।। মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঊর্ধ্বলোকে গমন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা ইসরা/বনি ইসরাঈল ও সুরা আন-নাজমে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর ঊর্ধ্ব গমন সম্পর্কে ইসলামের পরিভাষায় দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়—ইসরা ও মিরাজ। ইসরা অর্থ নৈশভ্রমণ, রাত্রিকালীন ভ্রমণ। আর মিরাজ অর্থ সিঁড়ি, ঊর্ধ্বলোকে গমন, সোপান, মই।
মিরাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের কথা হাদিস দ্বারা আর ইসরা তথা নৈশভ্রমণের কথা কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। তাই ইসরাকে অস্বীকারকারী কাফির হবে, কিন্তু মিরাজকে অস্বীকারকারী কাফির হবে না। তবে মহাপাপী হবে।
মিরাজ কখন সংঘটিত হয় : মিরাজ কখন সংঘটিত হয় এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। মুসা ইবন ওকবা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে মিরাজের ঘটনা হিজরতের ছয় মাস আগে সংঘটিত হয়। ইমাম নববী ও কুরতুবি (রহ.)-এর মতে, মিরাজের ঘটনা মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পরে ঘটেছে। ইবন ইসহাক বলেন, মিরাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সব গোত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশির ভাগের মতে, নবুয়তের দশম বর্ষে রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজের ঘটনা সংঘটিত হয় (আর রাহিকুল মাখতুম)।
ভ্রমণের সূচনা : হাদিসের ভাষ্য মতে, মিরাজের সূচনা হয় মসজিদে হারাম থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) রজব মাসের ২৭-এর রজনীতে আল্লাহ তাআলার ঘরের হিজরের মাঝে শায়িত ছিলেন, এমন সময় জিবরাইল (আ.) এসে জাগ্রত করে তাঁর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে দূষিত রক্ত বের করে আবার জোড়া লাগিয়ে দেন। অতঃপর বোরাকে করে স্বশরীরে বায়তুল মাকদাসে নিয়ে যান। বোরাক হলো এমন একটি প্রাণী, যা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি আকৃতির একটি জন্তু, তার দুই ঊরুতে রয়েছে দুটি পাখা। তা দিয়ে সে পেছনের পায়ে ঝাপটা দেয়, আর সামনের দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলে।
প্রিয় নবী (সা.) বায়তুল মাকদাসের দরজায় খুঁটির সঙ্গে বোরাকটি বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন (আর রাহীকুল মাখতুম)।
ইসলামের ইতিহাসে মিরাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যখন সব দিক থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) মারাত্মক সংকট ও শোকের সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেই দুঃসময়ে আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। পার্থিব জীবনের অভিভাবক চাচা আবু তালেবের মৃত্যু, প্রাণপ্রিয় সহধর্মিণী উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল, তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনা, মক্কার কাফিরদের অমানবিক আচরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ করে দিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়।
পবিত্র মিরাজের প্রাপ্তি
পবিত্র মিরাজে মহান আল্লাহ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ (সা.)-কে পুরস্কারস্বরূপ কয়েকটি বস্তু প্রদান করেন—
এক. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফজিলতের দিক দিয়ে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সমান।
দুই. সুরা বাকারার শেষের দুটি আয়াত মিরাজেই অবতীর্ণ হয়।
তিন. উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে যারা কখনো শিরক করেনি, তাদের ক্ষমা করার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
চার. নামাজে পঠিত ‘আত্তাহিয়্যাতু’।
সমাজ সংস্কারে ১৪ দফা বিশেষ ভূমিকা
মহানবী (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে আসার পর সুরা বনি ইসরাঈলের মাধ্যমে ১৪টি দফা মানুষের সামনে পেশ করেন। বর্তমান সময়ে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ সংস্কারে এই ১৪ দফা বিশেষ ভূমিকা রাখবে। যেমন—
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না।
২. মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘…মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। তাঁদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হয় তাহলে তাঁদের সঙ্গে উহ শব্দটি পর্যন্ত কোরো না। তাঁদের ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না; বরং তাঁদের সঙ্গে মর্যাদাসূচক কথা বলো। তাঁদের সামনে বিনয়ী থেকো আর দোয়া করতে থাকো—‘হে আমার প্রতিপালক, তাঁদের প্রতি তেমনি দয়া করো, যেমনি তাঁরা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩-২৪)
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
৩. নিজ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে।
৪. আত্মীয়-স্বজনকে তাদের অধিকার দিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের অধিকার দাও। আর মুসাফিরদের হক আদায় করো। (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬)
৫. অপব্যয় করা যাবে না।
৬. মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রকাশ করতে হবে। ছলচাতুরি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না।
৭. ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেহিসাবি হওয়া যাবে না। আবার কৃপণতাও প্রদর্শন করা যাবে না।
৮. সন্তানদের হত্যা করা যাবে না। এটি মহাপাপ।
৯. জেনা-ব্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না, কেননা এটি নিকৃষ্ট ও গর্হিত কাজ।
১০. কোনো প্রাণীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে যে সে চাইলে রক্তের বিনিময় চাইতে পারে। তবে প্রতিশোধের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না।
১১. এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও যাবে না।
১২. ওজনে কম দিয়ে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। দাঁড়িপাল্লা সোজা করে ধরবে হবে।
১৩. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে মতামত দেওয়া অন্যায়। চোখ, কান, অন্তর সব কিছুই কিন্তু একদিন জিজ্ঞাসিত হবে।
১৪. জমিনে দম্ভ সহকারে চলা যাবে না। এগুলো সবই মন্দ ও ঘৃণিত কাজ।
এই ১৪ দফাই মিরাজের প্রকৃত শিক্ষা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ