Home ইসলাম টেকসই আবাসন প্রসঙ্গে কোরআনের নির্দেশনা

টেকসই আবাসন প্রসঙ্গে কোরআনের নির্দেশনা

 ।। কাসেম শরীফ ।।

ঘর মানবজাতির জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। জীবন, সম্পদ ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য একটি নিরাপদ আবাসন অপরিহার্য। ইসলাম মানুষকে পরিকল্পিত ও নিরাপদ আবাসন গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে একটি নিরাপদ ও বিজ্ঞানসম্মত আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

আবাসন হবে টেকসই ও নিরাপদ

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মৌমাছি ও মাকড়সার ঘর তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ মাকড়সার ঘরের নিন্দা করেছেন এবং মৌমাছির ঘরের প্রশংসা করেছেন। মাকড়সার ঘর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই দুর্বলতম, যদি তারা জানত।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৪১)

আর মৌমাছির ঘর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, ঘর নির্মাণ কোরো পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে ঘর নির্মাণ করে তাতে। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৬৮)

তাফসিরবিদরা বলেন, মাকড়সার ঘরকে মন্দ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কেননা মাকড়সা যত্রতত্র ঘর তৈরি করে এবং দৃষ্টিনন্দন হলেও তা খুবই দুর্বল। বিপরীতে মৌমাছির আবাস গড়ে ওঠে সুপরিকল্পিতভাবে এবং নিরাপদ স্থানে। মৌমাছির ঘর (চাক) বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত থাকে। যেমন—মধু সংরক্ষণের স্থান, রানি মৌমাছির ঘর, সাধারণ মৌমাছির ঘর, প্রজনন স্থান ইত্যাদি।

ইসলামের প্রথম নগর ছিল পরিকল্পিত

মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে একটি সুপরিকল্পিত নগরব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি মদিনার আবাসন, ব্যবসা, কৃষি ও প্রশাসনিক কাজের জন্য পৃথক স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি মদিনা নগরীতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে নতুন নতুন আবাসন তৈরি করেন।

নবীজি (সা.)-এর নগর পরিকল্পনা

মহানবী (সা.)-এর নগর পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়।

১. অঞ্চল ভাগ করা : মদিনায় হিজরত করার পর নবীজি (সা.) সর্বপ্রথম আল্লাহর ইবাদতের স্থান নির্ধারণে মনোযোগ দেন।

এরপর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্র তৈরি করতে চাইলেন। যেহেতু ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতির ভেতর কোনো বিভেদরেখা নেই, এ জন্য তিনি ইবাদত ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে মসজিদে নববী তৈরি করেন। এটাই ছিল মদিনা নগরীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। অতঃপর তিনি নিজের ও মুহাজির সাহাবিদের জন্য আবাসন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজের জন্য মসজিদের পাশের স্থানটিকে নির্বাচন করেন। কেননা এটাই দায়িত্ব পালনে সহায়ক ছিল। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় নবাগত মুহাজিরদের আবাসনের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঘর নির্মাণের মাধ্যমে। নির্মাণাদির এই স্তর ও পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে বছরখানেক বা এর চেয়ে কিছু বেশি সময় কেটে যায়। (তারিখে ইবনে কাসির : ৩/২২০-২২২)

২. গৃহহীনদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা : মদিনা নগরীর পরিকল্পনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আল্লাহর জন্য হিজরত করে বসতভিটা ছেড়ে আসা অসহায় মুহাজিরদের আবাসনের ব্যবস্থা করা। প্রাথমিকভাবে তাদের বসবাসের জন্য মসজিদে ব্যবস্থা করা হয়, বড় গোত্র হলে শহরের এক পাশে বিশাল তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়। প্রাথমিক পর্ব শেষে ধীরে ধীরে স্থায়ী আবাসন ও রোজগারের ব্যবস্থা করা হতো। (তাবাকাতে ইবনে সাদ : ১/৩৪৬, ওয়াফাউল ওয়াফা : ১/৫২৫)

৩. বিক্ষিপ্তভাবে ঘর না তোলা : দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা ছিল বিক্ষিপ্তভাবে তাদের জন্য ঘর না তুলে নির্ধারিত স্থানে পরিকল্পিতভাবে ঘর তোলা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনাবাদি জায়গাগুলো আবাদ করার মাধ্যমে অথবা কতেক আনসারি সাহাবির দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত জমিতে মুহাজিরদের জন্য বড় বড় ঘর তৈরি করা হতো। এই ঘরগুলো বড় কামরাবিশিষ্ট ছিল। একেক ঘর একেক গোত্রকে দেওয়া হতো। তবে রান্নাবান্নার জায়গা গোত্রভিত্তিক একত্রে ছিল। (তারিখে ইবনে কাসির : ৩/২২৪-২২৯, ওয়াফাউল ওয়াফা : ১/৫২৭)

৪. ভূমির সঠিক ব্যবহার : রাসুলুল্লাহ (সা.) ভূমির সঠিক ও সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের প্রতি মনোযোগী হন এবং সাহাবিদের বহুতল ভবন নির্মাণের পরামর্শ দেন। খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তাঁর ঘরের সংকীর্ণতার সমস্যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পেশ করলে তিনি বলেন, ‘তুমি ওপরের দিকে ঘর উঠাও, আর আল্লাহর কাছে প্রশস্ততা কামনা করো।’ (আখবারু মাক্কা : ৩/৩০৪)

৫. নতুন আবাসন তৈরি : নবীজি (সা.) শহরের ওপর যেন চাপ তৈরি না হয়, সে জন্য নতুন বসতি গড়ে তোলেন। তিনি অতিরিক্ত বসতিকে নতুন খালি স্থানে স্থানান্তর করার নির্দেশ দিয়েছেন। বনু কুরাইজা ও বনু নজিরের বিজিত এলাকাসহ মদিনার অভ্যন্তরীণ অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, যাতে একদিকে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির আশঙ্কা শেষ হয়ে যায়, অন্যদিকে গোত্র ও শ্রেণিগত সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়া যায়। এতে দুটি উপকার হয়েছে। প্রথমত, এতে কৃষি উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নবাগতদের আবাসনের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪০২৮, ফুতুহুল বুলদান পৃষ্ঠা : ৩১)

৬. পরিকল্পনায় পরিবর্তন নয় : কোনো পরিকল্পিত নগরীর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনাও ইসলাম পছন্দ করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই মদিনা নগর বিস্তৃত হয়ে আশপাশের বসতিগুলো যথা বনু সায়েদা ও বনু নাজ্জারের সঙ্গে লেগে যায়। যদিও পরিকল্পনা ছিল মদিনায় শুধু মুহাজিররাই থাকবেন। এ জন্যই পার্শ্ববর্তী গোত্র বনু সালামা যখন মদিনায় এসে বসতি স্থাপনের ইচ্ছা পোষণ করল, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের নিজেদের এলাকায় থাকার নির্দেশ দিয়ে মদিনায় বসত গড়ার প্রতি নিরুৎসাহ করেন। (সহিহ বুখারি হাদিস : ১৮৮৭)

পরবর্তী যুগের নগর পরিকল্পনা

নববী ও খোলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী যুগে দুটি নগরকে আধুনিক নগর ব্যবস্থার সূতিকাগার বলা যায়। তা হলো, ইরাকের বাগদাদ ও স্পেনের কর্ডোভা।

১. বাগদাদে নাগরিক সুবিধা : খলিফা আল-মনসুর ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক বাগদাদ নগর। আবহাওয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক দিক দিয়ে অনুকূল পরিবেশের চিন্তা করে এ নগর নির্মাণ করা হয়েছিল। খলিফার বাসভবন, মসজিদ, আবাসিক এলাকা, বিদ্যালয়, হাটবাজার, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাটের সমন্বয়ে গঠিত এই নগর। নগরের স্থাপত্য নিদর্শন ব্যতিক্রমধর্মী ও অনন্য। মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বলেন, ‘বাগদাদের গোসলখানাগুলো ছিল অত্যধিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত। দর্শকের কাছে প্রতীয়মান হয়, এটি কালো মার্বেল পাথরে তৈরি। প্রতিটি শোবার ঘরে একটি মার্বেলের বেসিন ছিল, যার সঙ্গে দুটি পাইপ সংযুক্ত ছিল। একটি দিয়ে গরম পানি, অন্যটি দিয়ে ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত হতো।

আরও পড়তে পারেন-

২. স্পেনের মুসলিম শহরগুলো : স্পেনের প্রাচীন মুসলিম শহরগুলোর আবাসিক এলাকাগুলো হতো শহরের কোলাহল থেকে দূরে নীরব এলাকায়। প্রধান সড়কগুলো থেকে ছোট গলি ধরে এসব এলাকায় প্রবেশ করতে হতো। প্রতিটি বাড়ির উঠানে থাকত বাগান ও চত্বর। বর্জ্যব্যবস্থা, পাকা সড়ক ও ঢাকা-নর্দমা ইত্যাদি। বিশেষত খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে কর্ডোভা ছিল বিশ্বের সর্বাধুনিক শহরগুলোর অন্যতম। মুসলিম শাসকদের স্থাপিত সড়কবাতিগুলো এখনো টিকে আছে। তারও আগে কায়রোতে বহুতল ভবন ও ছাদবাগানের চর্চা দেখা যায়। খ্রিস্টীয় নবম শতকে বাগানচর্চায় মুসলিম শাসকরা জ্যামিতিক নকশা, অগভীর খাল ও ঝরনার সংস্কৃতি যুক্ত করেন। (মুসলিম ইনভেনশন ওয়ান থাউজ্যান্ড ওয়ান)

পরিকল্পিত নগরীতে বসবাসে উৎসাহ

নববী যুগের শেষের দিকেই মদিনা নগরী পশ্চিমে বুতহা পর্যন্ত, পূর্বে বাকি ও উত্তর-পূর্বে বনু সায়েদা পর্যন্ত বিস্তৃৃত হয়। তখনই রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে নতুন বাসস্থান স্থাপনে নিরুৎসাহিত করেন। যদিও ধীরে ধীরে সীমানা আরো কিছুটা বিস্তৃত হয়, তবে মৌলিকভাবে তিনি তা নিয়ন্ত্রণে সফল হন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন মদিনার বসতি সিলা পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন তোমরা শামের (সিরিয়া, জর্দান ও ফিলিস্তিন) দিকে হিজরত করবে।’ (ওয়াফাউল ওয়াফা : ১/৯৮)

লেখক : সিনিয়র সহসম্পাদক ও ধর্ম বিভাগীয় প্রধান, কালের কণ্ঠ

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।