দিন! ইমোশোনালি, ফিজিক্যালি, ফিনানসিয়ালি, সোশ্যালি সবক্ষেত্রেই এটা করতে হবে!

সেল্ফ কনফিডেন্স
নিজের ভিতর সেল্ফ কনফিডেন্স বাড়াতে হবে। মানুষ ভাল বা খারাপ বললেই আমরা সেটা হয়ে যাই না! সব মানুষের চোখে ভাল হওয়া চাটুকার ছাড়া কারো পক্ষেই সম্ভব না।

একজন মুসলিম তখনই সফল, যখন তিনি আল্লাহর চোখে ভাল হতে পারেন। আখিরাতের দিকে ফোকাস করুন, নিজের দিকে ফোকাস করুন। অন্য কিছুতে ব্রেইনটাকে ব্যস্ত রাখুন। গার্ডেনিং, নতুন কোন রেসিপি, নতুন কোন উদ্যোগ, নতুন সূরা মুখস্ত করা, নতুন কিছু আয়ত্ব করার চেষ্টা ইত্যাদি।

আবারো বলছি, আখিরাতের দিকে ফোকাস করুন। নিজের মনোযোগ সরিয়ে ফেলুন অন্যদিকে। আস্তে আস্তে সব চেঞ্জ হওয়া শুরু হবে! ভাল মুসলিমের টার্গেট কিন্তু জান্নাহ। তবেই না আমরা সফল। ইন শা আল্লাহ।

সে চায় আপনি তাকে নিয়ে পড়ে থেকে নিজেকে ধ্বংস করে দিন। কাজেই আপনার কাজ ঠিক উল্টোটা হতে হবে। তাকে একপাশে ফেলে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।

একটি বিষয় মাথায় রাখুন- আল্লাহ হিদায়াত না দিলে, নার্সিসিস্টরা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এসব করেই যায়। যে মানুষ কখনো এদের ভিক্টিম হয়নি, তারা সত্যিই উপলব্ধি করতে পারে না এরা কতোটা ভয়ংকর। তারা যে গুনাহ করতে পারে এই সেন্স তাদের নাই। তাদের যা বলা যায় না তা হল, তাদের দোষ। তারা নিজেদের কোন দোষের কথা শুনতে পারে না। তারা অন্যের উপর দোষ চাপাতেই অভ্যস্ত।

যে ভাবছে তার কোন দোষ নাই, তার তওবার প্রশ্নই ওঠে না। যে মানুষের কোন ইস্তেগফার নাই, তার আখিরাত কেমন হবার কথা?

আমি কাছ থেকে দেখেছি, বেশীরভাগ নার্সিসিস্টরাই খুব মিষ্টি করে কথা বলতে পারদর্শী। মিথ্যা কথা এবং অভিনয়ে আরও বেশী পারদর্শী এবং এভাবেই এদের মিথ্যা অভিনয়ে অন্যরা বিভ্রান্ত হয়!

অতএব, তার বিচারের ভার আপনি আল্লাহ আহকামুল হাকিমীন এর উপর ছেড়ে দিন।

[১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ মোতাবেক- ১৯ সফর, ১৪৪৪ হিজরী]

লেখক: মেডিকেল কনসালটেন্ট, সনোলজিস্ট।

নোট:

নোট: নার্সিসিস্টিক বা আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি, যাকে ইংরেজি Narcissistic Personality Disorder নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বলা হয়। এটা হলো এমন একটি ব্যাপক ও দীর্ঘকালস্থায়ী প্রবণতা, যা মানুষে আচরণে বা চিন্তায় অপরের প্রশংসা পাওয়ার অত্যন্ত প্রবল চাহিদা এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতির তীব্র অভাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।

এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই বিশ্বাস করে যে, তারা তাদের চারপাশের মানুষদের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম মানুষ। ‘আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি’তে আক্রান্তরা প্রায়ই অপরের প্রতি উন্নাসিক ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করে।

উদাহরণস্বরূপ, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি একজন সাধারণ ওয়েটারের “কর্কশতা” বা “নির্বুদ্ধিতা” সম্পর্কে অভিযোগ করতে পারে এবং তাকে জেরা করা হলে সে অস্বীকার করতে পারে। তারা সাধারণত কপটতার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু মানুষদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ ঘটনা তার উপরে দোষারোপের চেষ্টা করে এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী প্রমাণের অবিরাম চেষ্টা করে যেতে পারে।

এই রোগে আক্রান্তদেরকে “স্বকামী” (narcissist) বা “আত্মরতি”তে (narcissism ) আক্রান্ত হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।